স্মৃতির শহরে, শ্রুতিতে-স্মৃতিতে

ফারহানা আনন্দময়ী | সোমবার , ১২ জুলাই, ২০২১ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

‘তুমি আছ, তবু তুমি নেই স্মৃতির শহরে…’
গানের এই শেষ পঙক্তিটিকে একটু নিজের মতো করে যদি বলি, ‘তুমি নেই, তবু তুমি আছ স্মৃতির শহরে…’ খুব বেশি একটা মিথ্যে বলা হয় না। শান্তনু বিশ্বাস রয়ে গেছেন শ্রুতিতে, স্মৃতিতে, শহরজুড়ে। স্মৃতিময় এই শহর নিয়ে ‘স্মৃতির শহরে’ অ্যালবামটি ছিল শান্তনু বিশ্বাসের গাওয়া গানের শেষ অ্যালবাম আর এই অ্যালবামের শিরোনাম গানটির শেষ পঙক্তি এটি। প্রকাশিত হয়েছিল তিনি অন্যগ্রহের অন্তরালে হারিয়ে যাবার পরে। দেশের খ্যাতনামা মিউজিক কোম্পানি জি-সিরিজ ওঁর গেয়ে রেখে যাওয়া অপ্রকাশিত আটটি গান নিয়ে এই অডিয়ো অ্যালবাম প্রকাশ করে সোৎসাহে, ২০১৯ এর অক্টোবরে। সবক’টি গানই শান্তনুর লেখা, সুর করা আর গাওয়া। গানের অ্যালবামটির নামকরণও তিনিই করে গিয়েছিলেন। ‘স্মৃতির শহরে’। সংগীত ভালোবেসে গান করতেন তিনি। গান লিখতেন, সুর করতেন, গাইতেন; প্রকৃতি আর মানুষ, আর এই দু’য়ের প্রতি তাঁর সংবেদন- একাকার হয়ে যেত শান্তনুর এই সৃষ্টিযজ্ঞে। কবিতার লাবন্যভরা সেইসমস্ত গান, কবিতা আর গানের এক অপূর্ব বলয়ের মধ্যে অনায়াস বিচরণ করে। গানের ভেতর কবিতার সুষমা আর সম্পদকে যতটুকু নিংড়ে বের করা যায়, তিনি তাই করেছেন। এই গানগুলোর মেদহীন ছিপছিপে সৌন্দর্য, এক লহমায় আপন করে নেয়ার গভীর এক টানে টানতো তাঁর গানের শ্রোতাদেরকে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সাত এবং আট-এর দশকে পুরোদস্তুর নাটকেরই মানুষ ছিলেন তিনি। এদিকে সংগীত তাঁর বোধের সঙ্গী হয়ে ছিল কিশোর বয়স থেকে। আর তা ছিল ব’লেই মৌলিক নাটকগুলোতে তিনি সচেতনভাবেই প্রয়োগ করেছেন নিজের গানকে। তবে ২০০০-এর পর থেকে কী এক নিভৃত নিমগ্নতায় ঝুঁকে পড়লেন সংগীতের দিকে; দু’টো দ্বৈত অ্যালবামের পরে ২০০৯-এ প্রথম একক অ্যালবাম ‘চিরকুট’ দিয়ে শুরু করে পঞ্চম অ্যালবাম এই ‘স্মৃতির শহরে’ এসে যাত্রাবিরতি করলেন। আজ এই অ্যালবামের অন্য গানগুলো নিয়ে নয়, কেবল স্মৃতির শহরে গানটি নিয়ে একজন মুগ্ধ শ্রোতার শ্রবণ-অনুভূতি ভাগ করে নেবো লেখাটুকুতে।

এই চট্টগ্রাম ছিল শান্তনু বিশ্বাসের বড় হয়ে ওঠার শহর, বেড়ে ওঠার, ডালপালা মেলবার, আবার সেই ডালপালা গুটিয়ে থিতু হবার শহর। স্মৃতিময় শহর, ‘স্মৃতির শহরে’ গানটির শহর। ফিরে ফিরে দেখা এই শহরের সেইসব বেপরোয়া কিন্তু উজ্জ্বল দিনগুলোকে… ফিরে পেতে চাওয়া ‘পুরাতন হৃদয়’-এর একদা-নবীন সেইসব বন্ধুদেরকে, যাদের কেউ থাকে, কেউ চলে যায়, রেখে যায় পদচিহ্ন, আবার কেউ হয়তো থেকেও থাকে না। শিল্পীর বয়ানে, ‘চট্টগ্রাম শহরেই বড় হয়েছি। প্রতিটি অলিগলি আমার চেনা, বড় হয়ে ওঠার ছোট-বড় সব ঘটনা। কৈশোর কাটিয়ে যৌবন, সে এক মহার্ঘ্য সময়। সেই সময়ের একটা জলছবি ‘স্মৃতির শহরে’। কোতয়ালীর মোড়ে, এক কোণে সাধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, এখনো আছে। সেই দোকান ঘিরে কেটেছে আমাদের বিশাল একটা পর্ব। সময়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কখন মধ্য সকাল দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেত, আমরা ক’জন তখনো ওই দোকানে ঠায় বসা। আড্ডা টেবিল ঘিরে, কেউ চলে যায়, কেউ এসে সেই খালি জায়গা ভরাট করে। সাধুর বিরক্তি, অসন্তোষ, ক্ষোভ তো ছিলই, তার আড়ালে ছিল আদরের প্রশ্রয়। এটা আমরা ঠিকই বুঝতাম। সেই সময়ে ভালবাসার গড়ে ওঠা আর ভেঙে চুরমার হবার ঘটনা তো ঘটতো নিয়তই। পেয়ে হারানো আর হারিয়ে পাওয়া এই আনন্দদুঃখ সম্মিলনে আমার চিরচিহ্নিত ওই সময়ের রেখাচিত্র স্মৃতির শহরে।’

স্রষ্টা-শিল্পী যতটা সুনির্দিষ্ট করে নিজের গানের উৎসমুখ ছুঁয়ে আসতে পারেন, শ্রোতা সেরকমটা, মানে, নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে পুরোটা ব্যাখ্যা করতে হয়তো পারেন না। তবে শ্রোতার ব্যাখ্যা তার নিজস্ব; সে তার নিজস্ব কল্পনার আলোর নিচে গানটাকে রেখে অন্তর্গত ভাবনায় সাজিয়ে নিতে পারে। গানটা শুনতে গিয়ে মনে হতেই পারে, চেনা পথ-ঘাট, রেস্তরাঁ-আড্ডা, পাহাড়ি উঁচুনিচু পথ কাঁপিয়ে জীবনের সাথে সংযোগের প্রতিটি চূড়ান্ত মুহূর্তে শিল্পীর এঁকে দেয়া প্রচ্ছদ ছিঁড়ে ফেলছে এই গান। প্রথমবার শুনে তো মনে হয়েইছিল, চিরকালীন ভালোলাগা সেই গান ‘কফিহাউজের সেই আড্ডাটা’ ফিরে এসেছে কোনো না কোনোভাবে; কারণ এই গানটিও চরিত্রপ্রধান গান, এক একটা চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতি ধারণ করছে। হাজারবছর ধরে হেঁটে আসা পথের স্মৃতিসুখ, বিচ্ছেদবেদনা, নস্টালজিয়া- একইসাথে অসহ রক্তক্ষরণ এবং তীব্র আনন্দে হৃদয়ের গাঁট খুলে দিয়েছে যেন। হয়তো সব চরিত্রই কাল্পনিক, তবু এই গানের সঙ্গে নিজের সংযোগস্থাপনটা সহজ ও মসৃণ হবার অন্যতম কারণ হলো, মানসভ্রমণে চরিত্রগুলোর সাথে যেন সুদূর অতীতে পরিচয় ছিল আর শহরটাও চেনা; সেই চারুকলা, ওয়ার সিমেট্রি, সাধুর দোকান! গানের চরিত্রের সঙ্গে অনেকের জীবনের গল্প মিলে যায় বলেই আমরা, শ্রোতারা বাস্তব জীবনে গানের চরিত্রগুলোকে খোঁজার চেষ্টা করি। শুধু কফি হাউজ নয়, কখনো যেন ‘তোমাকে চাই’ এসেও কড়া নাড়লো, কিছু প্রশ্ন রেখে গেল। পুরাতন হৃদয় কি কেবল পুরাতন বন্ধুদেরকে খুঁজে ফিরছে? নাকি অন্য কাউকে, কিংবা কিছুকে? ‘এত দেরি করে এলে আবার এই শহরে একাত্তরের পরে…’ কে ফিরে এলো একাত্তর’কে পেরিয়ে? কে এই ফিরে-আসা ‘তুমি’?

গানটিতে ছবির মতো করে একটা সময়কে আঁকা হয়েছে আর সম্পূর্ণ সময়ের মধ্যে বিভাজনস্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ‘একাত্তর’। লড়াই, বিচ্ছেদ, একটি পুরনোর শেষ- আরেকটি নতুনের শুরু। ‘তোমার কি মনে আছে, মনে পড়ে, কেমন ছিলে এ শহরে…’ ওই যে একাত্তর’কে পেরিয়ে কেউ একজন ফিরলো এই শহরে, তাকেই তো জিজ্ঞেস করা হলো, স্মরণ করতে পারো সেইসব দিনগুলো? সেই কেউ একজন কে? গানের শেষপ্রান্তের দিকে যত এগিয়েছি, ততই স্পষ্ট হয়েছে, এই ‘তুমি’ বিপিন কিংবা ‘আমাদের মতো’ বোহেমিয়ান বন্ধুদের কেউ একজন নয়। তবে, প্রেমাষ্পদ? না, তাও নয়। ওরকম বিশেষ কাউকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায়নি পুরো গানে কোথাও। বরং নাসরিন আর মোমিনুলকে পেয়েছি নিভৃতে। আড্ডা থেকে বেরিয়ে মোমিনুলের একার প্রহরবিহীন এক প্রতীক্ষা পেয়েছি, অস্ফুট সমর্পণ দেখেছি। যদিও শেষে গন্তব্য-না-জানা পথে হারিয়ে যায় ওদের গন্তব্য। তাহলে কে ফিরলো এই স্মৃতির শহরে! এবার একটু খেয়াল করে শুনি, ‘ তোমার পথ ভাঙাপথগুলো পড়ে থাকে রোদ্দুরে…’ এই পড়ে থাকা পথ, ভাঙাপথ তাহলে কি কোনো স্মৃতিময় সময়কে ইঙ্গিত করলো! নাকি সেই সত্তাকে! একাত্তর যে-সত্তাকে নতুন রূপ দিয়েছে! মুক্তিপাওয়া এক সত্তা। যে ‘তুমি’ স্মৃতি খুঁজে ফিরছে আর যে ‘তুমি’ স্মৃতিতে ফিরে এসেছে, দুই ‘তুমি’ই এই সত্তায় মিলেমিশে এক হয়েছে। বন্ধু-বন্ধু গন্ধমাখা সেই শহরটায় ফিরতে তার একটু দেরি হলো কেবল। সাধুর দোকান, ওয়ার সিমেট্রি, চারুকলা সবই আগের জায়গায় আছে; কেবল আগের সেই ‘এক-কাপ চা ভাগ ক’রে খাওয়া’ মানুষগুলো নেই। আগের সেই তুমিটাও নেই। সময়ের পোশাকে বদলে যাওয়া নতুন ‘তুমি’ তাই নিজেকেই বলছে, ‘তুমি আছ তবু তুমি নেই স্মৃতির শহরে…।’

স্মৃতির শহরে গানটিকে সমকালীন জীবনমুখী গানের দলভুক্ত গানই বলবো। জীবন, লড়াই, প্রাপ্তির আনন্দ, হারানোর বেদনা সবই টুকরো-টুকরো ছড়ানো গানটিতে। হাহাকার শুনেছি, ‘মিসিং’ এর প্রতিশব্দ যদি হয় মন- কেমন-করা, তবে তার আকুতি বেজেছে শান্তনুর গায়কীতে। ‘এলেই যখন, আসবে যখন কেন এত দেরি করে… তোমার, তোমার এই শহরে’ যখন গাইছেন, বেদনা অপার তখন শিল্পীর কণ্ঠস্বরে, যেন বিষাদের কুয়াশামাখা প্রবল এক পাহাড়- তার গা বেয়ে নামছে অজস্র প্রপাত! শান্তনু বিশ্বাস কিছু গানে নিজস্ব একটা সুরের স্টাইল তৈরি করেছিলেন, ‘পোস্টম্যান’ বা ‘পাথরঘাটার ঘন্টা বাজে’ গানটির মতো এই গানটিতেও সেই ধারাটি স্পষ্ট ফুটে ওঠে। ট্রাডিশনের বাইরে এই গানের তাল-লয়, কম-গীতল অর্থাৎ কবিতাধর্মী গানে এই ধারার সুর বসিয়ে গানকে তিনি শ্রুতিমোলায়েম করেছেন।
একটি ভালো গান আলোর মতো ছড়িয়ে যেতে যতখানি প্রচার আর মিডিয়ার সহযোগিতা দরকার, ‘স্মৃতির শহরে’ অ্যালবামটি তা পায়নি ব’লেই এত সুন্দর গানটি কেবল অল্পসংখ্যক শ্রোতার কানের কাছে আর প্রাণের মাঝে বাজে ঘুরেফিরে। এই শহরের গানপ্রেমী শ্রোতাদেরকে আর এই লেখাটির পাঠকদেরকে বলবো, গানটি শুনুন, কেউ কেউ এই গানে নিজেকে খুঁজে পাবেন নিশ্চিত। ইউটিউবে Shantanu Biswas-Smritir Shohore লিখে সার্চ দিলেই খুব চেনা এই স্মৃতির শহরে একবার ঘুরে আসতে পারবেন, নিজের সঙ্গে, হারিয়ে ফেলা বন্ধুদের সঙ্গে…শ্রুতিতে, স্মৃতিতে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরও ৯ মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধএকজন শান্তনু বিশ্বাস তার পার্থিব-অপার্থিব