হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বডুয়া | শনিবার , ৮ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

বিচারপতি সৈয়দ আসিফ সাকার। পাকিস্তানি নাগরিক। কিন্তু দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। বাধ্য হয়েছিলেন বাংলাদেশের পক্ষ নেয়াতে। একাত্তরে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা যখন বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা (জেনোসাইড) চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন হাতে গোনা যে ক’জন পাকিস্তানি নাগরিক তাদের অন্যতম এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আসিফ সাকার। এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানোয় তার পরিণতিও তাকে ভোগ করতে হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার তাকে ছয় মাস জেলের আইসোলেশন-সেলে রেখে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। এরপর তিনি মুক্তি পেলে চলে আসেন ইউরোপ। সুইডেনে ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। সেখানেই বিয়ে করেন সুইডিশ মহিলা আন ক্রিস্টিনাকে। স্ত্রী পেশায় আইনজ্ঞ। বিচারপতি আসিফ সাকার বয়স এখন ৭২। দেখতে সুদর্শন এই বয়সেও, মাথা ভর্তি চুল, দু-হাতের আঙুলে বেশ কটি আংটি। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, সুন্দর করে কথা বলেন। দেখে শ্রদ্ধা জাগে মনে। তবে নানা ব্যাধির কারণে শারীরিকভাবে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু মনের জোর ভীষণ। চার বোন ছয় ভাইয়ের মধ্যে ইতিমধ্যে এক ভাই ও এক বোন মারা গেছেন। লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ফিলোসফিতে মাস্টার্স করেছেন, পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির পি এইচ ডি এক্সামিনারও ছিলেন। লেখালেখি করেন প্রচুর। ইতিমধ্যে তার ১৪টি বই বেরিয়েছে। বাংলাদেশের পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলোয় এক সময় লিখতেন। ২০১২ সালে তিনি প্রথমবারের মত বাংলাদেশে যান, বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত ‘ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ’ পদক গ্রহণ করতে। গ্রহণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। সেই সফরে বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসা ও আন্তরিকতায় তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। ঢাকার বেশ কটি টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ-প্রেমিক অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতির সাথে আমার দেখা গেল-সপ্তাহে, সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায়।
জেনেভার জাতিসংঘ সদর দফতরে ৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ‘৭১-এর জেনোসাইড’ বিষয়কে ঘিরে অনুষ্ঠিত ‘সাইড-ইভেন্টে’ অন্যতম বক্তা হিসাবে যোগ দিতে আয়োজক-সংগঠন বাসুগের আমন্ত্রণে পাকিস্তানী এই বিচারপতি সুইজ্যারল্যান্ড এসেছিলেন। তার সাথে আমার পূর্ব-পরিচয় বা যোগাযোগ ছিলনা। জেনেভায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক ও মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে নিবেদিত কর্মী, খলিলুর রহমান মামুন প্রস্তাব রাখলেন জাতিসংঘের সদর দফতরে আয়োজিত এই আলোচনায় বাংলাদেশ-গণহত্যা (জেনোসাইড) এর কট্টর সমালোচক পাকিস্তানী নাগরিক এই বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানানোর। একাত্তর সালে খোদ পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে বাস করে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা করা প্রচণ্ড সাহসের প্রয়োজন। পাক সামরিক বাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিচারপতি আসিফ সাকার সেই সময় বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সে কারণে তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন এবং জেল খেটেছিলেন। একাত্তরে পাক-বাহিনীর বর্বরতার কাহিনী তার চাইতে আর কেউ ভালো বলতে পারবেন বলে মনে হলোনা। খলিলুর রহমানের প্রস্তাব সানন্দে গৃহীত হলো। ই-মেইল ও ফোনে যখন তার সাথে যোগাযোগ হয় এবং প্রস্তাব দেয়া হয়, তিনি ধন্যবাদ তো দিলেনই, পাশাপাশি বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এই আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে। সব প্রস্তুত। অনুষ্ঠানের দিন দুয়েক আগে অনুরোধ করলেন, স্টকহোম অর্ল্যান্ডো এয়ারপোর্ট এবং জেনেভা এয়ারপোর্টে যেন তার জন্যে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়। কারণ তার পক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটা কঠিন। সেই মোতাবেক ব্যবস্থা করা হলো। এয়ারপোর্টে তিনি সেই সার্ভিস পেলেন।
এয়ারপোর্টের বাইরে চলাচলের জন্যে হুইল চেয়ারের পরিবর্তে একটি ‘রোলেটর’ পাওয়া গেল। এটি পাওয়াতে বেশ উপকার হয়েছিল। জেনেভায় স্থায়ীভাবে থাকে মামাতো বোনের একমাত্র মেয়ে, রিমি। তার স্বামী সসীম তার এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে জোগাড় করেছিল এই রোলেটর। উনি জেনেভা পৌঁছানোর একদিন আগে সসীম তা হোটেলে এনে রাখে। ঠিক হলো তিনি পৌঁছুবেন ২ অক্টোবর সন্ধ্যা ছটায়। সন্ধ্যা সাতটায় ভারতীয় রেস্টুরেন্ট, ‘সাজনায়’ আমন্ত্রিত বক্তা ও অতিথিদের ডিনারের ব্যবস্থা করেছেন খলিলুর রহমান মামুন। তিনি জেনেভা রেলওয়ে স্টেশন থেকে হাঁটার দুরুত্বে অবস্থিত এই রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী। যে হোটেলে আমাদের সবার অবস্থান সেখান থেকে মিনিট চারেক হাঁটলেই এই রেস্টুরেন্টে পৌঁছা যায়। হোটেল লবিতে সবাই অপেক্ষা করছি। রওনা দেব। এমন সময় দেখি আয়োজকের পক্ষের অন্যতম কর্মী আবদুল হাই বিচারপতিকে সাথে নিয়ে হোটেল-রিসেপশনের দিকে এগুচ্ছেন। বোঝার বাকি রইলো না ইনি বিচারপতি সৈয়দ আসিফ সাকার। তার ছবি আগেই দেখেছিলাম। আবদুল হাই পেশায় সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী। বাসুগ-জার্মানির মূল চালিকা-শক্তি। ইতিমধ্যে লবিতে ডিনারে যাবার জন্যে জড়ো হয়েছেন সব বক্তা ও অতিথি। তাদের মধ্যে রয়েছেন, লন্ডন থেকে আসা বৃটিশ সাংবাদিক বন্ধু ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন ও বাসুগ ইংল্যান্ডের কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর আনসার আহমদ উল্লাহ, জার্মানি থেকে বাংলাদেশ-ব্র্যান্ড এম্বেসেডর দানিয়েল সিডল, বেলজিয়াম থেকে অধ্যাপক প্রফেসর ড. তাজিন মুর্শিদ ও তার ডাচ স্বামী প্রফেসর ড. উইলিয়াম ফান দের খেইস্ট। এগিয়ে যাই রিসেপশনের দিকে। আমাকে দেখে বিচারপতি চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরলেন। খেয়াল করি এয়ারপোর্ট থেকে টেক্সীতে এলেও তিনি শরীরের কারণে হাঁফিয়ে উঠেছেন। বললেন, ‘আমাকে দশ মিনিট সময় দাও। রুমে গিয়ে আমি ফিরে আসছি।’ বলি, ‘তাড়া নেই। ধীরে-সুস্থে ফ্রেশ হয়ে আসুন।’ দশ মিনিটের আগেই লিফট বেয়ে তিনি নেমে এলেন। সবাই হেঁটে এগিয়ে যাই রেস্টুরেন্টের দিকে। টের পাই তার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তিনি কিছুতেই স্বীকার তা করলেন না। আমার ধারণা ছিলনা তার এমন শারীরিক দশা। লন্ডন থেকে আসা আনসার আহমদ উল্লাহ বলেন, তাকে কয়েক বছর আগে সুইডেনে সেক্যুলার ফোরামের অনুষ্ঠানে যখন দেখি তখন বেশ শক্ত-সবল ছিলেন। এখন অনেক ভেঙে পড়েছেন।
পরদিন অনুষ্ঠান শেষ করেই তিনি জাতিসংঘ ভবন থেকে সরাসরি এয়ারপোর্ট চলে যাবেন। অনুষ্ঠান শেষ হবে বিকেল পাঁচটায়, ফ্লাইট রাত আটটায়। বারবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন সময়মত তিনি যেন এয়ারপোর্ট পৌঁছুতে পারেন তা যেন নিশ্চিত করি। কেননা পরদিন স্টকহোমে ডাক্তারের সাথে তার জরুরি এপয়েন্টমেন্ট যা কোনভাবেই বাতিল বা স্থগিত করা যাবে না। ফিরে যাবার পরদিন তাকে ফোন করলে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেন, এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন, আগামীকাল তার অপারেশন। জানতে চাইলাম এটি কি হঠাৎ? বললেন, না। অবাক হলাম তার মনোবল দেখে। অনুষ্ঠানের পরদিন তার অপারেশন। সেটি জেনেও তিনি সুইডেন থেকে সুইজারল্যান্ড এসেছেন সকল ধকল সহ্য করে। আমি কিংবা আমার মত অনেকেই এই সাহসটি করতাম না। আর উনি সত্তর পেরিয়ে এই সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। ভাবি সাহসী তো বটেই, তা না হলে একাত্তরে যখন হানাদার পাক বাহিনী বাংলাদেশ হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল তখন পাকিস্তানে বসেই তিনি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মত সাহস রেখেছিলেন কী করে। বাংলাদেশের প্রতি যে তার গভীর ভালোবাসা তার প্রতিটি কথায় টের পাই। বয়োবৃদ্ধ এই পাকিস্তানি কবিও। তার লেখা পাঞ্জাবি কবিতার জন্য তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। সুইডিশ ভাষায় অতি দক্ষ এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুইডিশ ভাষায় এক গুচ্ছ কবিতাও প্রকাশ করেন। এই বিষয়গুলি তার লেখা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বই, ‘প্যান্ডোরা বঙ’-এর মুখবন্ধে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফি বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. নাঈম আহমদ উল্লেখ করেন। তার লেখা আর একটি বই, তাও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত, ‘ফরবিডেন ওয়ার্ডস’-এর মুখবন্ধে প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, ‘তাকে (প্রাক্তন বিচারপতি সৈয়দ আসিফ সাকার) আমি চিনি তিন দশক ধরে এবং নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, কোন ভয়ভীতি ছাড়াই যা সঠিক তা বলার জন্য তার আবেগ এবং সাহস রয়েছে। যে অকপটতা এবং সাহসের সাথে তিনি লিখেছেন তা কেবল পাঞ্জাবিদের মধ্যেই নয়, অন্যান্য সমপ্রদায়ের মাঝেও ভালবাসা, প্রশংসা কুড়িয়েছে।’ যাবার আগে বই দুটিতে অটোগ্রাফ দিয়ে তিনি আমার হাতে গছিয়ে দেন।
পাকিস্তানি এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বাংলাদেশ-প্রেমিক। বাংলাদেশে আমাদের অনেকে যখন প্রকৃত অর্থে হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করি না, হাত মেলাই দেশের শত্রুর সাথে, তখন বাংলাদেশ থেকে হাজারো মাইল দূরের দেশ, পাকিস্তানে জন্ম নেয়া এই ব্যক্তিটি বাংলাদেশকে তার হৃদয়ে ধারণ করেছেন। বাংলাদেশকে ভালোবেসেছেন। ভালোবেসেছেন বলেই মৃত্যুর পর বাংলাদেশে যেন তার কবর দেয়া হয়- এই আকুতিভরা আবেদন জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে। সেই চিঠির কপি তিনি আমাকে জেনেভা এসে পৌঁছানোর আগে ই-মেইলে পাঠিয়েছেন। এখনো কোন উত্তর পাননি বলে আক্ষেপ করে বিনীত অনুরোধ জানালেন এই নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে যেন লেখালেখি করি। এই নিয়ে পরবর্তী সংখ্যায় লেখার ইচ্ছে রইলো। (চলবে)

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ব লায়ন্স সেবা দিবস ২০২২ অন্তহীন ভালোবাসায় সেবা
পরবর্তী নিবন্ধইভিএম ভোটাধিকার সুরক্ষার অন্যতম পন্থা