বিশ্ব লায়ন্স সেবা দিবস ২০২২ অন্তহীন ভালোবাসায় সেবা

ডা. এম. জাকিরুল ইসলাম | শনিবার , ৮ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাব বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেবা সংগঠন। এক সময় বলা হত বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্তমিত হয় না। বর্তমানে লায়নরা গর্বের সাথে উচ্চারণ করেন ‘লায়ন সাম্রাজ্যে সূর্য অন্তমিত হয় না’। তার কারণ পৃথিবীতে লায়নইজম এত বেশি বিস্তার লাভ করেছে যে, প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সেবা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। পৃথিবীতে এক গোলার্ধে যখন দিন অপর গোলার্ধে তখন রাত অর্থাৎ দিন রাত প্রতিটি মুহূর্তে পৃথিবীতে লায়ন্স এর মাধ্যমে সেবা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
আমেরিকার শিকাগো শহরের মানব হিতৈষী এক বীমা কর্মকর্তা মি. মেলভিন জোন্স এর উদ্যোগে অসামপ্রদায়িক এবং অরাজনৈতিক যেই সেবা সংগঠন যাত্রা শুরু করেছিল, তা হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেবা সংগঠন আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাব। বর্তমান এ বিশ্বের ২১৪টি দেশে ৪৮৫২৯ টি ক্লাব ৮৮৪ টি লায়ন্স জেলার আওতাভূক্ত হয়ে প্রতিনিয়ত মানব কল্যাণমূলক সেবা কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন। বিশ্বের প্রায় ১৪ লক্ষ, লায়ন সদস্য- সদস্যা পৃথিবীর কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো সময়ে মানব কল্যাণে সেবা কর্ম পরিচালনা করে চলেছেন। লায়ন পরিবারের সদস্যরা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যে সেবামূলক কাজগুলি সম্পাদন করে থাকেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অন্ধত্ব নিবারণ। বিশ্বখ্যাত সমাজ সেবী হলেন কেলারের আহ্বানে লায়নরা সারা বিশ্বে ১৯২৫ সাল থেকে এই কার্যক্রম সফল বাস্তবায়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
উদ্দেশ্যাবলী

পৃথিবীর মানুষে মানুষে সমঝোতার মনোভাব সৃষ্টি ও লালন। সৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সুনাগরিকত্বের আদর্শের বিকাশ সাধন। জনগণের নাগরিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নৈতিক উন্নতি বিধানে সক্রিয় আগ্রহ প্রদর্শন। লায়ন্স ক্লাবসমূহকে সুসম্পর্ক, সমপ্রীতি ও সমঝোতার বন্ধনে একত্রিত করা। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের মুক্ত আলোচনার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। তবে ক্লাব সদস্যগণ দলীয় রাজনীতি ও সমপ্রদায়ভুক্ত ধর্র্মীয় বিষয় নিয়ে বিতর্কে জড়িত হবেন না। সেবাব্রতী লোকদের ব্যক্তিগত আর্থিক লাভের বিবেচনা ব্যতিরেকে সমাজ সেবায় উৎসাহ প্রদান করা এবং ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প, বৃত্তি জীবন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াকর্ম ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে দক্ষতার উন্নয়ন ও উচ্চ নৈতিক আদর্শের বিকাশ।
বিশ্বের মাঝে লায়ন ইজম

১৯১৭ সালের ৭ই জুন আমেরিকার শিকাগো শহরের বীমা কর্মকর্তা স্যার মেলভীন জোন্স এর নেতৃত্বে অরাজনৈতিক ও অসমপ্রদায়িক সেবা সংগঠন লায়ন্স ক্লাবস্‌ ইন্টারন্যাশনাল এর জন্ম হয়। ১৯১৭ সালের ৮ই অক্টোবর লায়নবাদের উদ্দেশ্যাবলী, নীতিমালা ঘোষণার মাধ্যমে ২২টি ক্লাবের সমন্বয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক লায়ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল শিকাগো শহরের লাসিলি হোটেলে। সেই সম্মেলনে ৯টি অঙ্গরাজ্যে থেকে ২২টি ক্লাবের ৩৬জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে এই ৮ই অক্টোবর সারা বিশ্বের লায়ন সেবা দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। আজ থেকে সুদীর্ঘ ১০৫ বছর পূর্বে লায়নিজম নামে সে সেবার বীজ বপন করা হয়েছিল, কালের পরিক্রমায় সেই বীজ থেকে চারা অঙ্কুরিত হয়ে বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ১৯১৭ সালে ৮ই অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ড. উইলিয়াম- পি উডস্‌ – প্রেসিডেন্ট এবং স্যার মেলভীন জোন্স কার্যকরী সচিব নির্বাচিত হন। ১৯২৫ সালের লায়ন্স ইন্টারন্যশনাল কনভেনশানে বিশ্বখ্যাত সমাজসেবী হেলেন কেলার যোগদান করেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে লায়ন সদস্যরা সারা বিশ্বের অন্ধত্ব নিবারণে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
১৯৫০ সালের মধ্যভাগে লায়ন্সক্লাব ইউরোপ, এশিয়া ল্যাট্রিন আমেরিকা আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তার লাভ করে। আন্তর্জাতিক সদর দপ্তরটি আমেরিকার ইলয়নয়েস অঙ্গরাজ্যের অর্কর্রুতে অবস্থিত।
লায়ন্স জেলা ৩১৫-বি-৪ বাংলাদেশ

লায়ন্স জেলা ৩১৫-বি-৪ এর এই সেবা বর্ষে ২০২২-২৩ সালে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী সদা হাস্যময়ী ভালোবাসার প্রতীক লায়ন শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ সিদ্দিকী -পি.এম.জে.এফ (সেকেন্ড সেঞ্চুরী এমবেসেডর)। উনাকে সহযোগিতা করছেন সদ্য প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন আল-সাদাত দোভাষ- পি.এম.জে.এফ, ১ম ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন- এম.ডি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী – এম.জে.এফ ও ২য় ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন কহিনুর কামাল – এম.জে.এফ। কেবিনেট সেক্রেটারির দায়িত্ব সূচারুরূপে পালন করছেন লায়ন হাসান মাহমুদ চৌধুরী ও কেবিনেট ট্রেজারার লায়ন পারভীন মাহমুদ -এম.জে.এফ, এফ.সি.এ। এই লায়ন্স জেলার অধীনে ৮৫টি ক্লাব ও দুই হাজার ছয়শত লায়ন সদস্য দুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে সদা ব্যস্ত। লায়ন্স জেলার কার্যক্রমকে বেগবান করতে স্বতন্ত্র লিও জেলা ৩১৫-বি-৪ এর অধীনে ৪৯টি লিও ক্লাবের দুই হাজারের অধিক লিও সদস্য সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে মাল্টিপল জেলা ৩১৫-বি-৪ এর অধীনে ৭টি লায়ন্স জেলায় ৭১৮টি লায়ন্স ক্লাবের মাধ্যমে বিশ হাজারের অধিক লায়ন সদস্য সর্বদা সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছেন।
অন্তহীন ভালোবাসায় সেবা

আমরা লায়ন সদস্যরা জীবনের অর্ঘ্য সাজাই আশার কুসুমে, স্বপ্নের বুননিতে গড়ি অনাগত জীবনের নকশীকাঁথা। বিগত দিনের জীর্ণতার নাগপাশ ছিন্ন করে অনাগত দিনের রক্তিম সূর্যের উষ্ণ আলিঙ্গনে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিকূলতা অক্টোপাসের মত সহস্র বেষ্টনীতে ঘিরে আছে আমাদের সমাজকে। আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় হউক মাদকমুক্ত ও সন্ত্রাসমুক্ত যুব সমাজ প্রতিষ্ঠা করে ফুলের মত সুভাসিত জীবন গড়ি। গভীর ধ্বংস স্তুপের মাঝে দাঁড়িয়েও আমরা নির্মাণের কঠিন শপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সকল আঁধার সরিয়ে আলোকিত ঝর্নাধারার ধুঁইয়ে দিয়ে শান্তির নীলাকাশ প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে লায়নদের। সকল ভালোর প্রতি উদাত্ত আহ্বান আর অসুন্দরের প্রতি ক্ষমাহীন সংগ্রাম আমাদের। মনে রাখতে হবে এই বিশ্বে যা কিছু ভালো তা বিশ্বের সকল মানুষের অধিকার। এই অধিকার আদায়ের নাম হোক লায়নিজম। আমরা এমন একটি দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন স্বপ্নের পাখিরা নীড় খুঁজে পাবে, চিকিৎসাহীন মৃত্যু করবে না যখন উপহাস, দুস্থের মুখে হাসি আর অন্ধের চোখে আলো সেদিন থাকবে নিশ্চিত। আত্ম সচেতন ব্যক্তি ও জাতিই পারে বিশ্বের মাঝে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। এই জন্য যে উপকরণের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে নেতৃত্ব, অভিজ্ঞতা, মহতী উদ্যোগ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা। আমাদের একান্ত বিশ্বাস বাংলাদেশের লায়নরা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বের মানচিত্রে স্থায়ীরূপ দিতে সক্ষম হবেন। আমাদের লায়ন ভাই- বোনেরা সুশিক্ষা গ্রহণ, সৎচরিত্র গঠন ও আত্ম মানবতার সেবায় অংশ গ্রহণ করে আগামী দিনের আলোকিত মানুষ হিসাবে নিজেদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন।
সম্মানিত জেলা গভর্নর লায়ন শেখ সামশুদ্দিন আহমেদ সিদ্দিকী- পি.এম.জে.এফ ডাক ‘অন্তহীন ভালোবাসায় সেবা’ একটি যুগোপযোগী ও ঐতিহাসিক ডাক। ভয়াবহ কোভিড-১৯ এর মহামারীর করাল গ্লাসে নিমজ্জিত যখন সারা বিশ্ব মানুষের জীবন ও জীবিকা যেখানে অনিশ্চিত তখন অসহায় ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অভিপ্রায়ে তিনি এই ডাক দিয়েছেন। আসল ভালোবাসা এমন একটি মারণন্ত্র যা দিয়ে মানুষকে, জীবনকেও বিশ্বকে জয় করা যায়। অন্তহীন ভালোবাসায় সেবা করতে পারলে আমরা যেমন মানুষকে শুধু নয় প্রকৃতির মাঝে সবাইকে ভালোবাসার অমোঘ টানে জয় করতে পারবো। ভালোবাসা দিয়ে যেমন মানুষের অন্তর জয় করা যায়, তেমনি বিবদমান শত্রুতা -যুদ্ধবিগ্রহও জয় করা যায়। তাই আসুন আমরা সকলে মিলে মাননীয় জেলা গভর্নর এর যুগান্তকারী ডাক ‘অন্তহীন ভালোবাসায় সেবা’ দিয়ে অসহায় বিপন্ন পৃখিবীতে শান্তির নীড় গড়ে তুলি।

লেখক : চিকিৎসক, সমাজকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোনো হিংসা-রেষারেষি নয় সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থান চাই
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে