স্মরণের আবরণে বীরবিক্রম আব্দুল মান্নান

আবু ছৈয়দ ও খন রঞ্জন রায় | বুধবার , ৬ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

আজ ৬ই অক্টোবর বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল মান্নান বীরবিক্রমের প্রয়াণ দিবস। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুতেই আব্দুল মান্নান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার নোয়াগ্রামের অবিবাহিত এই আব্দুল মান্নান পুলিশ বাহিনীতে চাকুরির সুবাদে চট্টগ্রামে থাকতেন। ২৫ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের পাক হানাদার বাহিনী সশস্ত্র আক্রমণ করলে আব্দুল মান্নানও অনুসারীদের সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ করার জন্যে ভারতে গমন করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা ক্যাম্প থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু দিক-নির্দেশনা নিয়ে অস্ত্র-শস্ত্র গোলাবারুদসহ পুনরায় দেশে ফিরেন। সাথে ছিলেন তাঁদের কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার পরবর্তীতে এয়ার ভাইস মার্শাল ও বিমান বাহিনীর প্রধান সুলতান মাহমুদ।
পাক হায়েনাদের আক্রমণে তখন রক্তাক্ত মা-মাটি- দেশ। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার থেকে গোপনে কৌসুলি নির্দেশ আসে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের উত্তর পার্শ্বে হাটহাজারী উপজেলার দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নে অবস্থিত মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করতে হবে। অত্যন্ত বিবেচক ও দুরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল এই লক্ষ্যবস্তু। যেকোন মূল্যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে ধূলিস্যাৎ করতে বুদ্ধিমত্বায় পরিকল্পনা করা হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দু’পাশ দিয়ে ঐতিহাসিক হালদা নদী প্রবাহিত। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে তিনটি ট্রান্সফরমার ছিল। এইগুলো অকেজো-কার্যকারিতাহীন হলে বিঘ্নিত হবে পাক বাহিনীর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরে যুদ্ধাস্ত্রের জাহাজ নোঙরে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। জ্বালানি সরবরাহের অভাব দেখা দিবে; যান চলাচল বিঘ্ন হবে; তাদের তৎপরতা হ্রাস পাবে। যেমন নির্দেশ তেমন কাজ। শুরু হলো অপারেশন সফল ও সার্থক করার পরিকল্পনা। মিনি ক্যান্টনমেন্ট খ্যাত মুক্তিযোদ্ধাদের আবাস ছিল আবুরখিল বড়ুয়া পাড়া। ওখান থেকেই এই ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নেয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। দেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ইস্টার্ন রিফাইনারি ও কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র অক্ষত রাখার কৌশল অবলম্বন করা হয়। নানা হিসাব-সমীকরণে মদুনাঘাটকে বেছে নেয়া হয়। উক্ত অপারেশনে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল পঁয়ত্রিশ জন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রত্যক্ষভাবে রেকি করেন। চতুর্পার্শ্বের শত্রুদের অবস্থান, মুক্তিযোদ্ধাদের পজিশন ও নিরাপদে ফিরে আসার জায়গাটি দেখে আসেন। সর্বাত্বক গোপনীয়তায় অপারেশন যেন নির্ভুল নিশানায় হয় এবং যোদ্ধারা যেন নিরাপদে বীরদর্পে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন, এই ব্যবস্থার অংশ এই রেকি।
৬ই অক্টোবর ১৯৭১, অপারেশনের তারিখ নির্ধারিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় রাউজান উপজেলার আবুরখিল বড়ুয়াপাড়া থেকেই হালদা নদী পার হয়ে শত্রুর নিশানায় এই নির্ধারিত-নির্দেশিত অপারেশনটি সফল করা হবে। ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলের মূল অপারেশন কমান্ডার ছিলেন সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান সেই সময়ের স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। সবাইকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। একটি গ্রুপ থাকবে পার্শ্ব-নিরাপত্তা অপারেশনে। একটি গ্রুপ থাকবে মূল অপারেশনে। আরেকটি গ্রুপ কভারিং গ্রুপ হিসাবে। যুদ্ধবিদ্যার অংশ হিসাবে গেরিলারীতি অনুযায়ী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাতের পূর্ব মুহুর্তে দায়িত্ব বিলিবণ্টন করা হয়। একানেও তাই হয়েছিল। কমান্ডার ফায়ার সংকেত দেয়ার পরপরই কভারিং গ্রুপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্চ লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেবে। টার্গেট গ্রুপ তৎক্ষণাৎ মূল পয়েন্ট, ট্রান্সফরমার আক্রমণ করবে। প্রধান হিট টার্গেট গ্রুপের প্রধান ছিলেন শহীদ আব্দুল মান্নান বীরবিক্রম। তাঁর হাতেই ছিল একমাত্র রকেট লাঞ্চারটি। সবার আগে ছিল স্থানীয় পথপ্রদর্শক, যা আগে থেকেই ঠিকঠাক করা ছিল। আবছা অন্ধকারে দূরের সবকিছু দেখা যায়। তাই বিশেষ বাড়তি সতর্ক ছিল। তাঁদের কাছে মাত্র দুইটি ভারি অস্ত্র- ১টি আর.টি.এল, ১টি এল.এম.জি, আর কিছু এস.এল.আর, এস.এম.সি ও কিছু রাইফেল। সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছিল কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড। নির্ধারণ করা ছিল রকেট লাঞ্চারটি চালাবেন আব্দুল মান্নান। এর আগে অভিজ্ঞ দুইজন নৌকার মাঝি ঠিক করা ছিল। তারা দীর্ঘদিন হালদা নদীর জোয়ার-ভাটার সাথে তাল মিলিয়ে নৌকা চালাতে অভ্যস্ত।
রাত আনুমানিক ২টা। সবাই তৈরি। ভাটার সময় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা দুইটি নৌকায় উঠে রওনা হন। মদুনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে নৌকা থেকে নেমে পড়েন। সেখান থেকে অল্প হেঁটে ও ক্রলিং করে নির্দেশিত যাঁর যাঁর অবস্থানে অবস্থান নেন। এই ধরণের অপারেশনের সময় ক্রলিং করে শত্রুর কাছাকাছি যাওয়া ভয়ঙ্কর বিপদ ও মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। রাতের শেষভাগ। মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক দৃষ্টি। পরিকল্পনা মত অধিনায়ক প্রথমে ফায়ার ওপেন করে সংকেত দেন। সাথেসাথেই আব্দুল মান্নান তাঁর রকেট লাঞ্চার দিয়ে মূল টার্গেটে নির্ভুল আক্রমণ করেন। প্রথম গোলায় তিনটি ট্রান্সফরমার ধ্বংস হয়ে যায়। মুহুর্তেই পাল্টা আক্রমণ করে পাকবাহিনী ও তাঁদের দোসর রাজাকাররা। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পাহারারত ছিল প্রায় ১০০ পাক বাহিনীর সৈন্য ও কিছু রাজাকার। চতুর্দিকে কাঁটাতারের বেড়া ও বাঙ্কার । মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে এই পরিস্থিতি অধিক বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। গুলির খৈ ফুটে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্দিকে। আব্দুল মান্নান ও তাঁর দলের সাথীরা অসামান্য সাহসিকতায় পাক বাহিনীকে পাল্টা জবাব দিতে থাকে। দুঃসাহসিক অসম এই যুদ্ধে আব্দুল মান্নান এককভাবে অসামান্য বীরত্বের পরিচয় দেন। তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি গুলি এসে আব্দুল মান্নানের পেটে লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাঁকে উদ্ধার করে বড়ুয়া পাড়ার আস্তানায় আনা হয়। যথাসম্ভব শুশ্রুষা করা হয়। অধিক রক্তপাত আর উন্নত চিকিৎসা সুবিধাবিহীন আব্দুল মান্নান বড়ুয়া পাড়ার গোপন আস্তানায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তখন গ্রামের চতুর্পাশে পাক বাহিনী আর তাঁদের দোসর রাজাকাররা তাণ্ডব চালাচ্ছিল। পাশের কেরাণীরহাট গ্রামের হিন্দুপাড়ায় আগুন ধরিয়ে দেয় পাকসেনারা। এমতাবস্থায় বীর আব্দুল মান্নানের লাশ নিয়ে বিপাকে পড়েন সহযোদ্ধা এবং আবুরখিল গ্রামের বড়ুয়া গ্রামবাসী। শেষে গোপনে, অতি সংগোপনে পুরো এলাকার ঝুঁকি নিয়ে কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদের ইমামতিতে পাঁচজনের অংশগ্রহণে নামাজে জানাজা পড়ানো হয়। এর প্রায় দু’দিন পর রাতের অন্ধকারে হালদা নদীর শাখা ঢাকাখালি খালের উত্তর-পূর্ব পাড়ে ঝোঁপজঙ্গল ঘেরা এক বড়ুয়া কৃষিজীবীর জমির কোণায় সমাহিত করা হয়। ১৯৭২ সাল থেকে উক্ত স্থানটি সুনির্দিষ্ট করে ঘিরে রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও বৈরী পরিবেশ অতিক্রম করে এতদিনেও এখানে কোন স্থাপনা তৈরি করা হয় নাই।
৬ই অক্টোবর যুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত মদুনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংরক্ষিত স্থান এবং বীরবিক্রম আব্দুল মান্নানের অবহেলিত চিহ্নিত কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন কয়েকজন সহযোদ্ধা। বীর মুক্তিযোদ্ধা নজির আহমদ চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ছৈয়দ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় বড়ুয়া সাথে নবীনগরের বাসিন্দা লেখক খন রঞ্জন রায়। এই দলকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ প্রসাদ বড়ুয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা বিদ্যুৎ বড়ুয়া, জগদীশ বড়ুয়া, রনজিত বড়ুয়া, মিন্টু বড়ুয়া প্রমুখ।
নির্ভুল মদুনাঘাট অপারেশন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে অবিস্মরণীয় সাফল্য। এই সফলতার ঢেউ সারা বাংলাদেশের মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে দ্বিগুণ চাঙ্গা করে তোলে। পরবর্তীতে সরকার মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শহীদ আব্দুল মান্নানকে মরণোত্তর বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করেন। তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩৬। এই বীরের কবর চরম অবহেলার শিকার। প্রতিদিন জোয়ারের সময় ডুবে যায় স্মৃতিচিহ্নটি। ওখানে পরিদর্শনের কোন রাস্তা নেই। গভীর জঙ্গলাকীর্ণ ঝোঁপঝাড় আর জমির আইল পেরিয়ে তবেই খালপাড়ের পূঁতি দুর্গন্ধময় এই সমাধিস্থল। অথচ রাউজান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, মাননীয় সাংসদ, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ একটু নজর রাখলেই একজন বীরবিক্রম উপাধিপ্রাপ্তর কবর যথাযথ মর্যাদার সাথে আগলে রাখতে পারতেন। এই বীরের রক্তের স্রোতে হালদা নদীর পানি লাল হয়েই আজ “স্বাধীন বাংলাদেশ”।
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়েরও এই ব্যাপারে উদাসীনতা কাজ করছে। তাঁদের বাৎসরিক বিপুল বাজেট থাকার পরেও এই দায়িত্ব পালনে শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে। নিকট অতীতে দেশের স্বনামখ্যাত বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এখানে দর্শন দেয়ার নজির আছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আমরা যথাশীঘ্রসম্ভব অকুতোভয় এই বীরবিক্রম মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থলে দৃষ্টিনন্দন সৌধ নির্মাণের দাবি জানাই।
লেখক : আবু ছৈয়দ-মুক্তিযোদ্ধা ও খন রঞ্জন রায়-
প্রাবন্ধিক-সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু : মুহাম্মদ আনোয়ার আল-সাদাত
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে