সাহস ও সততার মূর্ত প্রতীক সিরাজুল হক মিয়া

নাজমুল হক ডিউক | বুধবার , ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ

বালক বয়সে এক রাতে ডাকাত ডাকাত শব্দে ঘুম ভেঙ্গে দেখি রাস্তার ধারে কসকর দোকানে ডাকাত এসেছে। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়ির বারান্দায় পজিশন নিয়ে নানা তাঁর বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ছেন। দু তিন রাউন্ড গুলি ছোড়াতে ডাকাতদল ডাকাতির চেষ্টা বাদ দিয়ে পালাতে শুরু করে। ডাকাত ধরতে তিনি বন্দুক রেখে রিভলবার হাতে নিয়ে ধাওয়া শুরু করে এবং গুলি ছোড়ে, প্রায় ৫০ গজ দূরে থেকে তাদের দৌড়ে পাকড়াও করতে না পারলেও অমিততেজী সিরাজুল হক মিয়ার (১৯২০-১৯৯৪) সাহসের পরিচয় দিতে এই ঘটনা সামান্যতম উদাহরণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী সাংগঠনিক ক্ষমতা বাঙালি মাত্রই কম বেশি জানি। সিরাজুল হক মিয়াকে আওয়ামীলীগের সম্পৃক্ত করাটাও প্রথম দর্শনে মুগ্ধ করা তাঁর জাদুকরী সাংগঠনিক গুণের এক দৃষ্টান্ত। মহান নেতা ষাটের দশকের শুরুর দিকে টার্গেট করে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মাদারবাড়ির সাহসী সমাজকর্মী ও সামর্থ্যবান ব্যবসায়ী সিরাজ মিয়াকে। তিনি এক সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে উনার দলের আস্থাভাজন সংগঠক এম.এ.হান্নানকে দিয়ে সিরাজ মিয়াকে ডেকে আনেন। মুখোমুখি প্রথম সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধুর উষ্ণ আলিঙ্গন ও পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই সিরাজ মিয়া দীক্ষা নেন মুজিব আদর্শের। পরের দিন মুসলিম লীগের মিছিলে খোলা জীপ তুলে দিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন এবং প্রিয় মুজিব ভাইয়ের প্রতি আনুগত্যের প্রদর্শন দেখালেন অভিজাত মুসলিম লীগারদের হতচকিত করে।
ইউসুফ আলী মুন্সি ও বদরজানের দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে চতুর্থ সন্তান সিরাজুল হক মিয়া ছেলেবেলা থেকে দুরন্ত প্রকৃতির। সেন্টপ্লাসিড স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করে কর্মজীবন শুরু করেন ই পি আর এ। স্বাধীনচেতা সিরাজ মিয়া গতানুগতিক চাকরি ছেড়ে দিয়ে গড়ে তোলেন ‘মাদারবাড়ি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’। ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ ও পরিবহন ব্যবসার প্রসারের সাথে তিনি মনোনিবেশ ঘটান সমাজসেবায়। বঙ্গবন্ধুর আর্দশিক অনুপ্রেরণায় পাকিস্তানি জান্তার শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান গ্রহণ করেন এবং আত্মনিয়োগ করেন রাজনীতিতে। স্বাধিকার ও স্বাধীনতার চেতনায় চট্টগ্রামের জনগণকে একত্রিত করতে সিরাজ মিয়া সাহসের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭০ সালে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দিলে চট্টগ্রামে আওয়ামীলীগের প্রথম নির্বাচনী সভা বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে সিরাজ মিয়ার বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার পরবর্তীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুনর্গঠনে অগ্রণী ভূমিকার কারণে ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। সাহস, সততা ও দৃঢ়তার সাথে পালন করেন তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্রে সিরাজ মিয়ার বাড়িতে তিনি বার কয়েক আতিথ্য গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সিরাজুল হক মিয়া শোকে স্তম্ভিত ও মুহ্যমান হলেও হত্যাকারী গোষ্ঠী ও সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৭৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে আন্দরকিল্লাসহ আওয়ামী লীগ অফিসে শোকাবহ ১৫ আগস্ট এর স্মরণে মিলাদ ও মোনাজাত পরিচালিত হয়।
৭৫ পরবর্তী আওয়ামীলীগের প্রথম কমিটিতে আহবায়কের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে অর্পিত হয়। জিয়াশাহীর লেলিয়ে দেয়া সামরিক-বেসামরিক পেটোয়া বাহিনীর দমন-পীড়ন ও প্রলোভনের কাছে নতি স্বীকার না করে মুজিব বিহীন বাংলায় এই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সকল স্তরের জনগণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখায় সিরাজ মিয়া ও তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কমিটি। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ সালে আওয়ামী লীগের পরিচয় দানকারীদের দুরূহ দুঃসময়ে সিরাজুল হক মিয়া ছিলেন ত্রাতার ভূমিকায়। সে সময়ে তাঁর রেস্ট হাউজের (বর্তমানে হোটেল সৈকত) অফিস ছিল দলীয় নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণাস্থল। ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের পৌরসভার নির্বাচনে শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল পদে থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন, তাঁর সততা ও নিষ্ঠার কারণে (বন্দর থেকে পৌরসভার আয়ের জন্য লেভি চার্জ এর প্রবর্তন, লালদিঘির পাড়ে মসজিদ নির্মাণ, অমর চাঁদ রোড, কে সি দে রোড সংস্কার, দরিদ্র হকারদের স্বার্থে হকার মার্কেট নির্মাণ, সুগন্ধা আবাসিক এলাকা ও ধনিয়ালা পাড়ার রাস্তা সংস্কারে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা সহ প্রভৃতি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড) চট্টগ্রাম পৌরসভার আপামর জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের নির্বাচনে প্রায় কেন্দ্রের ফলাফলে তিনি এগিয়ে থাকলেও জেনারেল জিয়ার টেলিফোন নির্দেশে বিপক্ষ প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
১৯৭৯ সালের শেষ দিকে বিএনপি নেতাদের উপস্থিতিতে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা নিউমার্কেট মোড়ে আওয়ামীলীগ এর প্রথম সারির নেতাদের নির্মমভাবে ছুরিকাঘাত করে আহত করে এবং নিউমার্কেট ও আশেপাশে আওয়ামীলীগকে সভা-সমাবেশ না করতে দেয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়। বিএনপি সন্ত্রাসী ও প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে সিরাজুল হক মিয়ার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীরা ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে সমাবেশ ও মিছিল করে। প্রচণ্ড সাহস ও উদ্যমের সাথে সেই সময়ে আওয়ামীলীগ নিউমার্কেট ও তৎসংলগ্ন এলাকায় তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের অংশ হিসেবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ধারাবাহিকতার সাথে চালিয়ে যায়। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। চৈতন্যগলি কবরস্থানকে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার প্রচেষ্টা রুখতে সিরাজ মিয়ার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাইশ মহল্লা সর্দার কমিটি গঠন করা হয়। এরশাদ শাহীর এই প্রচেষ্টা ভণ্ডুলকারী (তৎকালীন ১৫ দলীয় ঐক্য জোটের অন্যতম নেতা) সিরাজ মিয়াকে বিরোধী দল দমনের অংশ হিসেবে দুই দুইবার কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করার কারণে ১৯৯০ সালের নভেম্বরে তীব্র শীতে প্রায় ৭০ বছরের প্রবীণ সিরাজ মিয়াকে কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে মাসাধিকাল দিনাতিপাত করতে হয়। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কাস্তে প্রতীক নিয়ে চট্টগ্রাম ৯ আসনের সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিকলীগ একীভূত হলে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের সদস্য হন। ১৯৯২ সালের জুন মাসে তাঁকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে পাঠানো হলে কিছুটা সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসস্থানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুর অল্প ক’দিন আগে চট্টগ্রাম সফরে আসা তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী, বঙ্গবন্ধু তনয়া বর্তমান সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সন্ধ্যায় মাদারবাড়িসহ বাসায় এসে অসুস্থ সিরাজ মিয়া ও তাঁর পরিবার বর্গকে আজন্ম কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করে যান। বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্য আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, চৈতন্যগলি কবরস্থান সংস্কারকারী এই অকুতোভয় মানুষটা সেই কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন যেখানে তিনটি মসজিদের আজানের ধ্বনি, কয়েকটি মাদ্রাসা-এতিমখানার শিশুদের কোরআন তেলাওয়াত ও তাঁর হাতে লাগানো গাছগুলোর পাতার মর্মর ধ্বনি এক সুরে প্রবাহমান।

লেখক : কাউন্সিলর, উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ড, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাববার সময় নেই কারো
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে