স্মরণে শ্রদ্ধায় শিক্ষাবিদ কাঞ্চন কান্তি বড়ুয়া

বিকিরণ বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ২৪ মে, ২০২২ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ


বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক কাঞ্চন কান্তি বড়ুয়া। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি শুক্রবার চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার ১৪ নং বাগোয়ান ইউনিয়নের পাঁচখাইন গ্রামের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা করুণানন্দ বড়ুয়া ছিলেন একজন কবিরাজ। তাঁর (পিতার) ছিল একটা মুদির দোকান। মা কনক চাঁপা বড়ুয়া ছিলেন গৃহিণী। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।

গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ-বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় তাঁকে। উল্লেখ্য পিতৃব্য বিজয়ানন্দ বড়ুয়া ছিলেন সে স্কুলের ড্রয়িং শিক্ষক। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর নিজগ্রাম পাঁচখাইনে নিয়ে এসে তাঁকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী মহামুনি উচ্চ-বিদ্যালয়ে। সেখানে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর আর্থিক অসচ্ছলতায় বন্ধ হয়ে যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে পি.টি. (প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ) -এ পরীক্ষায় সমগ্র চট্টগ্রাম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পাঁচখাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান শিক্ষক নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে রাউজান উপজেলায় প্রথম স্থান লাভ করেন।

কাঞ্চন কান্তি বড়ুয়া ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ধূল্যাছড়ি জুনিয়র হাই স্কুল, বালুখালী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কান্দরা কার্বারীর স্কুলে প্রাইভেট শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করার মাধ্যমে শুরু করেন তাঁর পেশাগত জীবন। পাঁচখাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক হিসেবে সবমিলিয়ে ৩৩ বৎসরসহ সর্বমোট দীর্ঘ ৪০ বছর শিক্ষকতা করে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন তিনি।

মা-বাবা ও ভাই-বোনসহ বিশাল পরিবারের দায়িত্ব পালন ও নিজ গ্রামের বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে মহাব্যস্ত কাঞ্চন কান্তি বড়ুয়া বিশেষ করে পিতার চাপাচাপিতে ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ২৮ বৎসর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কনে ছিলেন রাঙ্গুনিয়া বেতাগী নিবাসী রেবতী মোহন বড়ুয়ার জ্যেষ্ঠ কন্যা ১৪ বৎসর বয়সী বীণাপাণি বড়ুয়া। দীর্ঘ ৬১ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাঁরা দুই ছেলে ও তিন কন্যার জনক-জননী। বড় ছেলে ডা. আশাকিরণ বড়ুয়া বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসক। বড় মেয়ে দীপ্তি বড়ুয়া ও মেজ মেয়ে মল্লিকা বড়ুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ছোট ছেলে বিকিরণ বড়ুয়া একটি এম.পিও ভুক্ত কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। স্নাতক পাশ ছোট মেয়ে সুলেখা বড়ুয়া একজন গৃহিণী।

শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নিয়েও কাঞ্চন কান্তি বড়ুয়া নিজ গ্রামে দীর্ঘকাল টিউশানে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই হতে চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ মোগলটুলীতে দুই ছেলের পরিবারসহ যৌথ পরিবারে বসবাস করতে থাকলেও সব সময় নিজ গ্রাম, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখতেন। গ্রামের ও মেয়েত্রয়ের শ্বশুরবাড়িরসহ অন্য আত্মীয়-স্বজনদের প্রায় সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন। অবশেষে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মে মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে মোগলটুলী মগপুকুরপাড়স্থ মীর মঞ্জিল-২ এর দোতলায় নিজ বাসায় মাত্র তিনদিনের অসুস্থতায় বার্ধক্যজনিত কারণে প্রয়াত হন।

পিতা-মাতা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সবার প্রতি আর সকল আত্মীয়-স্বজনের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও স্নেহ-ভালোবাসা দেখিয়ে এবং যথাসাধ্য সেবা ও দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেন। শিক্ষকতাকে পেশা ও নেশা হিসেবে গ্রহণ করে নিরলস ও নিবেদিত প্রাণ থাকেন। সততা, সত্যবাদিতা, পরোপকারিতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, কর্তব্যপরায়ণতা, কৃতজ্ঞতাবোধ সম্পন্ন, স্বধর্ম-স্বজাতি-স্বপ্রতিবেশী তথা সব মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সবার কল্যাণে নিবেদিত থাকা প্রভৃতি গুণের অধিকারী ছিলেন। দারিদ্রের সাথে নিয়ত সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি দিনে-রাতে মিলিয়ে ৪/৫টি টিউশান করেছেন স্বগ্রামের বহু বহু মুসলিম, হিন্দু ও বড়ুয়া পরিবারে। লেখাপড়া ও জীবিকা চালানোর জন্য কলকাতায় চায়ের দোকানে চাকরি এবং রাঙ্গামাটিতে বন থেকে কাঠ কেটে এনে বিক্রি করেছেন। সেবার অংশ হিসেবে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক শিক্ষার প্রভূত উন্নতিতে অক্লান্ত থেকে একদিনের জন্যও স্কুল তথা চাকুরির দায়িত্ব কামাই করেননি। এমনকি প্রাপ্য ছুটিগুলোও ভোগ করেননি।

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩২ বৎসর সততা নিয়ে ও নি:স্বার্থভাবে নিজগ্রাম পাঁচখাইন সর্বজনীন শান্তিকুঞ্জ বিহার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে সমস্ত দুর্যোগ দুর্বিপাক এড়িয়ে বিহার উন্নয়নে অবদান রাখেন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে স্বস্ত্রীক ভারতে বৌদ্ধতীর্থ স্থানসমূহ ভ্রমণ ও তাজমহলসহ বিভিন্ন দশনীয় স্থান পরিদর্শন করেন। বৌদ্ধতীর্থ ভ্রমণ শেষে রাঙ্গামাটি বন বিহারে গিয়ে সঙ্ঘদান দেন। ৮০ বৎসর পূর্বে তাঁর (কাঞ্চন কান্তি বড়ুয়া) বাবা-মার মানত অনুযায়ী ২৩ মার্চ ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে পটিয়া উপজেলার টেগরপুনি বিহারে সপরিবার ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে বর্তমান মহা সংঘনায়ক অধ্যাপক বনশ্রী মহাথেরর নিকট উপসম্পদা গ্রহণ করেন। স্বধর্মের প্রতি অনুরাগী থেকে বাস্তবভিত্তিক ধর্মচর্চা ও বনভন্তে, বিশুদ্ধানন্দ ভন্তে, প্রিয়ানন্দ ভন্তে প্রমুখের প্রতি চিরকাল শ্রদ্ধাশীল থাকেন।

কাঞ্চন কান্তি বড়ুয়া তাঁর সারা জীবন শিক্ষকতা এবং শিক্ষার উন্ন্‌য়ন ও অসংখ্য আলোকিত কৃতী শিক্ষার্থীর প্রাথমিক শিক্ষার ভিত মজবুত করার স্বীকৃতি স্বরূপ পান অগণিত শিক্ষার্থী ও মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।

তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো সততা। তাছাড়া কর্তব্যপরায়ণতা, সময়নিষ্ঠতা, নিয়মানুবর্তিতা, সুশৃঙ্খলতা অনুসরণীয় আদর্শ। তিনি কখনো পরশ্রীকাতর ছিলেন না। অন্যের সাফল্যে তিনি আনন্দিত হতেন। অপছন্দেরও কেউ যদি মেধাবী হন, বা উন্নতি করেন তিনি তার উদারভাবে প্রশংসা করতেন। সম্মানীয় ব্যক্তি যিনিই হোন তিনি নির্দ্বিধায় শ্রদ্ধা করতেন। অনুপস্থিত কোনো খারাপ মানুষের সম্পর্কেও তিনি সম্মান রেখে কথা বলতেন এবং আমাদেরও তা শেখাতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সত্যবাদী ও স্পষ্টবাদী।

অসাম্প্রদায়িকতা ছিলো তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য গুণ। তাঁর মুখে কোনোদিন ভিন্ন ধর্ম বা ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সমালোচনা বা অশ্রদ্ধা অসম্মানের কথা শুনিনি। আমরাও বেড়ে উঠেছি বা উঠতে পেরেছি কোরআন-পুরানে, পালা-পার্বনে, ঈদ-পূজা মসজিদ-মন্দির-বিহার-গীর্জা আর সবধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবনত থেকে। অনায়াসে অংশ নিতে পেরেছি ওরশ, ঈদ, দুর্গাপূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা আর বড়দিনের অনুষ্ঠানমালায়। তিনি শুধু শিক্ষকতা ও শিক্ষার্থীদেরই ভালোবাসতেন না, তিনি সব মানুষকে ভালোবাসতেন। পরকল্যাণকামী ও সবার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ছিলেন।

আজ তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তিনি যে আদর্শ রেখে গিয়েছেন তা ধারণ করে আমরা জীবন এগিয়ে নিতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। তিনি আমার সকল কাজের মাঝে বা নীরবে শুধু নয় অতি সরবে রয়েছেন।

লেখক: কলেজ শিক্ষক ও নাট্যকর্মী; কাঞ্চন কান্তি বড়ুয়ার সন্তান

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রত্যেক মানুষের একে অপরের সহযোগিতা প্রয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধইসলামের মৌলিক শিক্ষার আলোকে মাইক ব্যবহারে সংযম-সতর্কতা