নারী জাগরণের অগ্রদূত

ববি বড়ুয়া | শনিবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

মাস খানেক আগে কলেজে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে ক্লাসে যাবো এমন সময় একটি অপরিচিত মেয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বললো, ম্যাডাম কেমন আছেন? আমি ঠিক চিনতে না পেরেও ভালো আছি জানালে সে বেশ উচ্ছলতার সাথে অনর্গল বলতে শুরু করলো তার কথা। সে ভালো নেই। কিছুক্ষণ পর আমার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে সে বললো, ‘ম্যাডাম আপনি কি আমায় চিনতে পারছেন না’? বললাম, ‘না, ঠিক চিনতে পারছি না। তোমার চেহারা তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। তাই চিনবো কী করে বলো ? ‘আবার সে সরল সুরে বলে উঠলো, ‘ম্যাডাম মনে নেই আপনি আমাকে খুব আদর করতেন, ক্লাসে নানা প্রশ্নের উত্তরে আপনি সবার কাছে সেরা বলে তুলে ধরতেন’? আবার কি যেন মনে করে মুখের কাপড়টা সরিয়ে ফেললো। এতক্ষণ শুধু তার চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছিলাম। এখন মুখ দেখে চিনতে বাকি রইলো না, এইচ এস সি প্রথম বর্ষের মানবিকের খ শাখার সবচেয়ে মেধাবী মেয়ে সামিয়া। যে অর্থনীতির কঠিন কঠিন লেখচিত্র নিমিষেই বুঝে যেত এবং তার জিজ্ঞাসু মন অর্থনীতির অজানা অলিগলিতে বিচরণে ব্যতিব্যস্ত থাকতো। সাথে সাথে আমার মনটাও পুলকিত হয়ে উঠলো। বললাম, ‘কোথায় ছিলে এতোদিন? তোমাকে ক্লাসে আমি অনেকবার খুঁজেছি’। আমার কথা শুনেই সামিয়া হাসির আড়ালে এতক্ষণ যে কষ্ট চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল, তা কান্নার স্ফুরণে বেরিয়ে আসলো। তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে গেলে, তার কান্না দ্বিগুণ বেড়ে আমার বুকেই থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করতে সক্ষম হই। বলেছিলাম, তোমার মা বাবাকে বলো আমার সাথে কথা বলতে। আমি বুঝিয়ে বলবো তোমাকে যেন কলেজে পাঠান। তোমার মতো মেধাবী মেয়ে যেন অকালে ঝরে না পড়ে। আজ এতোদিন হয়ে গেলো, এখনো যেন মেয়েটি আমার বুকের মাঝে গুমরে গুমরে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ আমি এখনো শুনতে পাই।
আজ বেগম রোকেয়া সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা পড়তে গিয়ে মেয়েটির কান্না যেন আরো বেশি করে বুকের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সেই কান্না ভাঙা বুকের থরথরানি যেন চিৎকার করে বলছে, বেগম রোকেয়ার মতো মহৎপ্রাণ সাহসী নারীর প্রয়োজনয়ীতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। আমরা মুক্ত হতে চাই। আলোর পৃথিবীকে আবার নতুন করে দেখতে চাই।
৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিবস। আজ থেকে প্রায় সাত আট বছর আগে ‘একটি প্রদীপ জ্বেলেছিল শত সহগ্র প্রদীপ’ শিরোনামে একটি লেখা পড়েছিলাম দৈনিক আজাদীতে। এখনো লেখার প্রতিটি লাইনে বেগম রোকেয়া চোখের সামনে জাজ্বল্যমান। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্‌ভ্রান্ত রক্ষনশীল মুসলিম জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। বেগম রোকেয়ার পূর্বপুরুষগণ মুগল আমলে উচ্চ সামরিক এবং বিচার বিভাগীয় পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর পিতা আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল।
বেগম রোকেয়ার বড়ো দুই ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করার ফলে ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটে এবং তা তাঁদের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করে। পিতার আড়ালে ভাইদের সহযোগিতায় প্রথম তাঁর বড়ো বোন করিমুন্নেসা এবং পরবর্তীতে বেগম রোকেয়া গয়ে উঠেছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী। সেই সময়ের সামাজিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা মুসলমান পরিবারের রোকেয়া বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড়ো দুই ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল যথেষ্ট। যদিও পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাস করার সময় একজন বিদেশি ম্যামের কাছে তিনি কিছুদিন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনদের ভ্রুকুটির জন্য তাও বন্ধ করে দিতে হলেও দমে যাননি।
১৮৯৮ সালে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল স্বামী সাখাওয়াৎ হোসেনের প্রভাব তাঁর জীবনে ছিল সুদূরপ্রসারী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সাহচর্যে এসেই বেগম রোকেয়ার জ্ঞানচর্চার পরিধিও হয় বিস্তৃত।
স্বামীর মৃত্যুর পর রোকেয়া তাঁর নিঃসঙ্গতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। প্রায় দুই যুগ ধরে বেগম রোকেয়া তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন স্কুল পরিচালনায়। বিরূপ সামাজিক পরিবেশে কটাক্ষ, সমালোচনা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে সে যুগের মুসলমান মেয়েদের শিক্ষালাভের অন্যতম পীঠস্থানে পরিণত করেন। এটি ছিল তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের বাস্তবায়ন।
শৈশব থেকে মুসলমান নারীদের যে দুর্দশা তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন, সেই তাড়না থেকেই মুক্তির পথ খুঁজতেই এই স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য। তাঁর স্কুলে মেয়েদের পাঠাবার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি অভিভাবকদের অনুরোধ করতেন। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে, যে যুগে কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে বাঙালি মুসলমানরা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করত, সেই অন্ধকার যুগে বেগম রোকেয়া পর্দার অন্তরালে থেকেই নারীশিক্ষা বিস্তারে অদম্য হয়ে ওঠেন এবং মুসলমান মেয়েদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ সুগম করেন।
তিনি নারী মুক্তি ও নারী অধিকারকে সমাজের নারীদের মনে মুক্তির বীজ রোপণ করে দেয়ার লক্ষ্যে লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, ছোটোগল্প, কবিতা, ব্যঙ্গাত্মক রচনা ও অনুবাদ। সুলতানা’স ড্রিম গ্রন্থটি রোকেয়া নিজেই বাংলায় অনুবাদ করেন ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে। মতিচূর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন প্রভৃতি গ্রন্থে বেগম রোকেয়ার ঐকান্তিক স্বপ্নই এক অভিনব রূপ পেয়েছে।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে বেগম রোকেয়ার অবদান চিরঅম্লান। নারীদের মুক্তির আন্দোলনে জাগ্রত করতে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপ? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্য তাহাই’। তিনি আরও লিখেছেন, ‘ভগিনীরা! চুল রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন! মাথা ঠুকিয়া বলো মা! আমরা পশু নই; বলো ভগিনী! আমরা আসবাব নই’ বলো কন্যে আমরা জড়োয়া অলংকার রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বলো আমরা মানুষ। না জাগিলে ভারর ললনা, এ ভারত আর জাগিবে না’। তিনি নারীকে নারী নয় একজন মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচিত করতে চেয়েছেন।
নারীর শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা, কর্মসংস্থান ও আইনগত অধিকারের বিষয়ে তাঁর প্রগতিশীল ও জনকল্যাণমূলক বক্তব্য শুধু সেকালে নয় ; একালের পাঠককের কাছে সমান গ্রহণযোগ্য। তিনি অবরোধ-প্রথার উচ্ছেদ চেয়েছিলেন; কিন্তু নারীর পর্দা তথা শালীনতার সৌন্দর্য বিসর্জন দেবে, এটা তিনি কোন দিনই কামনা করেননি। অতি আধুনিকতার নামে অশালীনতার বিপক্ষে ছিলেন ; যা তাঁর কিছু রম্য রচনার মধ্যে প্রকাশ পায়। তিনি পর্দা চেয়েছেন; শুধু তার বাড়াবাড়ি পছন্দ করেননি। বলেছেন, ‘ঐ সব কৃত্রিম পর্দা কম করিতে হইবে।’ অর্থাৎ তিনি অকারণ পর্দার বিরোধিতা করেছেন ঠিকই; কিন্তু মনে পর্দা যত্নে রাখতে বলেছেন। কারণ নারীর নিজের মনের মুক্তি না হলে অন্য কোনও ভাবে সেই মোক্ষম মুক্তি লাভ সম্ভব নয়।
নারীর মনের মুক্তি সাধনে আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও উনবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া ক্ষণজন্মা মানুষটির প্রয়োজন অনুভব করছি। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যেন উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়, মেধাবী সামিয়াদের তার পরিবার কিংবা পারিপার্শ্বিক চাপে তাদের প্রদীপ হয়ে জ্বলার স্বপ্ন নিভে না যায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ওমরগণি এমই এস কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধআত্মসমালোচনা মন্দ হতে বিরত রাখে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে