হায় আনারকলি!

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ২১ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

আনারকলি নামটা শুনতেই চোখের ওপর ভেসে ওঠে ‘মোগলআযম’। মোগল প্রাসাদে পাঞ্জাব হতে আগত সামান্য এক কিশোরীর রূপে মুগ্ধ শাহাজাদা সেলিম। ভালোবাসা হয় দু’জনের। সম্রাট আকবর ক্ষুব্ধ হন যুবরাজের ওপর। তবে শাস্তি কিন্তু পুত্রকে নয়, হতদরিদ্র মায়ের কন্যা আনারকলিকেই দিয়েছিলেন। মহামতি সম্রাট আনারকলিকে জীবন্ত কবর দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেদিনের শাহজাদা সেলিম একদিন সম্রাট হন। নাম হয় তাঁর জাহাঙ্গীর। জীবন্ত সমাধিতেই কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি আনারকলি উপাখ্যান।

পাঁচ পাঁচটি শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও নিষ্পাপ সেই কিশোরীকে ভোলেনি উপমহাদেশ। সেকারণেই হয়তো আজও মেয়ের নাম দেয় ‘আনারকলি’, বিশেষ করে মেয়েটা যদি হয় রূপবতী।

বছর কুড়ি আগে মহেশখালীর কোন এক প্রত্যন্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছিল অনিন্দ্য সুন্দর এক কন্যা শিশু। বাবামা আদর করে নাম দিয়েছিল আনারকলি। শৈশব তার মুখ থুবড়ে পড়ে। হত্যা মামলার আসামি হয়ে বাবা যায় কারাগারে। ছাড়া পায় পাঁচ বছর পর।

মুক্ত আকাশের নিচে ফিরে এসে পুরনো জীবন আর ভাল লাগেনা। স্ত্রীপরিজনকে ফেলে নতুন করে ঘর বাঁধে অন্য কোথাও। এত দুঃখের মাঝেও কৈশোরেই আনারকলি চমক দেখায়। প্রতি শ্রেণিতে প্রথম হয়ে প্রাথমিকের পাঠ সমাপ্ত করে। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। পুরস্কার হিসেবে লাভ করে বই নেয়ার ব্যাগ, যার ওপর লেখা আছে উন্নত দেশ গড়ার অঙ্গীকারের কথা। সেদিন কত গর্বিতই না হয়েছিল সবাই আনারকলিকে নিয়ে! আরও লেখাপড়া করবে, অনেক বড় হবে, দেশের জন্য কাজ করবেএমন স্বপ্ন নিশ্চয় সেও দেখেছিল।

মাত্র দু’বছরের মাথায় স্বপ্ন ভঙ্গ হয় আনারকলির। পরিবারের চাপে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। এমনি করেই আমাদের দেশে লক্ষ কিশোরীর স্বপ্নের সমাধি রচিত হয় পরিবারের হাতে। তবে পরিবারগুলো এখানে বড় অসহায়। সমাজই তাদের বাধ্য করে।

আইন যখন নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না দিয়ে দুর্ভোগকে প্রলম্বিত করে পরিবার তখন কিশোরীকে পাত্রস্থ করাটাকে শ্রেয় মনে করে। চাইলেও অদম্য মেধাবী কন্যাটিকে স্কুলে পাঠাতে পারে না। বেশীরভাগ মেয়েই হেরে যায় এই জীবন যুদ্ধে। কেউ প্রাণ দিয়ে মুক্তি পায়। অনেকে নীরবে অসম্মানের জীবন বয়ে নিয়ে যায়। ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পও শোনা যায়, তবে তা নিতান্তই হাতেগোনা ব্যতিক্রম।

সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আনারকলিরও ঘর করা হয় না। ফিরে আসে মায়ের কাছে। তবে ফেরা হয় না স্কুলে, ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগও সে পায় না। দু’দিনের জন্য পরের ঘর করতে যাওয়া আনারকলির জীবনের ছন্দপতন তাকেও হয়তো বদলে দিয়েছিল। জটিল জীবন সংসারের বেড়াজালে আটকে পড়ে কিশোরী থেকে পলকেই নারী বনে যাওয়া আনারকলির সংসার করাটাকেই জীবনের পরম সার্থকতা বলে মনে হতে থাকে। ঘর ভাঙার দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে ঊনিশ বছর বয়সে আবারও সে ঘর বাঁধে। এবার বউ হয়ে আসে জাহাঙ্গীরের ঘরে। ইতিহাসের আনারকলি জাহাঙ্গীরকে পায়নি। মহেশখালীর আনারকলি পেয়েছে। এঘর ভাঙা যাবে না। যে কোন মূল্যে এঘর সে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।

মা হয় আনারকলি। সন্তানের জন্য একটা সুস্থ জীবন চায় সে। খুনির সন্তান হিসেবে বড় হওয়ার যন্ত্রণা সে পেয়েছে। সমাজের কেনো অনাচার তার সন্তানকে স্পর্শ না করুকএখন এই তার একমাত্র চাওয়া। প্রায় তিন দশক ধরে নিরুদ্দেশে থাকা শ্বশুর হঠাৎ ফিরে আসায় আবারও ছন্দপতন হয় আনারকলির জীবনে। প্রকৃতপক্ষে ছন্দ কখনও আসেইনি ওর জীবনে। জোর করে জোড়াতালি দিয়ে একটা সুন্দর জীবন নির্মাণের জন্য কত যুদ্ধই না মেয়েটি করেছে মাত্র দুই দশকের জীবনে। সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক কলহের জের ধরে পুত্ররা হত্যা করে দীর্ঘ সাতাশ বছর পর বাড়ি ফিরে আসা পিতাকে। হত্যাযজ্ঞের উপকরণ সরবরাহ করার নির্দেশ আসে আনারকলির ওপর।

খুনের নেশায় উন্মত্ত প্রাণের মানুষ জাহাঙ্গীরের আদেশ ফেলতে পারে না সে। আজও তাকে বিশ্বাস করে। ভালোবাসে। একেমন বিশ্বাস ! কেমন ভালোবাসা!

জাহাঙ্গীর ও মোস্তাফিজ দুই ভাইয়ে মিলে বাবাকে হত্যা করার পর টুকরো টুকরো করে কি কি করেছে তার বীভৎস বর্ণনা গণমাধ্যমে এসেছে। আমরা, আমাদের সন্তানেরা অবলীলায় তা গলধঃকরণ করেছি। পৃথিবী থমকে যায়নি, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েনি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু নাড়া দিলেও তেমন একটা ঝড় ওঠেনি। বীভৎসতায় আমরা যে কতটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি এই নির্লিপ্ততা তারই সাক্ষ্য দেয়।

আবেগহীন সমাজের নির্লিপ্ততার কথা বলতে গিয়ে ‘আয়াত’ এর কথা মনে পড়ে গেল। গেল বছরের ডিসেম্বরের দিনলিপির পাতা হতে একটি অনুচ্ছেদ তুলে ধরছি

উদ্ধারকর্মীদের কর্ম তৎপরতায় আয়াতের দেহের খণ্ডিত কিছু অংশ উদ্ধার হয়েছে; প্রথমে দুটি অর্ধগলিত পা, এরপর খণ্ডিত মাথা। সাজতে বড় ভালবাসতো আয়াত। পাড়ার মক্তবে পড়তে যাবার আগে মা বড় আদর করে ক্লিপ দিয়ে চুল বেঁধে দিয়েছিলেন। মাথা গলতে শুরু করলেও ক্লিপ ছিল অক্ষত। বাবা তাই ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন তাঁর আত্মজাকে। মেয়ের মৃত্যু নিয়ে সব ধোঁয়াশা কেটে যায় অবশেষে। খণ্ডিত দেহাবশেষ নিয়েই তিনি মেয়ের জানাজা ও দাফনের আয়োজন করেন। নিজের হাতে সমাধিস্থ করেন ঘর মাতিয়ে রাখা মিষ্টি মেয়ে, বাবামায়ের প্রাণভ্রমরাটিকে। এইটুকুইতো চেয়েছিলেন তিনিমেয়েকে নিজ হাতে কবর দিতে। কর্তৃপক্ষ আলো বেগম ও সোহেল রানাকে নিরাশ করেনি। আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি পরিহিত আয়াতের ছবি সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে বলে শুনেছি। কই এখন কি আমরা ‘আয়াত’ এর কথা মনে করি? কিছুদিন আগে বন্ধুর লাশ খণ্ডবিখণ্ড করার খবরও আমরা ভাবলেশহীনভাবেই পাঠ করেছি। কারণ আমাদের কাছে মার্কিন ভিসা নীতির গুরুত্ব অনেক বেশী। আমাদের মন পড়ে আছে আহমেদাবাদে, ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসরে।

ফিরে যাই আনারকলির কাছে। পরীক্ষায় সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া সেই ‘প্রিয়’ ব্যাগটাতে করেই আনারকলিকে বহন করতে হয়েছিল পিতৃতুল্য শ্বশুরের কাটা মস্তক।

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের পাথরখণ্ডের ফাঁকে জাহাঙ্গীর বাবার মাথা ফেলে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার আশায় ব্যাগটিকেও ফেলে দিতে চেয়েছিল। আনারকলি স্বামীকে নিরস্ত করে। তার জীবনের একমাত্র সাফল্যের স্মারকটি এতোকাল আগলে রেখেছিল সে পরম মমতায়। এই ব্যাগ হাতছাড়া করতে মন তার সায় দেয়নি। অথচ কি আশ্চর্য !

দ’ুদিন ধরে চলতে থাকা হত্যাকাণ্ড ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত থেকেও শুধুমাত্র ঘর বাঁচানোর আশায়ই সে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল। সংসারটাকে টিকিয়ে রাখাই ছিল তার পরম লক্ষ, একমাত্র সাধনা।

হায় আনারকলি! যে ঘরকে আঁকড়ে থাকার জন্য, আগলে রাখার জন্য খুনের সহযোগী হয়, সে ঘরেই আর ফিরতে চায়না সে। আনারকলিই যে জাহাঙ্গীরের প্রথম প্রেম নয়, সেই রহস্যও ফাঁস হয়ে পড়ে ইত্যবসরে। একুশ শতকের বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া আনারকলি মাত্র বিশ বছরে যেন শতবছরের জীবন ধারণ করে ফেলেছে। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে তার বুদ্ধিদীপ্ত ও আত্মপ্রত্যয়ী সাক্ষাৎকার বলে দেয় জীবনসংগ্রামে তার জয়ী হওয়ার কথা ছিল। আমরা তাকে সে সুযোগ দিতে পারিনি।

অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে এখন শাস্তি মাথা পেতে নিতে চায় আনারকলি। জামিন চায় না, ক’দিন পর পর আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই বলে। যে সন্তানের মুখ চেয়ে সংসার আঁকড়ে থাকা, সে সন্তান তার মুখ দেখুকতাও সে চায় না। আবেগের বশে বিবেককে ঘুমিয়ে রাখায় এখন অনুতপ্ত কুড়ি বছরের আনারকলি। তবে আমাদের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা, আত্মস্বীকৃতি খুনিরা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্যসৃষ্টিকারীরা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারীরা, মাটিপাহাড়নদীখেকোরা কখনও অনুতপ্ত হয়না। একারণেই স্বস্তি আসে না সমাজে।

পুলিশ ও সংবাদকর্মীদের সঙ্গে আনারকলির কথোপকথন আমাদেরকে অনেক বার্তা দেয়, ঘুনে ধরা সমাজের অসংগতিগুলোকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। জনপ্রতিনিধি ও সমাজের নীতিনির্ধারকগণ তা উপলব্ধি করতে পারেন কি না, সেটাই এখন প্রধান ভাবনার বিষয়। উন্নয়নের সঙ্গে সততা ও মানবিকতার সমন্বয় না ঘটলে সকল অর্জনই যে গলার কাঁটা হয়ে বিঁধবে, সে উপলব্ধি আসুক এখনই। আনারকলি শাস্তি ভোগ করার পর নতুন জীবন শুরু করতে চায় । প্রযুক্তি ও উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশ তাকে সেই সুযোগ করে দেবে, আর তাকে পরাজিত হতে দেবে না, অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেবে নাএমন প্রত্যাশা সমাজের প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীর নিজের সচেতনতায় শান্তি আসবে
পরবর্তী নিবন্ধআয়ুব বিবি চসিক কলেজে স্কাউটিং বিষয়ে মতবিনিময়