স্মৃতিতে দৈনিক আজাদী

এ.কে.এম. আবু বকর চৌধুরী | সোমবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ

দৈনিক আজাদীর ৬২তম বর্ষপূর্তি ৫ সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রামের সর্বজন পরিচিত সর্বাঙ্গীন সাদা কাপড় পরিহিত ‘ইঞ্জিনিয়ার সাব’ পরম শ্রদ্ধেয় আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ১৯৬০’র ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর মালিকানাধীন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস হতে ‘দৈনিক আজাদী’ নাম দিয়ে আজকের সর্বজন পরিচিত ও বহুল প্রচারিত এই দৈনিকটি প্রকাশ করেন। সম্পাদক তিনি নিজে, বার্তা সম্পাদক রকিবুল সুলতান ও অধ্যাপক মুহাম্মদ খালেদ (ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মেয়ে জামাই)। রকিবুল সুলতান বেশ লম্বা চওড়া আর সর্বক্ষণ তার মুখে লেগে থাকত চুরুট।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ইন্তেকালের পর (১৯৬২-র ২৫ সেপ্টেম্বর) ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত অধ্যাপক মুহাম্মদ খালেদ সম্পাদক ও ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের একমাত্র পুত্র ২০২২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারী পদকপ্রাপ্ত এম.এ. মালেক হন মালিক।
অধ্যাপক খালেদ ১৯৫০ এর দিকে মুসলিম লীগ রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে রাউজান-হাটহাজারী আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান সরকার (১৯৬৩-৬৫) ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ৮ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদী ১ম পৃষ্ঠায় এক বক্স কলামে লিখেছিলো ‘কাঁদো চাটগাঁবাসী কাঁদো, তোমার ছেলে হেরে গেছে’ তিনি হেরে গেছেন, হারিয়েও গেছেন। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় আমাদের চরম দুঃসময়ের পরম বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে আশ্রয়ে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনাকারীদের মধ্যে সংযুক্ত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের গণ-পরিষদের (১০ এপ্রিল – ১৬ ডিসেম্বর ’৭২) সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের অন্যতম ছিলেন। ১৯৭৩’র ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদের (৭ মার্চ ’৭৩ – ৬ নভেম্বর ’৭৫) নির্বাচনের পুনঃ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর (২৫ জানু ’৭৫) ফলে নতুন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া অনুসারে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা গভর্ণর (মন্ত্রীর পদমর্যাদা) পদে নিযুক্ত হন। তিনি ২০০৩ এর ২১ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ খালেদের মৃত্যুর পর মরহুম ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের একমাত্র পুত্র বিশিষ্ট সমাজসেবী বাবার মত অত্যন্ত মিষ্টভাষী লায়ন্স’র সাবেক জেলা গভর্ণর এম.এ. মালেক সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে দৈনিক আজাদীকে সাবলীলভাবে পরিচালনা করে আসছেন। দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে আজ অবধি একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একনিষ্ঠ সেবক, জনবান্ধব দৈনিক হিসেবে জাতি ও চট্টগ্রামবাসীর সেবা করে আসছে। স্বধীনতা যুদ্ধকালে এর মালিকসহ সম্পাদকমণ্ডলি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কয়েকমাস বন্ধ থাকার পর আবার চালু হয়। ১৯৭৫’র প্রেস আইন অনুযায়ী জাতীয় চারটি বাদে অন্যসব পত্রিকার সাথে দৈনিক আজাদীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে দৈনিক আজাদীই সমগ্র দেশে প্রথম প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬০ থেকে ২০২২ অর্থাৎ সুদীর্ঘ ৬২’র বছরব্যাপী এটি স্বগর্ভে স্বদর্পে সংবাদপত্র জগতে, জাতি ও চট্টগ্রামবাসীর কাছে টিকে রয়েছে একটি ইতিহাস হিসাবে।
এই আজাদী আমাকে লেখক হতে ছাত্র-দলীয় রাজনিিত সমাজকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োজিত হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, এজন্য আমি ধন্য ও কৃতজ্ঞ। এর সাথে আমার দীর্ঘদিনের অনেক স্মৃতি জড়িত। ১৯৭০ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে এতে আমি লিখে চলেছি। রাজনৈতিকগত কারণে সিনিয়র/জুনিয়ার সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, ফিচার সম্পাদক, সহ-সম্পাদকমণ্ডলী, সাংবাদিকসহ কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সাথে এক গভীর সুসম্পর্ক গড়ে তুলে দলীয় সংবাদ পরিবেশনায় ইচ্ছা অনুযায়ী সুবিধা আদায় করেছি। এটা এতই মধুময় স্মৃতি যে যা কখনো ভুলবার নয়।
৬২-র ৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা আন্দোলনের সময় জেএমসেন হলে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের সভার সংবাদটি দৈনিক আজাদীতে দেয়ার দায়িত্ব পরে, আমার উপর আমি তখন সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। সংবাদটি হাতে লিখে রাত প্রায় সাড়ে নয়টার সময় আজাদীয় অফিসে যাই। তখন সম্পাদক ও সাংবাদিকরা নীচের তলায় একটি অল্প পরিসর জায়গায় বসতেন।
আমি সংবাদটি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবক দিলে রকিবুল সুলতান বলে উঠেন – অনেক দেরী হয়ে গেছে- আপনার শালার নিউজ যাবে না। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব (আত্মীয়তার সূত্রে তিনি আমার নিকটবর্তী ভগ্নিপতি) হেসে বলে উঠেন “আজাদীর শালাদের জন্য বের করেছি। খালেদ ওটা প্রথম পৃষ্ঠায় দিয়ে দাও।” খালেদ সাহেব জায়গা নেই বলে জানালে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব একটা সংবাদ কিল করে ওটা দিয়ে দিতে বলেন। আমিতো মহাখুশী। রকিবুল সুলতান সাহেব হেসে উঠে বললেন – শালাত খুব খুশী।
একটি অনুপম স্মৃতি। ৭০-র ১ জানুয়ারি আমি দীর্ঘ এক যুগ (১৯৫৭-৬৯) ধরে ছাত্র রাজনীতি করার পর তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৪৯-৭১) এম.এ আজিজের কাছে দলের সদস্যপদ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগে যোগদান করে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করি। এদিন রাতে বিবৃতিটা প্রকাশের জন্য দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মুহাম্মদ খালেদ সাহেবের হাতে দিলে বেশ আনন্দের সাথে তৎকালীন বার্তা সম্পাদক শ্রদ্ধেয় সাধন ধরের উদ্দেশ্যে বলে উঠেন – “বকর মামা আওয়ামী লীগে এলেন, বিবৃতিটা প্রথম পৃষ্ঠায় ভাল করে দাও।”
পরের দিন (২/০১/৭০) প্রথম পৃষ্ঠায় দু’কলামে “আইয়ুব মোনেম অশুভ চক্রের প্রতি কঠোর হুশিয়ারী” আবু বকর চৌধুরীর আওয়ামী লীগে যোগদান – শীর্ষক সংবাদটি পরিবেশিত হয়।
৬২তম প্রতিষ্ঠালগ্নে দৈনিক আজাদীর সম্পাদক, সকল সংশ্লিষ্ট সম্পাদক, সাংবাদিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জানাই হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ ছোঁয়া ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।
দৈনিক সংবাদপত্রের অপর নাম ইতিহাস, রাজনৈতিক অভিধান, রাষ্ট্রের দৈনন্দিন আর্থ-সামাজিক বাস্তবধর্মী চিত্র। দৈনিক সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি হল ইতিহাসের সত্যায়িত চিরঞ্জীব সাক্ষী। দীর্ঘ ছয় দশকের সময় ধরে দৈনিক আজাদী এক চিরঞ্জীব সাথী হিসাবে ইতিহাসের এক স্থায়ী সুদৃঢ় অবস্থান গড়ে নিয়েছে।
শুভেচছা রইল দৈনিক আজাদী, সম্পাদক, সম্পাদকমণ্ডলী, সাংবাদিকবৃন্দ, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও অগনিত পাঠকবর্গের প্রতি।
লেখক : জীবন সদস্য-বাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২-৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিটাগাং টু দ্য ফোর
পরবর্তী নিবন্ধগ্রন্থের উদ্ভব ও বিকাশ : একটি পর্যালোচনা