বিজয় ২০২২ : দুর্নীতিবাজ বর্জনের অঙ্গীকার

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

চলমান বিজয় মাসের শুরু থেকে নতুন করে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাতে আশাজাগানিয়া সমৃদ্ধির বার্তা দেশবাসীকে নবতর প্রাণস্পন্দনে উদ্বেলিত করে চলছে। নানামুখী দেশীয়-আন্তর্জাতিক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের সকল অপকৌশল সম্পর্কে জনগণের সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি সর্বত্রই প্রতিফলিত। দেশকে অস্থিতিশীল করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির সকল কদর্য অপচেষ্টাকে রুখে দিতে দেশবাসী প্রস্তুত। বিজয়ের গৌরবে দেশ আবার নতুন আবেগ-উদ্দীপনা ও আশা-প্রত্যাশায় জাগ্রত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য জনশ্রুতিমতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি-সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে শাহাদাৎ বরণের নিষ্ঠুর ক্ষেত্র তৈরির কুশীলব এবং হত্যার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দায়ী ব্যক্তিদের বশংবদরা নানা ছলচাতুরী-প্রতারণা-মিথ্যাচার-অনৈতিক আর্থিক লেনদেনসহ বিবেক বর্জিত লবিং-তদবির বাণিজ্যের আড়ালে পদ-পদায়ন-পদক দখলে প্রচন্ড তৎপর। কথিত নামধারী নেতা-নেত্রীর কূটশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় উচ্চ শিক্ষা থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এদের অবস্থান এবং দেশ-সরকার বিরোধী কার্যকলাপ অবলোকনে দেশবাসী নিদারুণ উৎকন্ঠিত। অত্যন্ত গর্হিত-দেশবিধ্বংসী এসব অপশক্তির গোপন যোগসাজশ বর্তমান সকল ক্ষেত্রে সফল ও সার্থক গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে কুকৌশলে নানা অপপ্রচার-গুজব ছড়িয়ে জনগণের মনে সন্দেহ-সংশয়-বিভ্রান্তির অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে।
সচেতন দেশবাসীর উপলব্ধিতে এটি সুস্পষ্ট; অগ্রসরমান বাংলাদেশকে তাদের অভিভাবক বিশ্বে ঘৃণিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের তুলনায় পিছিয়ে রেখে প্রাগ্রসর-উন্নত বিশ্বের মহাসড়কে পদার্পণের পথকে রুদ্ধ করতে চায়। শত অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কুৎসিত অপপ্রয়াস সংহার করে জাতিকে দুর্নীতিবাজমুক্ত করার সাহসীক ব্রতে জাতি বদ্ধপরিকর। ৬ ডিসেম্বর ২০২২ মাতৃভাষা থেকে শুরু করে স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত গৌরবের উত্তরাধিকারী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৩০তম সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘লেখাপড়া শিখে নিজেদের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে যাতে আগামী দিনে দেশের দায়িত্ব নিতে পার, যেন বাংলাদেশের এই উন্নয়নের ধারাটা অব্যাহত থাকে। আর ওই দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, খুনি, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরা যেন আর ক্ষমতায় আসতে না পারে- সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে।’ স্বাধীনতার ইতিহাস যাতে মুছে ফেলতে না পারে সে জন্য জনমত গঠন এবং আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগাতার অপপ্রচারের জবাব দিতে তিনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়াও ব্যাংকে টাকা নেই বলে যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে; দেশবাসীকে তাতে কান না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই যে, জাতির জনকের নেতৃত্বে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে দল ও অঙ্গসংগঠনের সকল নেতা-কর্মীর নিরলস প্রজ্ঞা-মেধা-শ্রম যোগানের বিপরীতে কূটকৌশলের আশ্রয়ে ছাত্রলীগে ভাঙন ধরিয়ে দলকে দুর্বল করার দায়ী ব্যক্তিরা এখন কোথায়? সেনা-স্বৈর শাসকদের শাসন-শোষণ পাকাপোক্ত করার জন্য তারা কতটুকু দায়ী; সত্য-বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে তা নির্ধারণ অতি জরুরি। ছদ্মবেশী এসব অর্থ-ক্ষমতালিপ্সু দানবদের চিহ্নিত করে দল বা সরকার থেকে এদের বিতাড়ন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। অন্যথায় সুক্ষ্ণ অভিনয় শৈলীর কারসাজিতে সাদাচুল-গোফ-দাঁড়ি সম্বলিত এসব নষ্ট চরিত্রের বোল পাল্টানো এবং নিত্যদিন বিভিন্ন মিডিয়ায় অন্তরে ন্যূনতম ধারণ না করেও বঙ্গবন্ধুর নাম ও আদর্শ উপস্থাপন কোনভাবেই দুঃসময়ে ত্যাগী নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বরাবরই সকল অপকর্মে জড়িত এসব ব্যক্তিদের যেকোন সময় ভয়ংকর অঘটন ঘটিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে হীন পারদর্শীতা সম্পর্কে প্রকৃত সচেতনমহল-বীর মুক্তিযোদ্ধারা সম্যক অবগত আছেন। উল্লেখ্য মুখোশধারী সুবিধাভোগীদের চরিত্র উম্মোচন ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে এরা পরিত্যক্ত ঘোষিত না হলে দেশ বিপদগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
এটি সর্বজনবিদিত যে মহান স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহতি পরেই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন ও সংগ্রামের অমিত ফসল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের সূচনা থেকেই এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিকে নতুন করে নির্মাণের নিরলস কর্মকান্ডে অফুরন্ত উৎসাহ উদ্দীপনায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মাত্র সাড়ে তিন বছরের স্বল্পাধিককাল শাসনকালে দূরদর্শী পরিকল্পনা ও নিরলস পরিশ্রমের বিনিময়ে বহুবিধ সমস্যা তথা খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, পরিপূর্ণ বিপর্যস্ত যোগাযোগ ও উৎপাদন ইত্যাদি চরম সংকটের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ, শর্তসাপেক্ষে বৈদেশিক সাহায্য বা পরনির্ভরশীলতার পরাকাষ্ঠাকে অবজ্ঞা করে আপামর জনগণের সাহস ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে চারটি বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে টেকসই দীর্ঘমেয়াদী সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক ভীত নির্মাণে অসাধারণ সফলতার দ্বার উম্মোচন করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। নির্ভীক সাহসিকতায় দেশপ্রেমের মোহনিয়া পরিগ্রহে বঙ্গবন্ধু বারবার ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারী, মুনাফাখোর, দেশের সম্পদ পাচারকারী, মজুদদার এবং অর্থ-ক্ষমতার মোহে পাগলপ্রায় মানুষ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেছেন এবং বাংলার দু:খী মানুষের সুখ-শান্তি ও দু’বেলা পেট ভরে খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তাঁর আজীবনের লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা বিনির্মাণে করণীয় উদ্যোগ এবং তা বাস্তবায়নে সোনার মানুষের সন্ধানে নিরলস নিজেকে নিবেদন করেছেন। আত্মনির্ভর-আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাশীল জাতিতে পরিণত করার মাঙ্গলিক স্বপ্নে দেশবাসীকে উদ্ভাসিত করেছেন।
স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দেন; যার প্রধান লক্ষ্য ছিল- দুর্নীতি দমন; ক্ষেতে খামারে ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘গরীব দুঃখির সুখেই স্বাধীনতার সার্থকতা’। উল্লেখ্য ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, “এবার আমি আপনাদের সাহায্য চাই। আপনারা একবার আল্লাহ্‌র নামে প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতির উর্ধ্বে থাকব’। প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব’। প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দেশকে ভালবাসবো, দেশের মানুষকে ভালোবাসবো, দেশের মাটিকে ভালবাসবো।” ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লা সেনানিবাসে অস্থায়ী বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রাঙ্গণে ব্যাচ পাসিং আউট প্যারেডে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এত রক্ত দেওয়ার পরে যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন অনেকের হয় নাই। এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরি বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত আমি এদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি।’
আমাদের সকলের জানা ২০০২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে ৪ বছর বাংলাদেশ বিশ্বের দুর্নীতির শীর্ষ অবস্থানে ছিল। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবৈধ সামরিক শক্তি সমর্থিত কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে বিশ্বে বাংলাদেশ দুর্নীতির শীর্ষ দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল প্রায় পাঁচবার। কিন্তু অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দক্ষ সরকার পরিচালনায় দুর্নীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং সকলক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি ২০১৭ সালে নভেম্বর মাসে বিশ্বের ১৭৩টি দেশের সরকার প্রধানদের মধ্যে সততার জন্য বিশ্বে শীর্ষ পাঁচটি আসনের মধ্যে নিজেকে তৃতীয় স্থানে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর ২০১৯ সালে জানুয়ারি মাসে প্রথম কর্মদিবসে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে জননেত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। একই সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজের কঠোর অবস্থান এবং দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে সরকারের বার্তা প্রশাসনের তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। ইতিমধ্যে সকল স্তরে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটল থাকায় এক দশক আগের তুলনায় দুর্নীতি অনেকাংশে কমে এসেছে। দুর্নীতির বিষবৃক্ষ স্বমূলে উৎপাটন করে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য একটি সুশাসনভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের এত সব ঈর্ষণীয় অর্জন সম্ভব হয়েছে নিখাঁদ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক নির্দেশনায় দেশ পরিচালনার মাধ্যমেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বল্পসংখ্যক কতিপয় কর্তাব্যক্তির দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থে অনিয়ম ও অপকৌশলের শঠতা সরকারের সফল অর্জনকে এতটুকু ম্লান করার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করিনা। সঠিক অর্থে যথার্থ পন্থা অবলম্বনে দেশকে দুর্নীতি-দুর্নীতিবাজ মুক্ত করতেই হবে। না হলে বাংলার আগামী দিনের ইতিহাসের অধ্যায়ে আমরা দায়বদ্ধ হয়ে থাকব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই অভিযানের যথাযথ তত্ত্বাবধান, পুনঃযাচাই ও মূল্যায়নের জন্য কর্ণাশ্রীত মিথ্যা আবেগে নয়; সততা-নীতি-নৈতিকতার নৈর্ব্যক্তিক মাপকাঠিতে অনন্য উচ্চতায় দেশে যাঁরা পরীক্ষিত তাঁদেরকে সম্পৃক্ত করা হলে দুর্নীতি নির্মূলের দৃশ্যমান বাস্তবায়ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে- এটিই জাতির প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধদুর্নীতি প্রতিরোধে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে