হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

প্রবাসীর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ : এলোমেলো ভাবনা

আমার পরিচিতজনদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন এই বলে যে আমার লেখালেখিতে নাকি চাটগাঁকে নিয়ে মাঝে মধ্যে বাড়াবাড়ি হয়। আমার লেখায় চট্টগ্রামপ্রীতি একটু বেশি বেশি। যেন চট্টগ্রামই বাংলাদেশের প্রাণ ভোমরা। অভিযোগ যদি সত্যি হতো তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু চট্টগ্রাম যে বড্ড অবহেলিত তা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন। ঢাকার উত্তরায় ছোট বোন মনিকার বাসায় টেবিলভর্তি নানা দেশি পদের খাবার খেয়ে ও আড্ডা দিয়ে গতকাল অনেক রাতে যখন ভাইপো ঋত্বিকের গাড়িতে কাছেই তার বাসায় (উত্তরা চার নম্বর সেক্টর) ফিরছিলাম, তখন চারপাশ দেখে খুব খারাপ লাগছিলো এই ভেবে, চাটগাঁ কত অবহেলিত। ঢাকায় পথ চলতে চোখে যে সুদৃশ্য ভবন, রাস্তাঘাট চোখে পড়ে তার ছিটেফোঁটাও আমার জন্মস্থান চট্টগ্রামের কোথায়ও চোখে পড়েনি। এর আগে সন্ধ্যেয় চাটগাঁ থেকে ফিরে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে উত্তরার বাসায় যাবার পথে গাড়ির ভেতর থেকে বাইরে দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে দুপাশ দেখছিলাম আর মনে মনে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম চট্টগ্রামে এমন দৃশ্যপট। না কোথাও খুঁজে পেলাম না। চারিদিকে ঘিঞ্জি, পরিকল্পনাহীন সড়ক, সড়কের পাশেই ময়লার ডিপো যা কোন সভ্য শহরে দেখা যায় না। রাস্তার উপর ভ্যানে নানা ধরনের সবজি ফল নিয়ে হাট। আগে কেবল ছিল রেয়াজউদ্দিন বাজার এবং আরো কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে। এখন বাজার সব জায়গায়। গোটা শহর জুড়ে। ঢাকার কেবল একটি সমস্যা, সেটি হলো তীব্র ও অসহনীয় যানজট। তা না হলে ঢাকা হতে পারতো সত্যিকার অর্থে ‘তিলোত্তমা’। ঢাকাকে যদি বলি ‘তিলোত্তমা’ তাহলে চট্টগ্রামকে বলতে হয় ‘অবহেলিত চট্টগ্রাম’। কোন এক সময় ‘রূপসী’ ছিল। এখন বিগতযৌবনা। মানুষের শারীরিক সৌন্দর্য্যে যখন ‘ভাটা’ নামে তখন তাতে কিছুটা জোয়ার আনার জন্যে মাজাঘষা চলে। চট্টগ্রামের সৌন্দর্য্যে যে ভাটা পড়েছে তাতে প্রলেপ দেয়ার কেউ বোধকরি নেই। নগরীর পিতা বলে একজন আছেন। যদ্দুর জানি নগরীর দেখভাল, তার সৌন্দর্য্য রক্ষা করা, শহরের ভেতরের রাস্তার কথা বাদই দিলাম, বড় বড় রাস্তাগুলির পাশে (আলমাস সিনেমা হল এলাকা অন্যতম) গোটা দিন জমে থাকা নোংরা ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করার দায়িত্ব তার। শহরের বিভিন্ন স্থানে ফুটপাতরাস্তা দখল করে ভ্যানগাড়িতে শাকসবজি বিক্রি করা আর কোন দেশে চোখে পড়েনি। চোখে পড়ে কেবল বাংলাদেশে এবং ঢাকায়ও প্রধান প্রধান এলাকায় তেমনটি চোখে পড়েনা। চেরাগী পাহাড়, জামালখান, লালখানবাজার, চকবাজার, জিইসি মোড় যেখানেই গেছি সেখানে এই দৃশ্য চোখে পড়েছে। অর্থবানদের এলাকা হিসাবে পরিচিত খুলশী এলাকায় ঢুকতে গিয়ে (গার্লস কলেজ এলাকা) যে দৃশ্য তা খুব একটা ভিন্ন নয়। অথচ এমনটি হবার কথা ছিল না। চট্টগ্রাম হবার কথা ছিল সত্যিকার অর্থে ‘রূপসী চট্টগ্রাম’। কেননা বাংলাদেশের মোট জিডিপির শতকরা ১২% আসে চট্টগ্রাম থেকে, যার মধ্যে রয়েছে শিল্প উৎপাদনের ৪০% এবং কর রাজস্বের৫০%। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের প্রাচীনতম এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ত বন্দর। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বৃহত্তম ঘাঁটি। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের প্রধান ঘাঁটি। প্রায় ৭০০টির বেশি তালিকাভুক্ত কোম্পানি সহ চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ হলো বাংলাদেশের টুইন স্টক মার্কেটগুলির একটি। চা শিল্পে চট্টগ্রামের রয়েছে চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। এই তালিকা আরো দীর্ঘ হবে। কিন্তু চাটগাঁ শহরে চলতে গেলে দেখে মনে হয়না এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে এই নগরীতে। কেউ কেউ বলবেন, কর্ণফুলী টানেল হচ্ছে, অনেক ফ্লাইওভার হয়েছে, হচ্ছে, আকারে সড়ক বড় হচ্ছে, হয়েছে। কোনটাই অস্বীকার করিনে। কিন্তু শহরে পথ চলতে মনে হয় অব্যবস্থাপনার একটি নগরীতে আছি। মনে হয় এই শহর দেখভালের কেউ নেই। মনে হয় এই শহরের কোন অভিভাবক নেই।

অন্যদিকে মহান বিজয় মাসকে ঘিরে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয় মেলা। স্টেডিয়ামকে ঘিরে চলছে এই মেলা। এই এলাকা হয়ে প্রায় প্রতিদিন আমাকে যেতে হয়েছে শহরের বিভিন্ন স্থানে, প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। গাড়ির ড্রাইভার, সিএনজি ড্রাইভার সবাই ত্যক্তবিরক্ত। গোটা স্টেডিয়াম এলাকায় মেলার কারণে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থে ‘যানজটদুর্যোগ’। হাতেগোনা যে কয়েক ট্রাফিক পুলিশ আছেন তাদের দেখে কষ্ট হয়, মায়াও। এই ট্রাফিক ‘কন্ট্রোল’ করা খোদ উপরওয়ালার পক্ষেও বোধকরি সম্ভব নয়। যাই হোক, ফিরে যাই যেখান থেকে এই লেখার শুরু।

এই লেখার শুরু গতকাল। চাটগাঁ বিমান বন্দরে বসে। সেটি যোগ দিলাম এর সাথে। চাটগাঁকে পিছু রেখে ঢাকার পথে চলেছি, দিন কয়েকের জন্যে। গিন্নী ফিরে যাবে হল্যান্ড, তার কাজের চাপ। ফিরে না গেলেই নয়। কিন্তু তার মন পড়ে আছে চাটগাঁয়। সে টের পায়। প্লেন ছাড়ার ঘন্টা দেড়েক আগে এয়ারপোর্টে চলে এসেছি। সেই ফাঁকে ল্যাপটপ খুলে লিখতে বসা। বলা চলে সময়ের সদ্ব্যবহার। অথচ একটা সময়, যখন ‘সময়’ ছিল অফুরান, অফুরন্ত তখন কত সময় যে কতভাবে নষ্ট করেছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। এখন যখন পিছু ফিরে তাকাই তখন আফসোস হয় বৈকি। কিন্তু সময় তো আর আমার জন্যে ফিরে আসবে না। সময় যে কারো জন্যে ফিরে আসার নয়। এ যেন বহতা নদী, তার কেবলি সামনের দিকে চলা, পেছনের দিকে নয়। এয়ারপোর্টে বেশ আগ বাড়িয়ে আসায় সুমনা কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করলে বলি, এখানে চলে আসায় অন্তত আমার এই লেখাটার অনেকটা লেখা হবে। তোমারও কিছুটা রেস্ট হবে। কেননা বাসায় থাকলে তো তোমার বিরামহীন, লাগাতার কাজ। ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, সুমনাও ঠিক তাই। দেশে বেড়াতে এসেও বিরামহীন কাজ করে। এয়ারপোর্টে লেপটপ কোলে নিয়ে বসেছি মাত্র। পাশে বসা এক যাত্রী ফোনে এমন উচ্চৈঃস্বরে ‘বাতচিত’ করতে শুরু করলো যে মনোযোগ দেয়া দায় হয়ে পড়লো। সুমনাকে বলি, বাসা থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ড্রাইভার আলমগীর সারাক্ষণ বকবক করছিলো। তার নিজের কথা, দেশের অনিয়ম, অরাজকতার কথা, কষ্টের কথা। ভেবেছিলাম বাসাটুএয়ারপোর্টএই পথটুকু গাড়িতে চোখ বন্ধ করে একটু জিরিয়ে নেবো। সে হবার জো ছিল না। দেশে এলে আলমগীর থাকে এখানেওখানে নিয়ে যাবার জন্যে। লোকটি সৎ। সমস্যা হলো, কথা বলে প্রচুর। শ্রোতার সেদিকে মনোযোগ আছে কিনা সেদিকে তার কোন মনোযোগ নেই। সে বলে চলে অবিরাম। তার নিজের দুঃখের কথা। তার দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে তাকে ডিভোর্স দিয়ে। প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর এই বিয়ে। কিন্তু মাস ছয়েকের মাথায় এই পরিণতি। এখন আবার ফিরে আসতে চায় তার দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর ঘরে তার তিন ছেলে, একটি মেয়ে। বড় ছেলে থাকে ওমান, দ্বিতীয় ছেলেকে একটি গাড়ি কিনে দিয়েছে, ভাড়ায় চালায় সে গাড়ি, তৃতীয়জনকে ছোটখাট একটি গাড়ির গ্যারেজ খুলে দিয়েছে। এই সব তার মুখ থেকে শোনা, বলা চলে তার আমাকে অনেকটা জোর করে শোনানো। এই ধরনের ড্রাইভারের পাশে বসার এই ভোগান্তি। আর দেশে এলে আমি সামনের সিটে বসি দেশটাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করার জন্যে। সুমনাকে বলি, ঠিক করেছি আলমগীরকে আর আগামীতে ডাকবো না। বড্ড বেশি কথা বলে। এই কথা বলার মিনিট বিশেক পর এয়ারপোর্টে আমার পাশে যে যাত্রী, হঠাৎ দেখি উচ্চৈঃস্বরে ফোনে কথা বলা শুরু করেছেন। তার কথা বলার ধরন দেখে মনে হলো আলমগীরের প্রেতাত্মা আমায় তাড়া করছে। অগত্যা স্থান বদল করতে হলো।

