হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

পরদিন রোববার। সুমনার সাপ্তাহিক অফিস ছুটি। আমাদের জন্য সহনীয় শীত। কিন্তু লক্ষ্য করি শিহাব ও সাদাফের জন্যে বেশ ঠান্ডা। দুজনেই গায়ে জড়িয়েছে ভারী শীতের কাপড়। সাদাফের মাথায় ক্যাপ, শীত থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা। সুমনার ওদের হোটেল থেকে নিয়ে হেগ শহরের কিছু দর্শনীয় এলাকায় যাবার কথা। তারপর সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ওদের প্যারিস-ট্রেনের টিকেট কাটা। সেভাবেই সে সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিল। ডাইনিং টেবিলকে টেম্পোরারি অফিস বানিয়ে কাজ করছি, ক্ষণিক বাদে কলিং বেল বেজে উঠে। দরোজা খুলতেই দেখি শিহাব ও সাদাফকে নিয়ে সুমনা ফিরে এসেছে। সুমনা তার মোবাইল ফেলে গেছে। গতরাতে যখন এসেছিল তখন সাদাফ ও শিহাব বেশ ক্লান্ত ছিল। বাইরের কিছু চোখে পড়েনি। আজ ড্রয়িং রুমে ঢুকেই সাদাফের চোখে পড়ে পেছনের ছোট্ট বাগান। আহামরি তেমন কিছু নয়, তারপরও সাদাফ বলে উঠে, বেশ সুন্দর তো। পেছনের দরোজা খুলে বাগানে ওরা দুজন বেশ কিছু ছবি তুলে। তারপর বেড়িয়ে পড়ে সুমনা সহ। পরে জেনেছি ওরা উত্তর সাগর পাড়ে খানিক বেরিয়ে বন্দর নগরী রটারডামে যায়। উদ্দেশ্য বেড়ানো নয়। ওরা গিয়েছিল প্যারিস-গামী ট্রেনের টিকেট কিনতে। ট্রেনে প্যারিস যেতে গেলে রটারডাম স্টেশন থেকে উঠতে হয়। হেগ শহর থেকে কোন ট্রেন প্যারিসে যায়না। রোববার হলেও সেদিন অফিসে কিছু কাজ ছিল। ওদের নিয়ে বিকেলের দিকে সুমনা এলো আমার অফিসে। তারপর সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছাকাছি এক চাইনিজ রেস্তোরাঁয়। সেখানে যখন পৌঁছি তখন রাত নটা পেরিয়ে গেছে। ভয় হচ্ছিল কিচেন না জানি বন্ধ হয়ে যায় ততক্ষণে। ভাগ্য ভালো। তখনও খোলা। বেশ কিছু ডাচ খদ্দের ডিনার শেষে আড্ডা দিচ্ছিল। শিহাবের জেট-লগ তখনও কাটেনি। বিছানায় যেতে পারলে সে যেন বাঁচে। রেস্টুরেন্ট থেকে সোজা যে রাস্তাটি সামনের দিকে এগিয়ে গেছে, তার কিছুদূর গিয়ে ডান দিকে টার্ন নিতেই ওদের হোটেল, আইবিস হোটেলে। একই হোটেলে কাল সকালে আসবেন মালেক ভাই ও কামরুন ভাবি অর্থাৎ মালেক ভাইয়ের স্ত্রী। ওই হোটেলেই বুকিং দেয়া ছিল। একটা ব্যাপার ভালো লাগলো তা হলো মা-বাবাকে কাছে পাবার জন্যে শিহাবের হা-হুতাশ। দেশে মা-বাবার সাথে থাকে, কিন্তু এই বিদেশে বেড়াতে এসেও চেয়েছে মা-বাবাকে একসাথে নিয়ে কটা দিন কাটাতে। মা-বাবার প্রতি তার এই টানটা খুব ভালো লেগেছে। যে কর্মটি আমি করিনি বা করতে পারিনি, সেটি আর কাউকে করতে দেখলে ভালো লাগে। তখন বোধকরি নিজেকে নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, নিজের আনন্দটাই হয়তো তখন বড় করে দেখেছিলাম। শিহাবের সাথে আমার এই প্রথম দেখা, পরিচয়। তার সম্পর্কে আমার জানা নেই। কিন্তু তার কেবল এই ভালো দিকটি দেখে তার প্রতি আমার ভালোলাগা বেড়ে গেছে। শিহাব এখানে-ওখানে বেড়াতে গিয়ে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলেছে। মা-বাবার প্রতি প্রতিটি সন্তানের সম্পর্কটা এমন হতো তাহলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হতো বলে আমার ধারণা।
পরদিন সোমবার। ওয়ার্কিং ডে। সেদিনই লন্ডন থেকে ট্রেনে হল্যান্ড এলেন মালেক ভাই ও ভাবি। সাথে মুকু, ভাবীর বোনের ছেলে। বয়সে তরুণ ও স্মার্ট মুকু স্থায়ীভাবে থাকে লন্ডন। বিয়ে করেছে অস্ট্রিয়ার মেয়ে। বউ থাকে ভিয়েনায়। ফলে মুকুকে লন্ডন-ভিয়েনা করতে হয় প্রায়শ। ঠিক হলো সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডা দেয়া হবে। বাসা থেকে হোটেলের দূরত্ব ১০/১২ কিলোমিটার। নির্দিষ্ট সময়ে হোটেল পৌঁছুলে দেখি ওনারা সবাই লবিতে। স্থান সংকুলান হবেনা বিধায় শিহাব, সাদাফ ও মুকুকে আমার বাসার ঠিকানা দিয়ে বলি টেক্সি নিতে। মালেক ভাই, ভাবীকে সাথে নিয়ে সরাসরি বাসায় না এসে পীচ প্যালেস বা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিস ভবন ঘুরে আসি। পীচ প্যালেসের সামনে এসে জিজ্ঞেস করি ওনারা নামবেন কিনা। মালেক ভাই, ভাবি কেউ গাড়ি থেকে নামতে রাজি নন। ঠান্ডা, তার উপর তাদের শরীরের উপর ধকলও কম যায়নি সেদিন। তবে দুজনের মনোবল দেখে অবাক হই। বয়স এবং শরীরের বিদ্রোহ-দুটোকেই একেবারে আমলে না এনে ইউরোপ ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই শীতেও। তবে এতো আর নতুন কিছু নয় তাদের জন্যে। মালেক ভাই তো পৃথিবীর অনেকটা দেখে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। দৈনিক আজাদীর চীফ রিপোর্টার হাসান আকবরকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনে এত বেশি বেড়িয়েছি যে, এখন অনেক দেশের নামই মনে করতে পারি না।’ যাই হোক, আগ বাড়িয়ে সুমনা বাসার হিটারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। চলে আড্ডা, হাসি-ঠাট্টা। তখনও শিহাব-সাদাফ আর মুকু এসে পৌঁছায়নি। মালেক ভাই রসালো কৌতুকে আসর জমালে ভাবি বলেন, ‘ছেলেরা আসলে তো আর সব বলা যাবেনা।’ মালেক ভাই ও ভাবীকে নিয়ে বাসায় এসে পৌঁছার ঘন্টা খানেকের মধ্যে শিহাবরা এসে পৌঁছায়। জানালো টেক্সি না নিয়ে ওরা গুগল ম্যাপ দেখে ট্রাম নিয়ে চলে এসেছে। মালেক ভাইয়ের আড্ডায় বুঝি জুড়ি মেলা ভার। বেশ জমাতে পারেন। উইটি কথাবার্তা বলেন। থাকে শিক্ষণীয় বিষয়ও। একটি মজার কৌতুকও শেয়ার করলেন আমাদের সাথে। ক্রিকেট দেখতে আসা এক দর্শক। খেলা শেষ। সব দর্শক চলে গেছে, গ্যালারি শূন্য। কেবল একজন বসে আছে। গেইটম্যান এসে তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে চায়, খেলা তো শেষ, বসে আছে কেন? উত্তরে দর্শক বলে, ‘হাই-লাইটস দেখাবে না?’ বিদেশে গাড়ি ড্রাইভিং প্রসঙ্গে বলি, ‘ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবুর্গ ইত্যাদি দেশে গেছি লং ড্রাইভের।’ যখন তিনি তার নিজ অভিজ্ঞতার কথা বললেন, তখন মনে হলো তার তুলনায় আমার লং ড্রাইভিং নস্যি মাত্র। ‘আমেরিকার ৩২টি স্টেটে স্ত্রীকে নিয়ে নিজে ক্যারাভেন চালিয়ে বেড়িয়েছি, বলেন তিনি। আমার তো ক্যারাভেন চালাতেই ভয় হয়। সুমনার আফসোস, আমি ওকে ক্যারাভ্যানে নিয়ে ঘুরতে পারিনি।
