সাপ-খোপের সংসার

আরিফুল হাসান | শুক্রবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

কপালে না থাকলে সুখ/ তুমি কোথায় পাইবা সুখগ্রামের পথ ধরে বাউল হেঁটে যায়। কোত্থেকে আসে বাউল? জমিলার দ্বন্দ্ব লাগে। তার গানের কথাগুলি হৃদয় চিরে যায়। শুকনো গমের টাঙার উপর বসে থেকে শাড়িটা টেনে দেয় আরও পায়ের দিকে। বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাসের মতো একঝাঁক দুঃখ পাখি হয়ে উড়ে যায় চৈত্রের আকাশে। ছোট ছেলেটা যেনো কোথায় আছে! ওর জন্য মনটা উশখুশ করছে। এই ছোট বয়েসেই যেনো কেমন কেমন, যেনো পালাই পালাই ভাব! ওর আবার কোনো বিপদ হলো নাতো?

ছোট ছেলে আরিফ গেছে কালুমিয়ার পুকুর পাড়ে আম কুড়াতে। সেখানে সাপের, না খোপের ভয়! বিস্ময় লাগে জমিলার। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায় ছেলেটা। নিজের আম গাছ আছে, তবু গ্রামের ছেলেদের অভ্যেস, আম কুড়াতে তো যাবেই। কিন্তু তাই বলে এই দুপুর ছুঁইছুঁই সকালে? মায়ের মনটা নরম হয়ে আসে। উঠানে গিয়ে দাঁড়ায় একটু। এই ছোট ছেলেটার জন্যই পারি না। নাহলে, আবার হুহু করে উঠে মনটা। পুকুরের ঘাটের দিকে যায়। হাতমুখ ধুতে পুকুরের পানিতে হাত রাখে। মৃদু কম্পন তুলে যত্নময় ঢেউ চাকভাঙা মধু হয়ে ছরিয়ে যায় জলবিস্তারের দিকে। জমিলা হাতমুখ ধোয়। জলের তলে আয়নায় নিজের মুখ দেখে। মুখ দেখে চমকে উঠে, আশ্চর্য, দুঃখী লাগছে না তাকে। যেনো ভালো আছে সে। মনে পড়ে প্রথম যৌবন, বিয়ে হলে বৌ হয়ে এই বাড়িতে আসা। নতুন বৌ হিসেবে ঘোমটা টানা মৌবন লাজে চুপি চুপি পুকুরে আসা। তার এখনো শরম লাগে। দ্রুত ঘরে ফিরে আসে।

না, ছেলের বাপ আছে। সেকি দায়ে পড়ে? থাক, যেভাবেই থাক, আছে তো। তার এই থাকাটাই একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। মুচকি হেসে স্কুলের মাঠের দিকে এগিয়ে যায়। না, সেখানেও নাই আরিফ। কোথায় গেছে? কাকে দিয়ে খোঁজ পাঠাবে এখন? বড় মেয়েটা গেছে গার্লসস্কুলে, ছোট মেয়েটাও। ছেলেরা নানান দিকে। এমন সময় বাতাস বয়। চৈত্রের বানডাকা বাতাস শো শো করে আসতে থাকে। গাছে নিশ্চই আম পড়ছে। উত্তরের পথ ধরে। মিনিটের মধ্যে বাড়ির ঘাটে চলে আসে। আম বিছিয়ে পড়ে আছে, সে কুড়ায়। কিছু ইতোমধ্যে প্রতিবেশী মেয়েরাও কুড়িয়েছে। তাকে দেখে এখন ঘরের ভেতর চলে গেছে। জমিলা আম কুড়ায়। ছেলে নিশ্চয়ই এর চেয়ে বেশি আম কুড়িয়ে আনবে। কোচর ভরে। তবে ওসব তার না আনলেও চলতো। তবু গ্রামের ছেলে তো, যাবেই।

যেতে তাকে নিষেধ করেছে কে! যাবে, কিন্তু তাই বলে ভর দুপুরে? মায়ের মন খা খা করে। দ্রুত আমগুলি কুড়িয়ে জমিলা উঠে যায় ঘরে। উঠানে মাড়ানো গমগুলো পড়ে আছে। উড়ানোর এই তো সুযোগ। বড় মেয়েটা কাছে থাকলেও হতো। এখন ঘরে লোকটা ঘুমিয়ে আছে, জাগাবে না। থাক, ঘুমাক, অনেক পরিশ্রম করে। আমার না হয় এই কপাল। জমিলা ছোট ছোট ঝুড়িতে করে গমগুলো স্কুলে যাওয়ার সরু সড়কটির মুখে পাতা বড় ঝুড়িটাতে রাখে। রাখার সময়ই একটু উড়িয়ে নেয়। চৈত্রের বাতাসে শূন্যে উড়ে উড়ে গমের খোসাগুলো সোনালি পালকের মতো দূরে গিয়ে জমে। জমিলার চোখে রংধনু লাগে। তার নাকেও একটা সোনার জিনিস আছে। যদিও তাতে সোনার পরশ কম। বড় তিনটা পাথর বসানো। একটি ছোট লাল, একবিন্দু তিলের মতো। আরেকটি সমুদ্রের মতো নীল। আরেকটি পিত কালার। নাকফুলটি দিয়ে যখন আয়নায় চোখ রেখেছিলো প্রথম, তাকে অস্পরীর মতো দেখাচ্ছিলো। খুব সুন্দর লাগছিলো তাকে। জমিলা আঁচলটা ঘুরিয়ে নাকমুখটা ঢেকে নেয়। চৈত্রের বাতাস পাক খেয়ে ঘোরে। গমের কুডা ঢুকে যেতে পারে নাকে মুখে। চোখে পড়াটাও অস্বাভাবিক না। বাতাসের বহমান দিকের পাশ করে দাঁড়াতে হয়। আধকানি খেতের গম। ফলনটা ভালোই হয়েছে। এখন ভয় ঝড় না আবার এসে পড়ে। ঝড় এলে একা মানুষ সবগুলো গম ঘরে নিতে পারবে না। তবে মেঘ নেই। আকাশ খা খা। চৈত্রের মহিমা ছড়াচ্ছে রোদ। ঝলসে দিচ্ছে দেহের চামড়া। অবশ্য জমিলা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে গাছের ছায়া। দুটো লাঠিমগোটা গাছ পাশাপাশি বেড়ে উঠছে। তার পাশে বড় একটি কদম গাছ। গাছে এখনও অকালের কদম দুয়েকটা সবুজ উঁকি দিচ্ছে। বর্ষায় এর কদম পড়ে জলঘাট ছেয়ে থাকে। পঁচে জল ঘোলা করে। জমিলার মাথার উপর আরও এক পাক বাতাস ঘুরে আসে।

সোজা উত্তর দিকে বয়ে যাওয়া সড়কটি ছোটই। এ বাড়িটাতে তিনটে ঘর পাশাপাশি। তারপরেই নেমে গেছে সড়কটা। উত্তরের মাঠের আল ধরে অপর গ্রামে। আরিফ এখনও এলো না। তার জন্য চিন্তা লাগে। জমিলা দিক পরিবর্তন করে। এতক্ষণ পশ্চিম থেকে উত্তরে কোণ ধরে বাতাস বয়েছিলো। এখন আবার দক্ষিণমুখী সরাসরি উত্তরে বয়ে যাচ্ছে। জমিলা পূর্বপাশে এসে দাঁড়ায়। পশ্চিমে দাঁড়ানোটা তেমন সুবিধার নয়। সড়কটা ভেঙে আছে ওখানে। দুহাতে কাচের চুড়ি দুটো। ডার্ক ব্লু। জমিলা আঁচল কামড়ে রেখে উড়াতে থাকে গমগুলো। ক্লান্তি ভুলে যায়। তার সামনে এখন আগামী দিনের সন্তানের পাতে তুলে দেয়া রুটি। গম বিক্রি করে ভাতের সংস্থানই হয় বেশি। তবু নতুন নতুন কিছুদিন রুটি খেতে ভালোই লাগে জমিলার। সন্তানেরাও পছন্দ করে। তবে তার, স্বামীর গ্যাস্টিক বেড়ে যায় বলে নিয়মের মতোই যেনো নিয়ম হয়ে গেছে ভাতের উপর। পরিবারটা চলছে স্বামীর ইনকামের উপর। খুব সামান্যই। তবু খাটতে হয় রাতদিন। জমিলার সব রাগ পানির মতো নিভে যায়। বাতাসের মতো উড়ে যায় মনের যতো অভিমান। স্বামী সে। সুখস্মৃতি মনে পড়ে। এ জীবনে দুখের চেয়ে সুখের স্মৃতিই বেশি। দুঃখগুলো গমের খোসার মতোই উড়ে যায়। চোখের সামনে জমা হয়। জ্বালানি হয়। চুলায় ও মনে। জমিলার মনে পড়ে, তার বড় ছেলে, আহা সোনার টুকরা ছেলে, কোল আলো করে হেসে উঠেছিলো। মনে পড়ে, মেলা থেকে, স্বামী তার খোঁপা বাঁধতে গুছি এনে দিয়েছিলো। টিনের ক্লিপ। কালো রঙের। সোনামুখি সুঁই, সবুজ উলের সুতো। মনে পড়ে, এই সংসারের সব আপন। এই ঘর, এই ঘাটা, এই স্কুলে যাওয়ার ছোট্ট সড়ক, এই সংসার। সবই আপন। খুব আপন। ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে। এখনো আসছে না। গমগুলো উড়ানো প্রায় শেষ। জমিলা আরেকবার স্কুলের মাঠে ঘুরে আসে। তারপর গমগুলোকে উড়িয়ে ঘরে নিতে থাকে। নিঃশব্দে ডুলিতে রাখে। ঘুম ভাঙাতে চাচ্ছে না। শরীরটাও খারাপ। মেঝো ছেলেটার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে সেঝো ছেলেটার কথা, বড় মেয়ে, মেজো মেয়েটার কথাও মনে পড়ে। এ সবই তার কাছে সুসংবাদ হয়ে এসেছে। তার বুকে উজার করে দিয়েছে ভালোলোবাসা। ঘুরে স্বামীর দিকে চায়। মুচকি হাসে, সে শব্দে ঘুম ভেঙে যায় স্বামীর। স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়েই সব বুঝতে পারে। তার চোখে অনুতাপের ছায়া। জমিলা আবার ঝুড়িটা নিয়ে বাইরে বেরুতে চললে চৌকিলাগা ডুলির পাশে হাত ধরে ফেলে। টেনে বিছানায় বসায়। গমগুলি সব নিয়ে এসেছে জমিলা। শক্ত হাতে তার হাত ধরে স্বামী। জমিলা বুঝতে পারে, এ মুহূর্তে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি। স্বামী জানতে চায়, আরিফ কই? জমিলা উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ পরে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, কার পুকুর পাড়ে সাপখোপের মাঝে ঘুরছে কে জানে? স্বামী তার হাতটা ছেড়ে দেয়, উঠে বসে বিছানায়। আজকে আসুক সে। তার চোয়ালগুলো কঠিন হয়ে ওঠে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইচ্ছে উড়া মক্তবের পাঠগেলা ভোরেরা
পরবর্তী নিবন্ধআল মাহমুদের কবিতা