প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৬ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

বুখারা দরবেশের সন্তানের প্রতি অছিয়ত

বৃহত্তর বুখারায় শায়িত রয়েছেন বিশ্বখ্যাত ইমাম সুফি দরবেশ হযরত মাওলানা আবদুল খালেক গাজদাওয়ানী (রহ.) । তিনি তাঁর সন্তানের প্রতি যে অছিয়ত রেখে গেছেন তা একালে ধর্মীয় জগতে ভাবিয়ে তুলবে। তিনি বলে গেছেন- হে বৎস! তোমাকে অছিয়ত করতেছি-
তাকওয়া ও পরহেজগারীকে তোমার অভ্যাসে পরিণত করবে। হালাল বস্ত্র পরিধান করবে।তাহলে এবাদতে শান্তি অনুভব করবে। দলিলের মধ্যে তোমার নাম দেখনা। ইমাম ও মুয়াজ্জিন হবেনা। কখনও জামাত ত্যাগ করবে না। কাজীর (বিচারক) কাচারীতে হাজির হবে না। বাঘ হতে পলায়নের মত মানুষের সঙ্গ পরিহার করবে।
সর্বদা অবিকৃত হতে চেষ্টা করবে। নফসকে অপমান করতে ও কষ্ট দিতে সফর করবে। কোন লোক তোমার সহিত অসৎ ব্যবহার করলে চিন্তিত হবে না। কারও প্রশংসায় গর্বিত হবে না। মানুষের সহিত ভাল ব্যবহার করবে। যেখানে যে অবস্থায় থাক আদবের সহিত থাক। সমস্ত সৃষ্টি জগতের প্রতি দয়া মুহব্বত রাখবে। আল্লাহ পাকের আজাবকে ভয় করবে। তাঁর রহমত হতে নিরাশ হবে না।
বিশ্বে তরীকত জগতে অন্যতম ইমাম হযরত আবদুল খালেক গাজদাওয়ানী। তাঁকে গাজদাওয়ানী সিলসিলার ইমামও বলা হয়ে থাকে। অপরদিকে তিনি নক্‌শবন্দিয়া সিলসিলার প্রধান ব্যক্তিত্ব। সে যুগের শাইখগণের শাইখ। মুজতাহিদ ও কুতুব ছিলেন। ছিলেন ইমাম মালেক (রহ.)’র বংশের উজ্জল নক্ষত্র। তাঁর মাতা ছিলেন রোম বাদশাহর বংশদ্ভূত। তাঁর পিতাও ছিলেন আউলিয়াগণের মধ্যে অন্যতম।
হযরত গাজদাওয়ানী হযরত ছদরুদ্দীন (রহ.) থেকে পবিত্র কুরআন মাজীদের তাফসীর শিক্ষা লাভের সময় আরও শিক্ষা লাভ করেন- তোমার প্রতিপালককে নীরবে কেঁদে কেঁদে ডাক। তিনি সীমা লঙ্ঘনকারীদেরকে ভালবাসতেন না।
যিকিরকারী যদি উচ্চস্বরে ডাকেন কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নড়াচড়া করেন,তাহলে তাকে নীরবে বা গোপনে ডাকা হল না। আর যদি দিলের দ্বারা যিকির করা হয়, তাও শয়তান অবগত হয়। কারণ হাদীস শরীফের বর্ণনা মতে, শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরা এবং রক্তের সহিত মিশে আছে।
একবার এক দরবেশ তাঁর থেকে জানতে চাইলেন হযরত আলেমের শাস্তি কাকে বলে? উত্তরে তিনি বলেন আলেম যখন আখিরাত তালাশ ছেড়ে দিয়ে দুনিয়ার তালাশে মশগুল হয় তখন আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়াতেই শাস্তি দেন। এর ফলে উক্ত আলেমের এবাদত বন্দেগীতে মিষ্টতা, লজ্জত এবং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের তাবেদারী ছিনিয়ে নেয়া হয়।
হযরত আবদুল খালেক গাজদাওয়ানী তিনটি কাজ থেকে বিরত থাকতে সাবধান করেন-
১. উত্তম খানা পিনা
২. আমির বাদশাহ সাথে উঠাবসা না করা।
৩. উত্তম পোশাক পরিধান না করা।
একালে তরিক্বতসহ ধর্মীয় জগতে অবস্থানকারীর সংখ্যা কোটি কোটি। কিন্তু হযরত আবদুল খালেক গাজদাওয়ানীর সন্তানের প্রতি অছিয়ত এবং নিজের আদর্শ চরিত্র নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। আরও ভাবতে হবে দুনিয়া-আখিরাত সমান্তরালে চলতে পারে না; এ নিয়ে যেহেতু আমাদের কোন একটাকে বেছে নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, হযরত সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী (রহ.), যিনি পশ্চিমবঙ্গের ফুরফুরায় ১৯১২ সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি নিজের বংশধরদের প্রতি অছিয়ত রাখেন: পীরি-মুরিদির সাথে মক্তব-মাদ্‌রাসার নামে চাঁদা আদায়, যাকাত-ফিতরা ভিত্তিক অর্থ সংগ্রহ, তাবিজের নামে উপার্জিত অর্থ পরিহার করে বৈধ ব্যবসা-চাকুরীর পথই উত্তমপন্থা।
তিনি আরও বলে গেছেন, তোমার যদি ফকিরী বাসনা জাগে, তাহলে চোখ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে অন্ধ ভাবতে হবে, কান থাকা সত্ত্বেও বধির বনে যেতে হবে, জিভ (জিৎবা) রয়েছে, তবুও বোবা সাজতে হবে।
হযরত সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী বান্ডেল শরীফ হুগলির মোজাদ্দেদীর সিলসিলার পীর ছাহেব হন সুফি গোলাম সালমানী (রহ.)।
বাস্তবতার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ১৯৮০ এর দশক থেকে অতি দ্রুততার সাথে কলুষিত পরিবেশের বিস্তার লাভ করে। হাজারে কয় জনই বা হালাল-হারাম পার্থক্য করে চলতেছে। হাজারে কয়জনই বা প্রতি হিংসা স্বজন প্রীতি থেকে মুক্ত। ফলে এ কালে তরিক্বত সুফি দরবেশগণের উপর সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধ দ্রুততার সাথে কমে গেছে। এতে আহলে হাদীস তথা সালাফীগণের মতাদর্শ ব্যাপকতা লাভ করছে।
হযরত আবুদল খালেক গাজদাওয়ানীর পীর হচ্ছেন হযরত খাজা আবু ইউসুফ হামদানী, ইরানের হামদানে। তাঁর পীর হচ্ছেন হযরত আবু আলী ফারমীদী তুসি, ইরানের তুস নগরে। তাঁর পীর হচ্ছেন হযরত আবুল হাসান খেরকানী (রহ.) (ইরানের বোস্তাম শহরের ১৫/১৬ কি.মি দূরত্বে খেরকান অঞ্চলে পাহাড়ের উপর)। তাঁর পীর হচ্ছেন হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) (ইরানের বোস্তামে)। তাঁর পীর হচ্ছেন হযরত ইমাম জাফর ছাদেক (রহ.) মদিনা শরীফের জান্নাতুল বাকীতে শায়িত।
অপরদিকে বৃহত্তর বুখারায় শায়িত হযরত গাজদাওয়ানীর খলিফা হযরত আরেফ রেওয়াগারী এবং তাঁর খলিফা হযরত মাহমুদ আঞ্জির ফাগনবী, তাঁর খলিফা হযরত আজিজান আলী রামিতিনী, তাঁর খলিফা হযরত মুহাম্মদ সামমাসী, তাঁর খলিফা হযরত সৈয়দ আমির কুলাল অতঃপর বাহাউদ্দিন নক্‌শবন্দ (রহ.)।
হযরত আবদুল খালেক গাজদাওয়ানী থেকে হযরত বাহাউদ্দিন নক্‌শবন্দ (রহ.) পর্যন্ত সাত জন দরবেশ বৃহত্তর বুখারায় ২০/৩০ বর্গ কি.মি এরিয়ার মধ্যে শায়িত। প্রত্যেকের মাজার ১৫/২০ একর বা ২০/৩০ একর এরিয়া নিয়ে। এসব মাজারে রয়েছে মেহমানখানা গেস্ট হাউস, মিউজিয়াম, সাথে মসজিদ ও মসজিদের মিনার। বাহিরে গেইটের পাশে কয়েকটি দোকান ও ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট। মাজার কমপ্লেক্সে জায়গায় জায়গায় ফুলের বাগান। ২/৪ জন বা ৫/৭ জন বসতে পারে মত হেলানি টুল। সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সুন্দর পরিবেশে।
যেয়ারত:
২০১৯ সালের নভেম্বরের শুরুর দিকে ৮ দিন ব্যাপী উজবেকিস্তান সফর করার সুয়োগ হয়। ঐ সময় ৩ রাত বুখারা অবস্থানকালে ২য় দিন সকালে হযরত আবদুল খালেক গাজদাওয়ানীর যেয়ারতে আসা হয়। যা মুল বুখারা শহর থেকে ২০/৩০ কি.মি দূরত্বে। প্রায় ২০-৩০ একর এরিয়া নিয়ে তাঁর মাজার কমপ্লেক্স। এখানে তাঁর মাজারের পাশাপাশি যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে নানান আয়োজন রয়েছে। তৎমধ্যে মসজিদের পাশাপাশি গেস্ট হাউস, মিউজিয়াম ইত্যাদি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধঅ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের জন্য এলো নেটফ্লিক্সের ‘প্লে সামথিং’