সীমিত আয়ের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে হবে

| বৃহস্পতিবার , ১২ মে, ২০২২ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

সারা বিশ্ব এখন অস্থির। এখনো কোভিড পরিস্থিতির উত্তরণ হয়নি। জীবন থেকে এখনো সরে যায় নি সেই মহামারির প্রকোপ। করোনাভাইরাস সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। এছাড়া রাশিয়া আঘাত করেছে ইউক্রেনের ওপর। সেটাও বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে আশেপাশের দেশগুলোর ওপর। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধাজনক পর্যায়ে নেয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, সারা বিশ্বই এখন নতুন মন্দা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কিত। এ অবস্থায় ঘোষণা এসেছে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দৈনিক আজাদীতে গত ১১ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মানুষের জাতীয় মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় এক বছরের ব্যবধানে ২৩৪ ডলার বেড়েছে।

গত অর্থবছর শেষে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার। সেটি বেড়ে এখন ২ হাজার ৮২৪ ডলার হয়েছে। গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি জানান, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি চলতি অর্থবছর শেষে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়াবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। করোনা পরিস্থিতিতেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অনেক ভালো। মার্চ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ হলে জুন শেষে সেটি বেড়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।

বছর শেষে মোট জিডিপির আকার বেড়ে দাঁড়াবে ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপির আকার ছিল ৪১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর সার্বিক বিবেচনায় কৃষিখাতে ২ দশমিক ২০ শতাংশ, শিল্পখাতে ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং সেবাখাতে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছে সরকার।
দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে একটি সুসংবাদ। এটা সরকারেরও বড় অর্জন। তবে দেশের শতভাগ মানুষ কখনোই একটি সরকারের সকল অর্জনকে সমান চোখে দেখবে না। আমরাও সেটা প্রত্যাশা করি না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ে চমক দেখিয়ে আসছে। বলা হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধরন বিবেচনা করলে দেখা যায়, উভয় দেশে সামপ্রতিককালে আয়বৈষম্য বেড়েছে। সম্পদবৈষম্যও বেড়েছে।

তবে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে বৈষম্য বেশি। দুই দেশেই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। ১ দশমিক ৯ ডলার আয়ের বিবেচনায় বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য পরিমাপের পদ্ধতি বিবেচনায় বাংলাদেশে কর্মরত দরিদ্র লোকের সংখ্যা ৯ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে, ভারতে তা ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে যে বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না যে, ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) বিবেচনায় একই পরিমাণ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে বেশি পণ্য কেনা যায়। ভারতের নাগরিকদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা বাংলাদেশের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি। এর মানে হলো, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হয়তো বেশি হতে পারে, কিন্তু ভোগ-সন্তুষ্টি ভারতের নাগরিকদের বেশি।

মনে রাখতে হবে, ভারতের এ বছরের সংকোচন কোভিড অতিমারির কারণে ব্যতিক্রম। এটি তাদের অর্থনীতির স্বাভাবিক সময়ের আচরণ নয়। আমরা এখন সময়ের মুহূর্তের একটি পরিসংখ্যানকে ধারণ করছি, কোনো অর্থনৈতিক প্রবণতাকে নয়। অর্থনৈতিক প্রবণতার পরিসংখ্যানের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

এটা মনে রাখতে হবে যে, ভারতের অর্থনীতির আকার বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বড়। আবার অনেক বড় দেশ হওয়ায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থার বেশ তারতম্য রয়েছে। সুতরাং অর্থনীতির আকার, দেশের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যকার অবস্থার পার্থক্য, কোভিড অতিমারির কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক কাঠামো ও তার শক্তি প্রবৃদ্ধির ধরন, বৈষম্য পরিস্থিতি ইত্যাদির বিবেচনায় পুরো বিষয়টি দেখতে হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, আমাদের দেশে উন্নয়ন হচ্ছে ব্যাপকহারে। তবে তা সমানুপাতিক হারে সবার ভাগে পড়ছে না। সমাজে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে তড়তড় করে। কিছু লোকের হাতে ধন সম্পদ জমা হচ্ছে এমনভাবে, যার ভাগ দেশের সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। এ অবস্থাতেও বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে অবাক করা সংখ্যায়। এই অর্জনের ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে আসে নি। এর স্বীকৃতি এসেছে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই। এবার ভাবতে হবে সীমিত আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন নিয়ে। দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে, সর্বশ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার মানও সেভাবে বাড়াতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে