হল্যান্ড থেকে

(সুইজারল্যান্ডের চিঠি)

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সফল সম্মেলন (২)

সম্মেলন হবে ৩০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু একটু আগ বাড়িয়ে যেতে হলো। সম্মেলনের দু’দিন আগেই আকাশ পথে রওনা দেই জেনেভার উদ্দেশ্যে। কারো কারো ধারণা জেনেভা সুইজারল্যান্ডের রাজধানী। অনেকে তাই জানে বা মনে করেন। আসলে তা নয়। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত নগরী, বার্ন হলো অতি ধনী ইউরোপীয় দেশ সুইজারল্যান্ডের রাজধানী। আয়োজক হিসাবে বাড়তি কাজ, গুরু দায়িত্ব মাথার উপর। খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণে সবকিছু যতটা সম্ভব পারফেক্ট হওয়া চাই। আর সে কারণে ২৮ সেপ্টেম্বর সকাল সোয়া এগারটা নাগাদ কে এল এমের ফ্লাইটে পৌঁছে যাই জেনেভা এয়ারপোর্টে। অনুষ্ঠানের কারণে মাস দেড়েকের কম সময়ের ব্যবধানে এর আগে আরো একবার আসতে হয়েছিল। দিনটি ছিল ১৭ আগস্ট ২০২১। সেবার আমি একা, এবার সঙ্গী, সুমনা। গন্তব্যস্থল এক হলেও সঙ্গীর উদ্দেশ্যে ভিন্ন। তার লক্ষ্য সম্মেলন শেষে সুইজারল্যান্ড ঘুরে বেড়ানো। এমন নয় যে এর আগে সে এদেশে আসেনি। কম করে হলেও বার পাঁচেক তো তার আসা হয়েছে। তারপরও দেখার কী শেষ আছে। মানুষের চাওয়া-পাওয়া বা ইচ্ছের যেমন কোন সীমা-পরিসীমা নেই, তেমনি দেখার, জানারও শেষ নেই, যদিও বা এই জীবনের এক পর্যায়ে ‘দি এন্ড’ লিখে রেখেছেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের, কবি নজরুলের ভাষায় এক অদৃশ্যমান ‘বিরাট শিশু’, যিনি এই বিশ্ব নিয়ে খেলছেন। “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে/ প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে।” ঠিক হলো অনুষ্ঠান শেষে পরদিন জেনেভা ছেড়ে ভিন্ন কোন অদেখা শহরের দিকে যাবো। স্থান নির্বাচন, কীভাবে যাব, কোন বাহনে, হোটেল বুকিং সব তার একার দায়িত্বে। সম্মেলনের কারণে সে দিকে সময় দেবার সময় আমার ছিলনা। সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাড়াও জার্মানি, হল্যান্ড, ফিনল্যাণ্ড, বৃটেন, বেলজিয়াম থেকে বক্তা, অংশগ্রহণকারীরা আসবেন। বক্তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়াও অনুষ্ঠানের তাবদ প্রক্রিয়া সুষ্ঠু হওয়া চাই। ‘করোনার’ কারণে উপস্থিত থাকতে পারছেন না ইতালীয় বংশোদ্ভূত ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ব্রান্ডো বেনিফেই ও বৃটিশ এমপি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুশানারা আলী। ব্রান্ডো বেনিফেই তার বক্তব্য আগেভাগে ভিডিও-রেকর্ড করে পাঠালেন, অন্যদিকে সম্মেলন চলাকালীন এক পর্যায়ে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিলেন সফল এই বাংলাদেশি-বৃটিশ রাজনীতিবিদ রুশানারা আলী। এই দুজন ছাড়া আরো যারা সশরীরে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তা হিসাবে যোগ দিতে জেনেভা এসেছিলেন তারা হলেন, হল্যান্ড থেকে প্রাক্তন ডাচ এমপি হেরি ফান বোমেল, আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এন্থনি হোলস্ল্যাগ, তুরস্কে ডাচ দৈনিক পত্রিকা দ্য ফলকস্ক্রান্তের স্থায়ী প্রতিনিধি রব ফ্রেইকেন, জার্মান ডয়েসে ভেলের এশীয় প্রোগ্রামের পরিচালক, অন্ত্যন্ত সফল বাঙালি রমণী দেবরতি গুহ, ঢাকা থেকে আসা শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর এবং সুইজারল্যান্ডে বসবাসরত নির্বাসিত কাশ্মীরি নেতা সর্দার শওকত আলী কাশ্মীরি। এসেছেন ফিনল্যান্ড থেকে ড. মুজিবর দপ্তরি ও বৃটেন থেকে আনসার আহমদ উল্লাহ। বক্তা হিসাবে আসার কথা ছিল লন্ডন থেকে ড. রায়হান রশিদও। কিন্তু লন্ডন এয়ারপোর্টে এসেও ‘করোনা-অনুমতি’ জটিলতায় পড়ে তাকে ঘরে ফিরে যেতে হয়। যে বিষয়ে এই মহাযজ্ঞের আয়োজন তা হলো, ‘বাংলাদেশে ১৯৭১ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’। আয়োজক ইউরোপীয় বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সংগঠন, ইউরোপীয়ান বাংলাদেশ ফোরাম বা সংক্ষেপে ই বি এফ। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, জেনেভার জাতিসংঘ ভবন ও লন্ডনের হাউস অব কমন্সসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সংস্থাটি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। সংগঠনটির অন্যতম আয়োজক হিসাবে আমার এই দৌড়াদৌড়ি ও ব্যস্ততা।
জেনেভা এয়ারপোর্ট নেমেই ফোন করি জেনেভা প্রেস ক্লাবের সমন্বয়কারী সুইস তরুণ, তোবিয়াস ক্লার্ককে। আগেই দিন ও সময় নির্দিষ্ট ছিল। বললাম দুপুর দুটোয় ক্লাবে আসছি। এর আগে ভোর সকালে হল্যান্ডে বাসা ত্যাগ। কে এল এমের ফার্স্ট ফ্লাইটে আমাদের উড়াল দিতে হবে। হ্যান্ড ব্যাগ ছাড়াও একটি লাগেজ ব্যাগ ছিল, তাতে মূলত সম্মেলনের সামগ্রী, বক্তাদের জন্যে কেনা গিফটস ইত্যাদি। আগেই ফোনে টেঙি বুকড করা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে। আমরাও প্রস্তুত। সাধারণরত যে রাস্তা ধরে শিফল বিমানবন্দরের দিকে যাবার কথা সেদিক না ধরে, দেখি টেঙিওয়ালা ভিন্ন পথ ধরলো। বলে, ওই পথে ট্র্যাফিক জ্যাম। মিনিট চল্লিশেকের মাথায় পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্ট।
এয়ারপোর্ট নেমে অপেক্ষা করছি লাগেজ বেল্টের সামনে। ক্ষণিক বাদে এলো আমাদের লাল রঙের বড় লাগেজ। এয়ারপোর্টের ভেতর থেকে বেরোনের আগে দরোজার মুখে দুটো মেশিন। তার একটিতে বোতাম টিপ দিতেই বেরিয়ে আসে ছোট্ট কাগজের টিকেট। বিনে-পয়সায় এই টিকেট দিয়ে আপনি ঘন্টা খানেক সময় ব্যবহার করতে পারবেন। এই টিকেট নিয়ে আপনি এয়ারপোর্ট থেকে বাস, ট্রেন ধরে জেনেভা শহরের দিকে যেতে পারবেন। বাড়তি কোন টিকেট লাগবে না। বিমান যাত্রীদের জন্যে এমন সুযোগ আর কোন এয়ারপোর্টে দেখিনি। আর কোন দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। কেবল তাই নয়, আপনি হোটেলে চেক-ইন করলে, আপনার হাতে ধরিয়ে দেবে ওই শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে, অর্থাৎ বাস, ট্রাম ইত্যাদি, যে কদিন হোটেলে অবস্থান করবেন সে ক’দিন বিনে-পয়সায় গোটা জেনেভায় যতখুশি তত ঘুরতে পারার জন্যে একটি কার্ড। কী দারুণ ব্যবস্থা। অনেক দেশে যাবার সুযোগ হয়েছে আমার, এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা। কোথায়ও এমন ব্যবস্থাটি দেখিনি। জেনেভা এয়ারপোর্ট ছেড়ে পরের রেল স্টেশন জেনেভা সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন। মিনিট পাঁচেক হাঁটার দূরত্বে আমাদের হোটেল, হোটেল ক্রিস্টাল। আট তলা হোটেলটি আমার প্রিয় ও পছন্দের। এই কারণে এটি একেবারে শহরের মধ্যিখানে। যাতায়াতের এমন সুবিধা আর কোথায় মেলে! পরিপাটি, ব্রেকফাস্টের চমৎকার ব্যবস্থা, লিফটের আট তলায়, বলা যায় রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একদিকে পুরো কাচ দিয়ে ঘেরা। গোটা শহরের অনেকটা দেখা যায়। ভালো লাগে। নানা পদের সকালের নাস্তা। ডিম থেমে শুরু করে দুধ, পনীর, নান ফলমূল, জুস্‌, নানা কিসিমের ব্রেড, জেলি, চা কফি ইত্যাদি ইত্যাদি। তালিকার শেষ নেই যেন। যা খুশি, যত খুশি, সকাল ৭টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত খেলেও আপনাকে কেউ কিছু বলবে না। অনেকের সকালে কেবল এক কাপ কফি বা চা খাওয়ার অভ্যেস। তা কেউ যদি এক কাপ চাও খায় তাকেও দিতে হবে সম পরিমান ইউরো বা সুইস ফ্রাঙ্ক। সুইজারল্যান্ডে সুইস ফ্রাঙ্ক চলন থাকলেও সব জায়গায়, শপিং মল থেকে শুরু করে কেনা-কাটা, রেস্তোরায় ইউরো চলে। ফলে আমরা যারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ থেকে আসা আমাদের জন্যে সুবিধে। হিসাবের জন্যেও সুবিধে- কেননা এক ইউরো সমান এক সুইস ফ্রাঙ্ক।
হোটেলে চেক ইন করে লিফট ধরে এগিয়ে যাই ছয় তলায়। সেখানে আমাদের কামরা। সুন্দর ডাবল-বেডের কামরা, পরিপাটি করে গুছানো। ঢুকতেই টয়লেট, শাওয়ার, টেলিভিশন, মিনি ফ্রিজ ইত্যাদি। এই হোটেল পছন্দের আর একটি অন্যতম কারণ হলো, এর একেবারে কাছে, রাস্তা পেরোলেই বাংলাদেশী মালিকানায় রয়েছে সুন্দর মাঝারি আকারের একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁ। নাম ‘সাজনা’। এর স্বত্বাধিকারী বাংলাদেশে-প্রেমিক মানবাধিকার কর্মী খলিলুর রহমান। জেনেভার বাঙালি সমাজে অতি পরিচিত মুখ। দেশীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। নানা কাজে দেশ থেকে জেনেভায় প্রায়শ মন্ত্রীরা, আসেন সরকারি আমলারা, কখনো-সখনো প্রধান মন্ত্রীও। এলেই ডাক পরে খলিলুর রহমানের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছর কয়েক আগে একবার এসেছিলেন ডাভোসে, পরিবেশ সম্মেলনে। সাথে বিরাট দল। খলিলুর রহমানের ডাক পড়লো। প্রধানমন্ত্রীর খাওয়া-দাওয়ার জন্যে তাকে (খলিলুর রহমান) তার কর্মচারী বহর নিয়ে যেতে হয়েছিল ডাভোসে। সেবার বেশ কদিন জেনেভা থেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজনীতি ছাড়াও খলিলুর রহমান সুইজারল্যান্ড সেক্যুলার ফোরামের প্রধান। সে কারণেও তার ব্যস্ততা। বন্ধুবৎসল খলিলুর রহমানের স্ত্রী সাজিয়া, ভীষণ কর্মঠ এক মহিলা। অনেককে বলতে শুনেছি সাজিয়া যদি না থাকতেন তাহলে খলিলুর রহমান এই রেস্তোরা চালাতে পারতেন না। কথাটি যে কতটুকু সত্যি সে নিজ চোখে দেখা। কেননা খলিলুর রহমান রাজনীতি ও সামাজিক কারণে এতো ব্যস্ত থাকেন যে অনেক সময় তিনি রেস্তোরাঁর জন্যে পুরো সময় দিতে পারেন না। অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার পেছনে জেনেভায় যে সমস্ত উদ্যোগ নেয়া হয় তার অন্যতম উদ্যোগী উনি। হোটেলে চেক-ইন সেরে আমরা হেঁটে এগিয়ে যাই ‘সাজনার’ দিকে। (চলবে)

লেখক : কলামিস্ট, সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধট্যানারির বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে করতে হবে বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশবান্ধব
পরবর্তী নিবন্ধধর্মান্ধ-ধার্মিকতার মুখ ও মুখোশ