চট্টগ্রাম বিমান বন্দর এখন আগের চাইতে তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার। এয়ারপোর্ট ঢুকতে যে রাস্তাটি তা বেশ গোছালো, পরিস্কার, দুদিকে সারিবদ্ধ গাছ। দেখে ভালো লাগে। ভাবি এমনটি যদি সমগ্র বাংলাদেশ হতো। গাড়ি থেকে নামতেই নভো এয়ার লাইনসের এক কর্মচারী ট্রলি নিয়ে এগিয়ে আসে, সাহায্য করে টিকেট কাউন্টার তক যেতে। আমরা যাবো বিমান এয়ারলাইন্স উড়োজাহাজে। বিমান কাউন্টার তখন অনেকটা যাত্রীবিহীন। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই আমাদের আসা। মাঝে অনেক বছর বাংলাদেশ বিমানে ভ্রমণ করা হয়নি। বলা উচিত করিনি। দুর্বল সার্ভিস ও শিডিউল মেনটেইন না করা ইত্যাদি নানা অভিযোগের কারণে বিমানে আন্তর্জাতিক রুটে ভ্রমণ করি না। তবে এবার দেশে এসে ইতিমধ্যে ঢাকাচট্টগ্রাম দুবার আসাযাওয়া করেছি বিমানে। ডোমেস্টিক ফ্লাইটগুলির সার্ভিস ভালোই বলতে হবে। মোটামুটি সময়মত ছেড়েছে। ফ্লাইটের ভেতর সার্ভিসও উন্নত হয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ বিমানের পথচলার ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। বিমানের চমৎকার ‘লোগো’টি যে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা তা জানলাম আজ।

আমার এই অসম্বদ্ধ কথা বার্তায় ভিন্ন একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করে শেষ করবো আজকের লেখা। দেশে এলে ফিবার কোনো না কোন বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হয়। এবার সব চাইতে যে বিষয়টি বিরক্তিকর হয়ে ঠেকেছে তা হলো, প্রায় সবার সময় মেনটেইন না করা। আমি সময় ধরে চলি। সে কারণে কেউ কোথায়ও যেতে বললে, বিশেষ করে সময় উল্লেখ করে নেমন্ত্রন করলে, উপস্থিত হয়ে দেখি আমরাই প্রথম। কোনো কোনো জায়গায় হোস্টও অনুপস্থিত, যা খুব অশোভন বলে আমার ধারণা। নিয়ম আর অনুশাসনের দেশে দীর্ঘ দিনের বসবাস বলে হয়তো আমার এমনটি হয় যা অনেকের দৃষ্টিতে ‘বাড়াবাড়ি’ বলেও মনে হতে পারে। কেউ কেউ আবার একটু দেরি করে এলে তার গুরুত্ব বাড়ে এমন ভ্রান্ত ধারণাও পোষণ করেন। তবে এবার জানলাম এই ব্যাপারে বাংলা একাডেমি পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক রাশেদ রউফ সময় ধরে চলেন, যা প্রশংসনীয়। সেটি দেখলাম চট্টগ্রাম একাডেমির এক অনুষ্ঠানে গিয়ে। যারা দেরিতে আসেন বা দেরিতে আসাটা অভ্যেসে পরিণত করেছেন, তারা অজুহাত হিসাবে প্রায়শ বলেন, ‘ট্রাফিক জ্যাম। প্রয়াত বন্ধু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের একটি ভালো অবজারভেশন আছে এই ব্যাপারে। ঢাকা এলে আমাদের কমন বন্ধুদের একটি আড্ডা হতো কোন এক রেস্তোরাঁয়। সময় সাত থেকে সাড়ে সাত হলেও এক ডিনারে দেখা গেল আমন্ত্রিতদের কেউ কেউ এলেন রাত সাড়ে নটায়। তাদের ওই একই অজুহাত ট্রাফিক জ্যামে আটকে গিয়েছিলেন। কিছুটা বিরক্ত হয়ে জাহাঙ্গীর ভাই বলেন, ‘ট্রাফিক জ্যামের কারণে আমরা কেউ কোনোদিন কিন্তু ফ্লাইট মিস করিনি।’ কথাটা খুব সত্যি। তখন আমরা ওই জ্যামটাকে আমলে নিয়েই ঘর থেকে বের হই।

লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল চিকিৎসা সেবায় সাফল্য ও অগ্রযাত্রার ৪৩ বছর
পরবর্তী নিবন্ধভূতের মুখে অসহনীয় রাম রাম জপ