সাগরতীরে শুটকি তৈরির ধুম

কক্সবাজারে দৈনিক উৎপাদন ৫শ মেট্রিক টন ।। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি

কক্সবাজার প্রতিনিধি | রবিবার , ৩ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ

দেশের বৃহত্তম শুটকি পল্লী কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকসহ জেলার সাগর তীরবর্তী এলাকায় এখন শুটকি তৈরির ধুম পড়েছে। সাগর থেকে ধরে আনা প্রায় ২৫ প্রজাতির মাছ শুকিয়ে এখানে তৈরি করা হচ্ছে সুস্বাদু শুটকি। বর্তমানে কক্সবাজারে দৈনিক গড় উৎপাদন ৫শ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতি বছর শীতকালে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে সাগরের পানির উচ্চতা কমে গিয়ে সৈকতে বিশাল চর জেগে ওঠে। আর এসব মৌসুমী বালুচরে বাঁশের মাচা বানিয়ে সেখানে সামুদ্রিক মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরি করে স্থানীয় জেলেরা। তবে দেশের বৃহত্তম শুটকি পল্লী কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকে বর্ষাকাল ও সাগরে মাছ ধরার উপর নিষিদ্ধ সময় ছাড়া সারা বছরই শুটকি তৈরি করা হয়। আর গত প্রায় ২ মাস ধরে একটানা বৃষ্টিবিহীন চমৎকার আবহাওয়া থাকায় এখানে শুটকি উৎপাদনও হচ্ছে নির্বিঘ্নে। সে সাথে শীতকালীন পর্যটন মৌসুম উপলক্ষে কক্সবাজারে এখন পর্যটকের ভিড় থাকায় শুটকির চাহিদাও ব্যাপক। কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকের সমুদ্র তীরবর্তী বালুচরের প্রায় ১শ একর জমিতে গড়ে ওঠেছে দেশের বৃহত্তম শুটকি পল্লী। এখানে শুটকি উৎপাদন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। যার মধ্যে অধিকাংশই নারী শ্রমিক। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) নাজিরাটেকসহ জেলার সমুদ্র তীরবর্তী বালুচরের জেলে পল্লীসমূহে শুটকি উৎপাদন চলে। তবে বৃষ্টি না থাকলে বছরের অন্যান্য সময়েও কিছু শুটকি উৎপাদন হয়। সাগরের বালিয়াড়িতে বিশেষ উপায়ে তৈরি করা বাঁশের মাচার উপর কাঁচামাছ বিছিয়ে সূর্যের তাপে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুটকি। কাঁচা মাছ সূর্যের তাপে শুকিয়ে শুটকি হতে ৩/৪ দিন সময় লাগে। এরপর উৎপাদিত শুটকিগুলো বস্তাবন্দী করে ট্রাকবোঝাই করে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। শহরের নাজিরারটেক ছাড়াও মহেশখালী, সোনাদীয়া দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়াসহ জেলার উপকূলীয় এলাকায় শুটকি শুকানো হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মৌসুমে নাজিরারটেক শুটকি মহালে মাছের গুঁড়াসহ ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদন হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় দুইশ কোটি টাকা। উৎপাদিত এসব শুটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। জেলার অন্যান্য এলাকাতেও নাজিরারটেকের প্রায় সমপরিমাণ শুটকি উৎপাদিত হয়। জেলা মৎস্য কর্মকতা এএসএম খালেকুজ্জামান বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষজাতের ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুটকি উৎপাদন করা হয়। এখানে উৎপাদিত শুটকি শুধু কক্সবাজারে নয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নাটোরসহ সারাদেশের মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে। এমনকি এখানে উৎপাদিত শুটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদার একটি বড় অংশ কক্সবাজারে উৎপাদিত শুটকি থেকে পূরণ হচ্ছে।
নাজিরারটেক শুটকি মহালের ব্যবসায়ী মো. নুরুদ্দিন কোম্পানী জানান, এখানে রূপচাদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা, পোপা, টেকচাঁদা, হাঙর, ফাইস্যা ও নাইল্যামাছসহ ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছের শুটকি তৈরি করা হয়। বর্ষাকালে টানা বৃষ্টির সময় ছাড়া বছরের ৬/৮ মাস এখানে শুটকি উৎপাদন চলে। আর ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল-মে পর্যন্ত ভরমৌসুমে এখানে প্রতিদিন গড়ে দুইশত থেকে আড়াইশ মেট্রিক টন করে শুটকি উৎপাদিত হয়।
নাজিরারটেক শুটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আতিকউল্লাহ কোম্পানী জানান, প্রায় একশ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা দেশের বৃহত্তম এ শুটকি মহালে ছোট-বড়অর্ধশতাধিক আড়ত রয়েছে। এখানে বিশ হাজার শ্রমিক ছাড়াও প্রায় দুই হাজার ব্যবসায়ী রয়েছেন।
তিনি বলেন, দেশের বৃহত্তম এ শুটকি মহাল থেকে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেলেও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনের ভাড়া গুণতে হয় অতিরিক্ত। ফলে একদিকে উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে শুটকি উৎপাদনেও ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। নাজিরারটেকসহ জেলার সমুদ্র উপকূলীয় উন্মুক্ত বালুচরে সনাতনী পদ্ধতিতে শুটকি উৎপাদন হলেও সাম্প্রতিককালে গড়ে ওঠেছে আধুনিক শুটকি তৈরির কারখানাও। চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকলে এটি একটি সম্ভাবনাময় শিল্প খাত হয়ে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিজ্ঞানীদের মতে, শুটকিতে সাধারণ মাছের তুলনায় তিনগুণ প্রোটিন রয়েছে। এছাড়া সামুদ্রিক মাছে রয়েছে মেধা বৃদ্ধিকারক ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড। যে কারণে বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে বিবেচিত শুটকি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপজেলা পরিষদে প্রশাসনের ‘হস্তক্ষেপ’ বন্ধের আহ্বান
পরবর্তী নিবন্ধপণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা না পেয়ে হামলা, আহত ৬