আবুরখীল গ্রাম নিয়ে আমার কৌতুহল দীর্ঘদিনের। বিশেষত বাঙালি বৌদ্ধদের ক্রমবির্তনের ঐতিহাসিক ক্যানভাসে এই আবুরখীল গ্রামের অংশীদারীত্ব ছিল অনিবার্য যা এখনো বহমান। কবি সর্বানন্দ বড়ুয়া, পন্ডিত ধর্মরাজ বড়ুয়া, বিপ্লবী রুহিনী বড়ুয়া, ডা. রামচন্দ্র বড়ুয়াদের মতো আলোকিত ও প্রাগ্রসর মানুষের জন্মধন্য এই আবুরখীল গ্রাম। বাংলাদেশের গ্রামীণ পটভূমিতে একই গ্রাম থেকে পর পর দু’বছর দু’জন রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরষ্কার ‘একুশে পদক’ (২০১৯ খ্রি.-এ শিক্ষায় ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া [সাবেক মহাসচিব, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ] এবং ২০২০ খ্রি.-এ অধ্যাপক ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া [বর্তমান মহাসচিব, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ]) পাওয়া অবশ্যই গৌরবের। বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সিনিয়র যুগ্ম–মহাসচিব দেবপ্রিয় বড়ুয়া, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ারও জন্ম এ গ্রামে। ২৮ মে ২০২২ খ্রি.পশ্চিম আবুরখীলের আরেক কীর্তিমান, ধর্ম–সমাজ ও সাহিত্য–সংস্কৃতিসেবী, বন্ধু–স্বজন স্থপতি বিশ্বজিৎ বড়ুয়ার আমন্ত্রণে হালদা বিধৌত পশ্চিম আবুরখীল ভ্রমণ করে এলাম। স্থপতি বিশ্বজিৎ বড়ুয়ার উদ্যোগ ও অর্থায়নে নির্মিত ডা. মোহনচন্দ্র– ডা. শশাঙ্ক মেমোরিয়াল কমপ্লেঙের উদ্বোধনকে ঘিরে অজন্তা বিহার সেজেছে নানা রঙে। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালায় অগনন মানুষের সমাবেশ দেখে চমৎকৃত হলাম। যথাসময়ে উদ্বোধন হল ‘ডা. মোহনচন্দ্র–ডা. শশাঙ্ক মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স’। যে কমপ্লেক্সকে ঘিরে রয়েছে– মেডিটেশন সেন্টার, দাতব্য চিকিৎসালয়, ভিক্ষু নিবাস, পারিবারিক স্মৃতি চৈত্য এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন লাইব্রেরি ও কম্পিউটার সেন্টার। আমার কৌতুহলী মন এ গ্রামের সবকিছুতেই একটা ঘোর অনুভব করেছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে আমার বিস্ময়ের ঘোর মুগ্ধতা ছড়াল এ কমপ্লেক্স এর অন্যতম কক্ষ ‘লাইব্রেরি ও কম্পিউটার সেন্টার’–টি। ঘোরটা এই জন্য যে, সময়ের পর্যবেক্ষণে যেখানে আমরা নিয়মিত বিরতিতে অসংখ্য বিহার, মসজিদ–মন্দির দ্রুতলয়ে বেড়ে উঠতে দেখছি; গ্রামীণ আবহে যেখানে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত পালি টোল কিংবা ব্যক্তিগত–সামাজিক পাঠাগারগুলোর জীর্ণ–শীর্ণ শরীরে কোনভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মৃত্যুর প্রহর গুণতে দেখছি, সেখানে হালদার ভাঙনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে হালদার গা ঘেঁষে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মে নতুন একটি পাঠাগার উদ্বোধন! সত্যিই আমি চমৎকৃত ও বিস্মিত হয়েছি। আমি জানি না, কতটুকু জ্ঞানভিত্তিক সমাজের স্বপ্নে বিভোর হলে, কতখানি দৃষ্টির প্রসরণ ঘটলে, গ্রামের মানুষের শিক্ষা–সাহিত্য–সংস্কৃতি– কৃষ্টির প্রতি মানুষ কতখানি প্রতিশ্রুতিশীল হলে; কতখানি মানসিক শক্তিধর হলে প্রায় পাঠকশূন্য সমাজবাস্তবতায় দাদা–ঠাকুরদার স্মৃতিকে স্মরণে নিয়ে কোন মানুষ এতখানি ঝুঁকি নিতে পারে।
আমরা অনেকেই পারি না বা পারি নি। পশ্চিম আবুলখীলের মানসিক শক্তিধর, দূরপ্রসারী কৃতিপুরুষ স্থপতি বিশ্বজিৎ বড়ুয়া তা পেরেছেন। বঙ্গোপসাগরের সাথে সঙ্গমিত কর্ণফুলীর শাখা নদী হালদা। জোয়ার–ভাটার এই নদীটি রাউজান এবং ফটিকছড়ি উপজেলার কোল ঘেঁষে প্রবহমান রয়েছে।বলা যায়, এ দুটি উপজেলাকে ভৌগলিক সীমায় বিভক্ত করেছে। একসময় হালদার পলিমাটি এবং এর মৎস প্রজননকে ঘিরে এর দু’পাশের জনজীবনের অর্থনৈতিক–সামাজিক–সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপট নির্ণিত ও প্রতিভাত ছিল।বৃহত্তর চট্টগ্রামের শিল্প–সাহিত্যে, কাব্য–উপন্যাসে হালদার তীরবর্তী মানুষের জীবনের হাল–চালের বহুমাত্রিক রূপকল্প–চিত্ররূপ বর্ণিত রয়েছে। হালদার রূপ পাল্টেছে। বদলেছে তার গতিপথ। কালচক্রে আবুরখীল তথা পশ্চিম আবুরখীল আরো পাল্টাবে–বদলাবে। শুধু বদলাবে না আজকের দিনের আগামীর ইতিহাস। যে ইতিহাসের রচয়িতা স্থপতি বিশ্বজিৎ বড়ুয়া। হালদা ভাঙ্গে; হালদা বদলায়। বিশ্বজিৎ গড়ে; বিশ্বজিৎ পাল্টায়।