ইউরোপ এই সময়টা ঘুরে বেড়ানোর জন্যে মোটেও অনুকূল নয়। সেটি আমাদের জন্যে। তবে ইউরোপীয়রা বসে থাকে কখন বরফ পড়বে তারই অপেক্ষায়। তারপর দল বেঁধে ছুটে যাবে স্কী করতে। পরদিন ভোরে শিহাব ও সাফাদ চলে গেল প্যারিস। প্যারিস থেকে ওরা যাবে সুইজারল্যান্ড, মিলান ইত্যাদি। অন্যদিকে, মালেক ভাই, ভাবি, মুকু, সুমনা সহ আমরা রওনা দেই রটারডামের উদ্দেশ্যে। হেগ শহর থেকে বন্দরনগরী রটারডামের দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার, গাড়িতে আধ ঘন্টার মত, যদি হাইওয়েতে ট্র্যাফিক জামে আটকে না পড়ে। জনসংখ্যা অনুপাতে রাজধানী আমস্টারডামের পর রটারডামের স্থান। এই শহরে বাস করে প্রায় ছয় লক্ষ লোক। তেরশ শতাব্দীতে অর্থাৎ ১২৭০ সালে ‘রটে’ নদীর পাশ দিয়ে বাঁধ (ড্যাম) তৈরি করার পর এই শহরের গোড়াপত্তন হয়। ইউরোপের মধ্যে রটারডাম হলো সব চাইতে বড় সমুদ্র বন্দর এবং পূর্ব এশিয়ার বাইরে সর্ববৃহৎ সমুদ্র বন্দর। রটারডাম রাইন ও মাস (মিউজ) নদী নিয়ে গঠিত বদ্বীপের একটি স্রোতধারা, নিউ মাস নদীর তীরে অবস্থিত। ঠিক হলো এই নদীতে টুরিস্ট বোটে চড়ে আমরা ঘুরে বেড়াবো। সেদিনের আকাশ ছিল বৈরী। সকাল থেকে মেঘলা, কখনো-সখনো গুড়ি গুড়ি হালকা বৃষ্টি, ঠান্ডা তো আছেই। বিশেষ করে মালেক ভাই ও ভাবীর জন্যে এই আবহাওয়া একেবারেই উপযোগী নয়। কিন্তু তাদের উৎসাহের কোন কমতি ছিলনা। সেটির উপর ভরসা করে আমরা গাড়ি নিয়ে বের হই রটারডামের উদ্দেশ্যে। ভাগ্য বুঝি খুব একটা সুপ্রসন্ন ছিল না। যেই না আমরা জাহাজের টিকেট কাটার জন্য কাউন্টারে গেলাম, আমাদের বলা হলো আজকের শেষ জাহাজটি মিনিট পাঁচেক আগে ছেড়ে দিয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে এলো। মালেকভাই ও ভাবি বললেন, কোন ব্যাপার না। আমরা অন্য কিছু দেখবো। তবে উপরওয়ালা যা করেন তা ভালোর জন্যে করেন বলে কথা। যেখানে গেলাম সেখানে গিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল সবার। গেলাম ‘ইউরোমাস্ট’, হল্যান্ডের আর এক দর্শনীয় স্থান। পাঠকের অবগতির জন্যে বলে রাখি, ইউরোমাস্ট রটারডামের একটি বা ‘পর্যবেক্ষণ টাওয়ার’, যা ১৯৫৮-১৯৬০ সালে তৈরি। ডাচ আর্কিটেক্ট হিউ মাস্ক্যান্ট এর ডিজাইন তৈরি করেছিলেন। এই অবজারভেশন টাওয়ার ১৯৬০ সালে ‘ফ্লোরিয়াডার’ জন্যে নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি একটি কংক্রিটের কাঠামো যার অভ্যন্তরীণ ব্যাস ৯ মিটার (৩০ ফুট) এবং ৩০ সেমি (১২ ইঞ্চি) প্রাচীরের পুরুত্ব। স্থিতিশীলতার জন্য এটি ১,৯০০,০০০ কেজি ওজনের কংক্রিট ব্লকের উপর নির্মিত যাতে মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রটি মাটির নীচে থাকে। এটি মাটি থেকে ৯৬ মিটার (৩১৫ ফুট) উপরে একটি “কাকের বাসা” পর্যবেক্ষণ প্ল্যাটফর্ম এবং এখানে একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। বাসার কাছেই এই টাওয়ার। অথচ গত ৩২ বছরেও এতে উঠা হয়নি আমার। মালেক ভাই ও ভাবীর কারণে এই দর্শনীয় স্থানটি এবার দেখা হলো। এসে মনে হলো কী করে এটি এদ্দিন না দেখে রয়েছি। আসলেও ঘরের কাছের কত কিছুই আমাদের দেখা হয় না, দেখি না। এ যেন সেই ‘বাড়ির কাছে আরশী নগর/ সেথা পড়শী বসত করে /আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।’ মালেক ভাই বললেন, ‘ভালোই হলো যে আমরা বোট মিস করেছি। বোটে চড়ে বেড়ালে আমরা কেবল নদীর তীরে যা আছে তাই দেখতাম। কিন্তু এই টাওয়ারে উঠে আমরা গোটা রটারডাম দেখতে পেলাম।’ (চলবে)

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী জাগরণের অগ্রদূত
পরবর্তী নিবন্ধবিজয় ২০২২ : দুর্নীতিবাজ বর্জনের অঙ্গীকার