এক মামলা তদন্তেই ১৪ বছর পার

পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি দক্ষ জনবলের অভাব

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

২০০৭ সালের ২৪ জানুয়ারি। নগরীর তৎকালীন খুলশী থানাধীন উত্তর পাহাড়তলী শাপলা হাউজিংয়ের কাছে পাহাড় কেটে ট্রাকযোগে মাটি বিক্রি করা হচ্ছিল। খবর পেয়ে খুলশী থানা পুলিশের সহযোগিতায় অভিযান চালান পরিবেশ অধিদপ্তর বিভাগীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। অভিযানে হাতেনাতে দুজনকে আটকের পাশাপাশি মাটিভর্তি দুটি ট্রাকও জব্দ করা হয়। পরের দিন (২৫ জানুয়ারি) খুলশী থানায় ৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী বায়োকেমিস্ট মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আল মামুন। মামলায় বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত/২০০২) এর ৪(২) ও ১২ ধারায় অভিযোগ করা হয়। পরিবেশ মামলা নম্বর- ০৫/২০০৭। ওই সময় থেকে মামলাটি পরিবেশ অধিদপ্তর তদন্ত করলেও এখনো আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। প্রায় ১৪ বছরে অর্ধডজন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। এই মামলার বাদী বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। তবে মামলাটির তদন্ত কাজ প্রায় ঘুচিয়ে এনেছেন বলে জানান বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা।
একইভাবে ওই বছরের ৮ জুলাই আরেক অভিযানে শাপলা হাউজিং এলাকায় পাহাড় কেটে টিনশেড বাসা নির্মাণ করার প্রমাণ পায় পরিবেশ অধিদপ্তর। পরে আবদুল বারী মজুমদার ও মো. নুরুচ্ছাফা নামে দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩০ জুলাই খুলশী থানায় মামলা দায়ের করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের জুনিয়র কেমিস্ট মো. সাইফুল ইসলাম। মামলায় ঘটনার সময় দেখানো হয় ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। পরিবেশ মামলা নম্বর- ৪১/২০০৭। এরপর থেকে মামলাটি তদন্ত করছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। এই দুই মামলা বাদেও ২০০৯ সালের আরো তিনটি মামলা এখনো তদন্তাধীন রয়েছে।
একটি মামলা বর্তমানে তদন্ত করছেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিদর্শক আবুল মনছুর মোল্লা। অতিসম্প্রতি তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, আমি গত দেড় বছরে ১০টি মামলার প্রতিবেদন দিয়েছি। তন্মধ্যে একটি মামলার একমাত্র আসামি মারা যাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আরো দুটি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে উপস্থাপন করা হবে। যেগুলো ২০০৭ সালে রুজু হয়েছিল।
মামলা তদন্তে ধীরগতির বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আদালতে নির্ধারিত ফ্রেম মেনেই অভিযোগপত্র কিংবা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হয়। কিন্তু এখানে আইন বিষয়ক দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। ফলে বারবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হলেও মামলাগুলোর তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয় না। বিষয়গুলো মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার জানানো হয়েছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) লিগ্যাল কো-অর্ডিনেটর অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ কবীর দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পরিবেশ মামলা যতই বিলম্বিত হয় ততই তার গুরুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। একটা দিন দেরি হওয়া মানে, পরিবেশের ক্ষতিটা একদিন বৃদ্ধি পাওয়া। মামলা যত দ্রুত নিষ্পত্তি হবে তাতে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তিও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বিচার কার্যক্রম যতই ধীরগতি হবে, ততই অকার্যকর হবে।’
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম হচ্ছে প্রাকৃতিক উৎস সমৃদ্ধ একটি জেলা। চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস। পরিবেশের মামলা মানে এই প্রাকৃতিক উৎসগুলোর কোন একটার ক্ষতিসাধন। এ কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের আরো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। দিনের কাজ দিনে শেষ করা উচিৎ। এই কারণে যদি লোকবলের ঘাটতি থাকে, তাহলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উচিৎ সমস্যা সমাধানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো। পরিবেশ বিঘ্নিত হলে জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্য দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘২০১৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার সময় চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ে ২৯টি মামলা তদন্তাধীন ছিল। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মামলাগুলো হয়েছে। তন্মধ্যে গত এক বছরে আমরা ১২টি মামলার প্রতিবেদন দিয়েছি। তন্মধ্যে ১০টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে নতুন দুটি মামলা হয়েছে। সবমিলিয়ে পুরোনো সব মামলার তদন্ত শেষ করার জন্য আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি মামলার তদন্ত কাজও করতে হচ্ছে। আমাদের পরিদর্শকরা দিনরাত কাজ করছেন। অনেক সময় ছুটির দিনেও পরিদর্শকরা অফিস করছেন।’
দক্ষ জনবলের অভাবের বিষয়টি স্বীকার করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর। গত ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম পরিবেশ ভবনে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘পুরনো মামলাগুলো নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামে পদায়িত কর্মকর্তাদের মামলার তদন্ত কার্যক্রম বিষয়ে প্রশিক্ষণের পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞ আইনজীবীদের নিয়ে একটি আইনজীবী প্যানেল গঠন করা হয়েছে। তারা এসে চট্টগ্রামে আইনের খুঁটিনাটি ও আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এতে আগামীতে সুচারুরূপে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে বলে আশা করছি।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাতকানিয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান মেয়র জোবায়ের
পরবর্তী নিবন্ধস্বাস্থসেবার সুদিন ফিরবে?