আল মাহমুদের কবিতা

আজহার মাহমুদ | শুক্রবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

কবি আল মাহমুদ। আসল নাম কিন্তু মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। বাংলা সাহিত্যের এ কিংবদন্তী ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বৈচিত্র্যময় এই কবি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক।

প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস এসবেও তিনি ছিলেন অন্যতম। তবে কবিতায় তিনি আজীবন থাকবেন অমর। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আল মাহমুদের কবিতা থাকবে জীবন্ত। তাঁর ছড়াকবিতা যুগ যুগ ধরে বাংলা সাহিত্যে সম্মানের আসনে থাকবে। কবি আল মাহমুদের কবিতা ১৮ বছর বয়স থেকেই প্রকাশ হতে শুরু করে। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকা, বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকাকলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়।

লোক লোকান্তর (১৯৬৩) কাব্যগ্রন্থ দিয়েই সর্বপ্রথম কবি আল মাহমুদের অন্যরকম পরিচিত সৃষ্টি হয় বাংলা সাহিত্যে। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। যা এখনও বাংলা সাহিত্যের জন্য বড় সম্পদ। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেমবিরহকে তাঁর কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তাঁর কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তাঁর অনন্য কীর্তি।

১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম সোনালি কাবিন। যার কারণে আজও তাঁকে সোনালি কাবিনের কবি বলা হয়।

আল মাহমুদের কবিতা সম্পর্কে লেখক ড. ইয়াহ্‌ইয়া মান্নান লিখেছেন, “কবির জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কবি প্রথম জীবনে তেমন মার্কসবাদী ছিলেন না। তিনি ছিলেন রোমান্টিক ধারার কবি। জীবনের রোমান্স এবং সম্বন্ধসূত্র নিয়েই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি যখন ঢাকায় আসেন তখন মার্কসবাদে পুরোপুরি বিশ্বাসী হন। তখন হয়তো কবির ধারণা ছিল মানুষেমানুষে বৈষম্যের সমাধান একমাত্র মার্কসবাদেই আছে। তখন তিনি ব্যাপকভাবে মার্কসীয় সাহিত্য পড়তে থাকেন। সত্যেন সেনের (১৯০৭১৯৮১) মতো ব্যক্তির কাছে যাতায়াত শুরু করেন। তাঁদেরই কাছে তিনি মার্কসবাদের দীক্ষা গ্রহণ করেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার মার্কসবাদ বিশ্বাসী হয়েও তিনি কবিতায় মার্কসবাদের প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি। মার্কসবাদ এবং রোমান্টিকতা যদিও কবির জীবনে ছিল অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। শেষ পর্যন্ত রোমান্টিকতারই জয় হয়।”

কবি আল মাহমুদ কেন মার্কসবাদকে সমর্থন করলেন এবং কেন মার্কসবাদে দীক্ষিত হলেন সে সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট অভিমত ছিলো এমন, “আমার যৌবন কালটা ছিল খুবই দারিদ্র্যের আঘাতে দিশেহারা। স্বভাবতই আমার সে সময়কার আদর্শও ছিল যে কোনো উপায়ে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। আমি তখন মার্কসবাদকেই সবকিছুর সমাধান ভেবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম। তখন ধর্মের ব্যাপারে আমার দারুণ জিজ্ঞাসা থাকলেও এবং মার্কসীয় দর্শনে এর তৃপ্তিকর কোনো জবাব খুঁজে না পেলেও আমি কমিউনিস্ট পার্টিকে সমর্থন করতে লেগে গেলাম। লেগে গেলাম মানে ঐ সময়কার আমার সাহিত্যকর্মে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতাদের প্রতি বুকভরা সমর্থন ব্যক্ত হতে থাকল। পরে অবশ্য জেনেছিলাম রুশ নেতা স্ট্যালিন একাই দুই কোটি মানুষকে হত্যা করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। ঐ সমাজতন্ত্র মূলত একটি মানবপীড়নমূলক বিশাল কারাগার মাত্র। পরে সেই সাম্রাজ্য আপনা থেকেই ভেঙে পড়ে। আমার যৌবনকালটা আমি ঐ ভুল আদর্শের পেছনে ছুটে বেড়িয়েছি। এখন আমি বিশ্বাস করি যে আল্লাহর বিধানমালা ছাড়া মানবজাতি এই মহাবিশ্বে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সক্ষম হবে না। ঐ বিধানমালার নামই হলো কোরআন।”

অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র ধারার একজন চর্চাকারী হিসেবে কবি আমাদের কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োাগ তার অনন্য কীর্তি। কবি তাঁর কবিতায় যে মৌলিকত্ব, ক্ষমতা ও শক্তির সাথে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের লোকসত্তাকে ধারণ করেছেন, তা আর কোনো কবির পক্ষেই সম্ভব হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক, সমালোচক শিবনারায়ণ রায় বলেছিলেন, “বাংলা কবিতায় নতুন সম্ভাবনা এনেছেন আল মাহমুদ, পশ্চিম বাংলার কবিরা যা পারেনি তিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছেন।” কবি হয়ে উঠার পেছনে গল্প বলতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ বলেছিলেন, “আমি দরিদ্র পরিবারে জন্মেছি। একসময় তারা ঐশ্বর্যশালী ও অভিজাত থাকলেও শেষদিকে অর্থাৎ আমার বাবার সময়ে এসে আমাদের প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় পৌঁছাতে হয়। তিনি বস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তার দোকানব্যবসা সব ফেইল করে যায়। আমি শৈশবে দরিদ্র অবস্থার মধ্যে লেখাপড়া করেছি। আমার এক চাচী আমাকে লালনপালন করেছেন। আমি ঠিকভাবে ঘরে থাকতে পারিনি। দারিদ্রের কারণে তো বটেই, রাজনৈতিক কারণও ছিল। ভাষা আন্দোলনের সময় আমি একটা কবিতা লিখেছিলামভাষার লিফলেট। এটা ছাপা হওয়ার পর আমার বাড়িতে পুলিশ গেল। আমি পালিয়ে গেলাম। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম আর আমি ফিরতে পারিনি। অনেক পরে আমি হয়তো ফিরে গেছি, কিন্তু সেটা অন্য কথা। যাকে বলে ফেরা, কিন্তু পরিবারের শেকড়ের সঙ্গে আর আমি যুক্ত হতে পারিনি। উদ্দেশ্যহীনভাবে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। এই বিচরণশীলতাই হয়তো আমাকে কবি করে তুলেছে।”

কেবল কবিতাতেই নয়, গদ্য সাহিত্যেও আল মাহমুদ ছিলেন সমান পারঙ্গম। ‘পানকৌড়ির রক্ত’ ‘জলবেশ্যা’ ‘কালোনৌকা’ ‘খনন’ ‘বুনো বৃষ্টির প্ররোচনা’ বা ‘গন্ধবণিক’এর মতো গাল্পিক বাংলা সাহিত্যে বিরল প্রতিভা বলা অপেক্ষা রাখে না। তাঁর নির্মাণে যে শিল্পসত্তা জড়িয়ে আছে তা বাংলাভাষাভাষী পাঠক সমাজকে বিমুগ্ধ করে। বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তী ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যু নিয়ে কবি আল মাহমুদ চমৎকার কিছু কথা বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছেন, “মৃত্যুচিন্তা আমার ভেতর এখন মাঝেমাঝে প্রবল হয়ে ওঠে। আমি জোর করে এটা সরিয়ে রেখে জীবনের অফুরন্ত সম্ভাবনার কথা ভাবি। জীব হিসেবে যখন জন্মেছি, তখন একদিন মৃত্যু হবেই। এই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার জন্য আমি বোঝাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। কষ্ট লাগে এই ভেবে যে, এই যে আমি আল মাহমুদ কথা বলছি, কবিতা লিখছি, আমার ধ্যানসাধনাঅর্জনখ্যাতি সব মিলিয়ে যে অস্তিত্ব, আমার যে আত্মা, তার মৃত্যু হলে কেউ আর আমাকে আল মাহমুদ বলবে না, বলবে আল মাহমুদের লাশ। আজ সংসারে, পরিপার্শ্বে যারা আমাকে ঘিরে রয়েছে, আমার স্বজন সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে হয়ে উঠবে আমাকে বিদায় করার জন্য। মাটিচাপা দেওয়ার জন্য।”

কবি আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় বলেছেন, আমি চলে গেলে এ পারে আঁধারে কেউ থাকবেনা আর / সব ভেসে গেছে এবার তবে কি ভাসাবো অন্ধকার? / আলোআঁধারির এই খেলা তবে আমাকে নিয়েই শেষ / আমার শরীর কাঁপছে যেমন কাঁপছে বাংলাদেশ। যতদিন বাংলা থাকবে। বাংলায় কথা বলার মানুষ থাকবে। ততদিন আল মাহমুদ থাকবেন। তিনি শ্বাস নিবেন তাঁর রেখে যাওয়া সোনালি কাবিন, কালের কলস, লোক লোকান্তরের মাধ্যমে। কবির প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাপ-খোপের সংসার
পরবর্তী নিবন্ধপাহাড়তলী ওয়ার্ডে দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান