দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৬ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেশ রাত অব্দি ঘুমাতে পারছিলাম না। চোখ বুজলেই কেএফসির বোবা বধির মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কি যে সুন্দর এক একজন মানুষ। অথচ তাদের মুখে ভাষা নেই, কারো কারো কানেও নেই শক্তি। আহা, কি যে কষ্ট! কি কষ্টের জীবন! আমি নিজেকে ওদের অবস্থানে দাঁড় করালাম! যদি আমিও তাদের মতো হতাম! যদি আমিও কানে না শুনতাম, কথা বলতে না পারতাম! কলজে মুচড়ে উঠলো। অথচ মানুষগুলোর যেন কোন কষ্ট নেই। তারা নিজেদের মতো করে সবকিছু করছেন। কেএফসির মতো প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। হাসছেন, খেলছেন, খুনসুটিও করছেন। আবার দায়িত্বের ব্যাপারেও তারা দারুণ সচেতন। খাবার সার্ভ করছেন। কারো সহায়তা লাগলে হাত বাড়াচ্ছেন, খাবার ভর্তি ট্রে টেবিলে সাজিয়ে দিচ্ছেন। যতটুকু জানলাম বেশ ভালোই স্যালারি তাদের। আমার মনে হলো, এরা পরিবার বা সমাজের বোঝা নয়, সম্পদে পরিণত হয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো পুরো পরিবারের হাল ধরেছেন। এদের পরিবার পরিজন, স্ত্রী সন্তান সবই হয়তো আছে। হয়তো কেউ নেই। তাদের পারিবারিক অবস্থা কেমন তা জানা হয়নি। তবে মনে মনে নানাভাবে নানাকিছু কল্পনা করছিলাম। নিজের মতো করে বহুকিছু সাজিয়েও নিচ্ছিলাম।
কেএফসি কর্তৃপক্ষকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম আমি। তারা এমন শারিরীক প্রতিবন্ধী কিছু মানুষকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসাার যেই উদ্যোগটি নিয়েছেন তা আসলেই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। সমাজের অবহেলিত মানুষগুলোকে কাজে নিয়োগ দিয়ে, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়ে তারা শুধু সামাজিকই নয়, বড় ধরনের মানবিক কাজও করেছেন। কেএফসির দেখাদেখি যদি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এভাবে এগিয়ে আসে তাহলে সমাজে নানাভাবে কষ্টে থাকা মানুষগুলো কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। বিভিন্নভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষগুলো পথের হদিশ পাবে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোকেও এভাবে সমাজের মুল স্রোতে নিয়ে আসা গেলে সমাজ উপকৃত হতো। অবহেলিত মানুষগুলো জনসম্পদে পরিণত হলে শুধু তারাই নয়, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র উপকৃত হয়।
নানাকিছু ভাবছিলাম। কত কিছু যে মনে হচ্ছিল। আহা,আমাদের অতৃপ্তির যেন শেষ নেই। কত কিছুর জন্যই অন্তর হাহাকার করে। একটি সুন্দর গাড়ি, একটি সুন্দর বাড়ি, ব্যাংকে কাড়ি কাড়ি টাকা আরো কত কি! কত্ত কিছু চাই আমরা! অথচ শুধু মুখের ভাষা কিংবা কানের শক্তি থাকার তৃপ্তির সাথে যে জগতের কোনকিছুর তুলনা চলে না তা যেন নতুন করে দেখতে পেলাম আমি! চোখের দৃষ্টি যদি না থাকতো! কলজেটা বার বার মুচড়ে মুচড়ে উঠছিল!
নানা কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। রাতে কি কি সব স্বপ্নটপ্নও দেখেছিলাম। সকালে ড্রাইভারের ফোনে ঘুম ভাঙ্গলো। এত সকালে ড্রাইভার কেন ফোন করলেন! তড়িঘড়ি করে ফোনটি রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতে মনে পড়ে গেলো যে, আজ আমাদের শান্তিনিকেতন যাওয়ার কথা রয়েছে। আহা, শান্তিনিকেতন! স্বপ্নের শান্তিনিকেতন, শান্তির শান্তিনিকেতন! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আশা আমার বহুদিনের। কত আশা যে একবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে ছাতিমতলায় বসে থাকবো, বাউলের গান শুনবো, উপজাতীয় নারী পুরুষের সাথে গল্প করবো, মাটির কাপে চা খাবো, নদীর পাড়ে অলস সময় কাটাবো। কবিগুরু যেখানে যেখানে ঘুরতেন, সময় কাটাতেন তা নিজের চোখে দেখবো। কতবার কলকাতা এলাম, নানাস্থানে ঘুরলাম, কিন্তু একবারও শান্তিনিকেতনে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। কতবার কতভাবে উদ্যোগ নিলাম। কিন্তু শেষতক ‘ব্যাটে বলে’ গোলমাল লেগে যেতো, হতো না। প্রতিবারই আশাহত হয়ে আমি কলকাতা থেকে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের ফ্লাইট ধরতাম। এবার শুরু থেকে আমি তক্কে তক্কে ছিলাম। আমাদের ট্যুর প্ল্যানে কলকাতার জন্য চারদিন সময় রাখা হয়েছে। কিন্তু চারদিন কলকাতায় আমি করবোটা কী! অতএব শান্তিনিকেতন এবার আর মিস হবে না। চারদিনের যে কোন একদিন আমি ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথে’ ছুটবোই! আগে অনেকবার কলকাতা আসলেও স্ত্রী সাথে ছিল মাত্র দুইবার। ওই দুইবার এতই ব্যস্ত ছিলাম যে, কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অবশ্য একবার সুশান্ত দাদা এবং ডালিয়া বৌদি কি কি সব আয়োজন করে দিলেও শেষতক কোন এক ধর্মঘটের কারনে ‘মিশন শান্তিনিকেতন’ বাতিল করতে হয়েছিল। এবারও সাথে ঘরনি আছে। রবীন্দ্রপ্রেমি প্রিয়তমাকে নিয়ে রবি দাদুর শান্তিনিকেতনে চক্কর দেয়ার সুযোগটি তাই আমি কোনভাবেই হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলাম না। কারন আমি জানি যে, রবীন্দ্রনাথের কি পরিমান অনুরক্ত আমি। তবে এটুকুও জানি যে, আমার চেয়ে কয়েক হাজারগুন বেশি অনুরক্ত হচ্ছে আমার ঘরনি। সকাল দুপুর রাতে সে যখনি গুনগুন করে তখনি ভেসে আসে রবীন্দ্রনাথের সুর। আহা, কি যে মুগ্ধতা চারদিকে! রবি ঠাকুরের কত গান, কত কবিতা যে আমার স্ত্রীর মুখস্ত তার প্রকৃত সংখ্যা আমার জানা নেই! ঘন্টার পর ঘন্টা সে এগুলো আওড়াতে পারে। অবশ্য আমি শুধু একটি গানে তার সাথে গলা মিলানোর চেষ্টা করি! প্রাণখুলে গাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু কখনোই সে পুরো গানটি শেষ করে না। আভোগ বা শেষ প্যারাটা বাদ দিয়ে গায়। যেখানে রবি দাদু তাঁর প্রেমিকাকে অন্যকারো কাছে চলে যাওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন সেখানেই আমার ঘরনি চুপ করে যায়। আমি বেশ মজা পাই, গলায় নতুন জোর পাই।
মাঝেমধ্যে রবি দাদুকে দারুণ হিংসেও হয় আমার। একজন মানুষ কি করে যে এত কাজ করলেন! এত কথা বললেন, কি করে যে এত কিছু লিখলেন? মাত্র একজীবনে এত কিছু করা কি করে সম্ভব হলো? গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছবি আঁকা, অভিনয় করা আরো কত কত্ত কি! কি করেননি তিনি! মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, আমার বাবা যা বলে আমার মায়ের মান ভাঙ্গিয়েছেন, যা বলে আমি আমার স্ত্রীর মান ভাঙ্গাই, আমার সন্তানেরাও অবলীলায় সেসব ব্যবহার করবে। একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে কি করে একজন মানুষ এমন উচ্চতায় আসীন থাকতে পারেন তাও আমার মাথায় ঢুকে না। কি করে যে তিনি ঘরে ঘরে এত অনুরক্ত সৃষ্টি করে গেলেন, কি করে এত ভক্ত তৈরি করার মতো লিখা লিখতে পারলেন তা নিয়ে ভেবে আমি কোন কুলকিনারা পাইনা। কি করে সম্ভব! কি অসাধারণ গুন, কী অসাধারণ শক্তি, কী অসাধারণ যোগ্যতা! ‘গড গিফটেড’ মনে হয় একেই বলে! বছরের পর বছর ধরে আমি কত ছাইপাস লিখি, কিন্তু আমার একটি লেখাও প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখস্ত নেই, অথচ রবি ঠাকুরের অগুনতি কবিতা গান তার মুখস্ত। আমার প্রকাশিত তিনটি বই ঘরের কোনায় অযত্নে অনাদরে পড়ে থাকে, অথচ রবীন্দ্র রচনাবলী প্রায়শঃ টেবিলে বা বিছানায় বালিশের পাশে থাকে। আমার অতি রবীন্দ্রপ্রেমি স্ত্রীকে শান্তিনিকেতন দেখানোর সুযোগটি পেয়ে যাওয়ায় বেশ বর্তে যাচ্ছিলাম।
আগের দিন আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের কাছে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘স্যার চলেন, শান্তিনিকেতন দেখে আসি। কোনদিন যাইনি।’ স্যার বললেন, ‘আমরা আগে অনেকবার গিয়েছি। এবার আর যাবো না। তোমরা ঘুরে আস।’ স্যার পরামর্শ দিলেন যে, ‘খুব সকালে যাত্রা করবে, নাহয় সবকিছু দেখে দিনে দিনে ফিরে আসতে পারবে না।’ অবশ্য কেউ কেউ ট্রেনে চড়ে শান্তিনিকেতন ভ্রমনের আলাদা একটি মজা আছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। তারা আমাদেরও ট্রেনে চড়ে বাউলদের গান শুনতে শুনতে শান্তিনিকেতন ঘুরে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এডিটর স্যার বললেন,
‘ ট্রেনে অনেক ঝামেলা হবে। কখন ট্রেন ছাড়বে, কখন যাবে, সিট পাবে, পাবে না। তার থেকে গাড়ি নিয়ে চলে যাও। নিজেদের মতো করে আসা যাওয়া করতে পারবে। ফেরার বা ট্রেন ধরার টেনশনে রবি দর্শনের ব্যাঘাত ঘটবে না। স্যারের কথাটি আমার মনে ধরে। নিজেদের গাড়িতে যাওয়া আসার অন্যরকমের একটি স্বস্তিও সবসময়ই থাকে। অতএব আমি ড্রাইভারকে ওভাবে বলে রেখেছিলাম। আর আমারই নির্দেশনায় সাতসকালে ড্রাইভার এসে হাজির হয়েছেন। ‘আসছি’ বলে দ্রুত তৈরি হতে শুরু করলাম আমরা। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে বীরবিক্রম আব্দুল মান্নান
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