স্বাস্থসেবার সুদিন ফিরবে?

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণ বাকলিয়া নুরুল ইসলাম বিএসসি মাতৃসদন হাসপাতাল ও পূর্ব বাকলিয়া ওয়াইজ খাতুন মাতৃসদন হাসপাতাল। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) পরিচালিত ৫০ শয্যার হাসপাতাল দুটিতে একসময় প্রসূতি মায়েদের ভিড় লেগে থাকত। এখন ভিড় থাকে না। এমনকি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে হাসপাতাল দুটির অভ্যন্তরীণ সেবা বন্ধ আছে। বন্দরটিলা নগর মাতৃসদন হাসপাতাল ও মোহরা ছাপা মোতালেব নগর মাতৃসদন হাসপাতালও চসিক পরিচালিত। নষ্ট হয়ে আছে হাসপাতাল দুটির লিফট। এর মধ্যে বন্দরটিলা মাতৃসদনে পঞ্চম তলায় দেওয়া হয় প্রসূতিদের চিকিৎসাসেবা। লিফট নষ্ট থাকায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে দুর্বিষহ কষ্ট হচ্ছে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা প্রসূতিদের।
চারটি হাসপাতালের চিত্র থেকে স্পষ্ট হয়, চসিকের স্বাস্থ্যসেবা কোন পর্যায়ে আছে। অথচ একসময় সমৃদ্ধ অতীত ছিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের। অব্যবস্থাপনা ও অবহেলাসহ নানা সংকটে ধীরে ধীরে সেবার গৌরব হারিয়েছে বিভাগটি। এ অবস্থায় ঘনিয়ে আসছে চসিক নির্বাচন। তাই স্বাভাবিকভাবেই নগরবাসীর প্রশ্ন, হারানোর গৌরব ফিরাতে পারবেন নতুন মেয়র? স্বাস্থ্য বিভাগকে এগিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ পরবর্তী মেয়র নেবেন?
চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চসিকের ১০০ শয্যার একটি মেমন মাতৃসদন হাসপাতাল, ১০০ শয্যার একটি জেনারেল হাসপাতাল, ৫০ শয্যার তিনটি মাতৃসদন হাসপাতাল, ৫৩টি দাতব্য চিকিৎসালয় ও নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৩৩৫টি ইপিআই টিকাদান কেন্দ্র, ১০টি হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় রয়েছে। গত ৫ বছরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো থেকে ৫৫ লক্ষ ৫৪ হাজার ২৭৯ জন স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪ লক্ষ ৭৪ হাজার ৭২৫ জন ইপিআই থেকে সেবা নিয়েছেন। প্রতি বছর চসিককে ১৩ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয় স্বাস্থ্য বিভাগে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চসিক পরিচালিত ৫৩টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবকাঠামোগত নানা সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবন জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। টয়লেটের অবস্থাও বেহাল। কোনোটিতে আছে পানির সমস্যা, কোনোটিতে বিদ্যুতের। চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট তো আছেই।
সিটি কর্পোরেশন মেমন মাতৃসদন হাসপাতালটিও নানা সমস্যায় জর্জরিত। হাসপাতালটির যেসব কেবিন রয়েছে তার বেশিরভাগের এসি নষ্ট। টাইলস উঠে গেছে। এ হাসপাতালের টয়লেটগুলোর অবস্থা সবচেয়ে বাজে। এছাড়া প্রয়োজনীয় সার্জিক্যাল বা মেডিকেল যন্ত্রপাতিরও অভাব রয়েছে সেখানে।
স্বাস্থ্যবিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জনবলের অভাব আছে। কর্মরতদের স্থায়ী না করায় মনোবল হারিয়েছেন তারা। ২০১৫ সালের একটি অর্গানোগ্রামে ১৫০টি পদ খালি থাকলেও পূরণ করা হচ্ছে না। এমনকি ১৯৮৮ সালের অর্গানোগ্রামেও খালি আছে ১৮ মেডিকেল অফিসারের পদ।
চসিকের আরবান স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভবন নির্মাণ করে এডিবি। তাদের শর্ত ছিল শুধুমাত্র সেখানে চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস করা হয়েছে। পরিচ্ছন্ন এবং বিদ্যুৎ বিভাগেরও দখলে আছে কোনোটি। এতে বসার জায়গা পাচ্ছেন না স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক এবং রোগীরা। ফলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে রোগীরা।
আতাউর রহমান খোকন নামে বন্দরটিলা এলাকার এক বাসিন্দা আজাদীকে বলেন, একসময় সিটি কর্পোরেশনের মেটারনিটি হাসপাতালগুলো প্রসূতি মায়েদের সেবা প্রদানে নগরবাসীর আস্থা অর্জন করেছিল। পরবর্তীতে নানা কারণে সে সুনাম আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
প্রশাসক কী বলেন : চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন আজাদীকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা একসময় খুব সাদামাটা ও ঢিলেঢালা ছিল। মহিউদ্দিন চৌধুরী এটা সমৃদ্ধ করে উঁচু স্তরে নিয়ে আসেন। কিন্তু পরবর্তী মেয়রগণের মেয়াদে সেবাটি নিম্নমুখী হয়। মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে মেমন মাতৃসদনের সেবা চট্টগ্রাম মেডিকেলের চেয়েও উচ্চতায় গিয়েছিল। বর্তমানে সে সেবা ভেঙে পড়েছে।
তিনি বলেন, দক্ষিণ বাকলিয়া নুরুল ইসলাম বিএসসি মাতৃসদন হাসপাতাল, পূর্ব বাকলিয়া ওয়াইজ খাতুন মাতৃসদন হাসপাতাল ও বন্দরটিলা মাতৃসদন হাসপাতালেও স্বাস্থ্যসেবা এখন নাই। কোনো রকমে চালু আছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য চেষ্টা করেছি। মোস্তফা হাকিম মাতৃসদন হাসপাতালে সাবেক মেয়র মনজুর আলমের সহযোগিতা নিয়ে সংস্কার করেছি। মেমন হাসপাতালের বাথরুমগুলোর অবস্থাও খারাপ ছিল। ১২টি সংস্কার করছি। সিটি কর্পোরেশনে ফান্ড নাই। সরকারকে বলেছি স্বাস্থ্যখাতে আলাদা বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। আশার কথা হচ্ছে, আরবান স্বাস্থ্য প্রকল্প আবার ফিরে আসছে।
প্রশাসক বলেন, সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য নগরবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি যারা অর্থায়ন করে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। মিডওয়াইফারিকে আরো দক্ষ করতে হবে। মেয়র হিসেবে যিনি দায়িত্ব নিবেন তাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, স্বাস্থ্যসেবা খাতকে মহিউদ্দিন চৌধুরী যে অবস্থানে রেখে গেছেন তার চেয়ে উন্নত করতে না পারলেও ওই অবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন। শুধু প্রতিশ্রুতি না ওয়াদা করতে হবে।
মেয়র প্রার্থীরা যা বললেন : আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, করোনাকালীন নগরে চিকিৎসার সংকট দেখা গিয়েছিল। হাসপাতালগুলোতে অঙিজেন, আইসিইউ, ভেন্টিলেশনের অভাবে অনেক মানুষ মারা গেছে। তাই আমি মেয়র নির্বাচিত হলে নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নেব, যাতে নগরবাসী বিনামূল্যে ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা পায়। প্রতিটি ওয়ার্ডে স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা গেলে মানুষের দুর্ভোগ অনেকটা লাঘব হবে।
তিনি বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রামে মেনন হাসপাতালের সুনাম ছিল। প্রসূতি মায়েদের জন্য নিরাপদ ছিল এ হাসপাতাল। সেখানে সাশ্রয়ী খরচে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা ছিল। নির্বাচিত হলে চসিক পরিচালিত মেটারনিটি এবং স্বাস্থ্য কমপ্লেঙগুলো গতিশীল করার পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫০ শয্যার হাসপাতাল করার পরিকল্পনা আছে। নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জরাজীর্ণ ভবনগুলোর সংস্কার এবং নতুন ভবন নির্মাণ করার চেষ্টা করব। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের চাকরি স্থায়ীকরণ এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে প্রদক্ষেপ নেব। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা করে টিকা এবং ওষুধপত্র সংরক্ষণে উন্নত সরঞ্জামের ব্যবস্থা করব।
তিনি বলেন, আমাদের এই প্রজন্মের দুর্যোগ ও মহামারি মোকাবেলার অতীত অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা ছিল না। করোনা আক্রান্ত জনগণের আহাজারি আমরা দেখেছি। তাদের কষ্ট লাগবে মুক্তি আইসোলেশন সেন্টার করেছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজাচ্ছেন। নির্বাচিত হলে আমি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাইব। চট্টগ্রামের প্রতি উনার বিশেষ দুর্বলতা আছে।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, জনগণের স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিমুক্ত রাখা আমাদের কাছে মুখ্য। চট্টগ্রাম এখন করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে। এটি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামে ক্যান্সার রোগীও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাই নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত একটি শহরের জন্য আমরা জনগণের দল হিসেবে জনগণের পাশে আছি এবং থাকব। নির্বাচিত হলে ইনশাআল্লাহ সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামে একটি আধুনিক বিশেষায়িত করোনা মহামারি হাসপাতাল এবং একটি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করব।
তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত যেসব নগর স্বাস্থকেন্দ্র এবং হাসপাতাল রয়েছে সেগুলোকে উন্নত, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও সংস্কার করার পাশাপাশি প্রতিটা ওয়ার্ডে মা, শিশু এবং বয়স্কদের জন্য রোগ নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, শিশুদের জন্য ছয় থেকে সাত বেডের এনআইসিও চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে মা-শিশুদের উন্নত সেবার পাশাপাশি বয়স্কদের বাত-ব্যথাসহ নানান রোগের চিকিৎসা নিজ এলাকায় পেতে পারেন। একই সাথে প্রতি ওয়ার্ডে একটি আইসোলেশন সেন্টার করে সেগুলোতে গ্যাস সিলিন্ডার ও হাই ফ্লো অঙিজেনের ব্যবস্থা করতে পারলে করোনা রোগীদের দুর্ভোগ কমে যাবে। করোনা চলে গেলেও এসব সেন্টারে অন্যান্য মহামারির চিকিৎসা করা যাবে। এসব সেন্টারে ভালো বেতনের ডাক্তার নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ করে দিতে পারলে ভালো সার্ভিস পাওয়া যাবে। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের জন্য দক্ষ নার্স তৈরি অবশ্যই প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে নগরীতে একটি নার্সিং ইনস্টিটিউশন করারও পরিকল্পনা আছে। অস্থায়ী চিকিৎসকদের আইনি কাঠামোর মধ্যে স্থায়ী করাসহ যাবতীয় সুযোগ নিশ্চিত করব। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে প্রতিটি ওয়ার্ডে যদি কমিউনিটি হেলথ সেন্টার করা যায়, তাহলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চাপ কমবে। এখন সাধারণ এ চিকিৎসাসেবাগুলো পেতে সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছে। ফলে তাদের গাড়িভাড়া খরচ হয়, সময় নষ্ট হয়। তাই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিউনিটি হেলথ সেন্টার গড়ে তোলা গেলে জনগণ উপকৃত হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক মামলা তদন্তেই ১৪ বছর পার
পরবর্তী নিবন্ধরাঙামাটিতে আকবর মাটিরাঙায় শামছুল