সাও পাওলোর বস্তি থেকে রূপকথার মহানায়ক

স্পোর্টস ডেস্ক | শনিবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৪:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বজুড়ে ফুটবলের রাজা নামেই তাকে চেনে সবাই। আর তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ফুটবল পায়ে জাদুকরি স্কিল আর অবিশ্বাস্য সব কীর্তিতে তিনি হয়ে উঠেছেন খেলাটারই প্রতীক। ফুটবল আর পেলে একাত্ম হয়ে গেছেন। সাও পাওলোর দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় খালি পায়ে মোজা আর কাগজের ফুটবল দিয়ে খেলতে খেলতে হয়ে উঠেছেন রূপকথার চরিত্র। ফুটবলের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন জীবনের মহানায়ক, অসংখ্য মানুষের প্রেরণার উৎস। কীর্তিতে যদিও তিনি অমর, তবে এই মর্ত্যের পৃথিবী ছেড়ে যেতে হচ্ছে তাকে জীবনের নিয়মেই। বর্ণাঢ্য এই জীবনের নানা মোড়ে কীভাবে তিনি এগিয়ে গেছেন জয়ের ঝান্ডা উঁচিয়ে, বিদায় বেলায় ফিরে তাকানো যাক সেই অধ্যায়গুলোতে।

১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর, তাঁর জন্ম ব্রাজিলের মিনাজ জেরাইস রাজ্যের ত্রেস করাসোয়েসে। মাবাবা নাম রাখলেন এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয় তার নাম। বাড়িতে সবাই ডাকতেন ‘ডিকো’ নামে। তার বেড়ে ওঠা সাও পাওলোর বাউরুতে। দারিদ্র্যপীড়িত শৈশবে কিছুটা বাড়তি আয়ের জন্য কাজ করতেন চায়ের দোকানে। ‘পেলে’ ডাকনামটি পান তিনি স্কুলের দিনগুলিতে। সেসময় তার প্রিয় ফুটবলার ছিলেন ভাস্কো দা গামার গোলকিপার ‘বিলে।’ সেই ছেলেবেলাতেই স্ট্রাইকার হিসেবে তিনি এতটাই ভালো ছিলেন যে, অনেক সময় দুই দলের শক্তির ভারসাম্য রাখার জন্য তাকে গোলকিপিংয়ে দাঁড় করানো হতো। সেখানেও তিনি দারুণ সব সেভ করতেন। তার সঙ্গীরা তখন মজা করে বলত, ও মনে হয় নিজেকে ‘বিলে’ ভাবে। পেলে নিজে অবশ্য ‘বিলে’ নামটি ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারতেন না। অনেকটা শোনাত ‘পেলে’র মতো। সেখান থেকেই ক্রমে ‘বিলে’ বিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় ‘পেলে।’ তখন অবশ্য পেলে নিজে এই নাম একটুও পছন্দ করতেন না। বাবাই ছিলেন পেলেন গুরু, মেন্টর ও ট্রেনার।

১৯৫৬ সালে বাউরুর স্থানীয় কোচ ভালদেমার দে ব্রিতো পেলেকে নিয়ে গেলেন সান্তোস ফুটবল ক্লাবে। ১৫ বছর বয়সী কিশোর ফুটবলারকে নিয়ে সান্তোস কর্তৃপক্ষকে তিনি বললেন, ‘এই ছেলেটাকে দেখুন, একদিন বিশ্বের সেরা ফুটবলার হবে।’ অনুশীলনে সান্তোসের কোচ লুইস আলোন্সো পেরেস ‘লুলা’ পছন্দ করে ফেললেন কিশোর ফুটবলারকে। ওই বছরে জুনে সান্তোসের সঙ্গে পেশাদার চুক্তি হলো পেলের।

১৯৫৭ সালে মৌসুমের শুরু থেকেই সিনিয়র দলে নিয়মিত পেলে। চোখধাঁধানো স্কিল আর গোলের পর গোল করে তাক লাগিয়ে দেন। ১৬ বছর বয়সেই সিনিয়র লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, প্রথম পেশাদার ফুটবলে পা রাখার মাত্র ১০ মাসের মধ্যে ব্রাজিল জাতীয় দলে ডাক পান। ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই, বয়স তখনও ১৭ পূর্ণ হয়নি, জাতীয় দলের জার্সিতে অভিষেক হয়ে যায় তার। মারাকানায় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচটিতে অবশ্য তারা হেরে যান ২১ গোলে। তবে ৮০ হাজার দর্শকের সামনে বদলি হিসেবে নেমে ব্রাজিলের একমাত্র গোলটি করেন পেলে। বয়সকে হার মানিয়ে বিশ্বকাপ দলে পেলের জায়গা পাওয়া ছিল অবধারিতই। ১০ নম্বর জার্সি দেওয়া হয় তাকে। অনেকটা নাটকীয়ভাবে সুস্থ হয়ে তিনি খেলতে নামেন বিশ্বকাপে ব্রাজিলের তৃতীয় ম্যাচে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে। সে সময় বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার ছিলেন তিনি। গোল না পেলেও ওই ম্যাচে গোলে অবদান রাখেন তিনি, প্রতিভার জাদুও দেখান কিছু। সেমিফাইনালে ফেভারিট ফ্রান্সকে ৫২ গোলে উড়িয়ে দেয় ব্রাজিল, পেলে করেন হ্যাটট্রিক। বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হয়ে যান তিনি ১৭ বছর ২৪৯ দিন বয়সে। শুধু মাঠে নামার রেকর্ডেই তো তিনি তৃপ্ত থাকার মতো নন। স্বাগতিক সুইডেনের বিপক্ষে ৫২ গোলের জয়ে তিনি গোল করেন দুটি।

১৯৬২ বিশ্বকাপ খেলতে যখন চিলিতে যান পেলে, বিশ্বের সেরা ফুটবলার হিসেবে তিনি তখন প্রায় সবার কাছে স্বীকৃত। প্রথম ম্যাচে মেঙিকোর বিপক্ষে দলের প্রথম গোলে অবদান রাখেন তিনি, পরে নিজে অসাধারণ এক গোল করেন চার ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে। পরের ম্যাচে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে দূরপাল্লার এক শট নিতে গিয়ে বাঁধে বিপত্তি। চোট পেয়ে টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে যান তিনি। ব্রাজিল ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে খেলতে যায় টুর্নামেন্টের ফেভারিট হিসেবে। পেলে তখন বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান ফুটবলার। তারকায় ঠাসা গোটা দলই। তবে তাদেরকে থামাতে প্রতিপক্ষ বেছে নেয় নির্মম ফাউলের পথ। চোটাক্রান্ত হন পেলেও। প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে গারিঞ্চার গোলে ব্রাজিল এগিয়ে যাওয়ার পর ফ্রি কিক থেকে গোল করেন পেলে। প্রথম ফুটবলার হিসেবে কীর্তি গড়েন টানা তিন বিশ্বকাপে গোল করার।

সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে নিজের হাজারতম গোলটি করেন পেলে ১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর। ভাস্কো দা গামার বিপক্ষে ম্যাচে পেনাল্টি থেকে গোলটি করেন তিনি। গোটা গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায় তাকে। সেই গোল বিখ্যাত হয়ে আছে ‘ও মিলেসিমো’ বা ‘দা থাউজ্যান্ডথ’ গোল নামে। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর ব্রাজিল দল থেকে অনেকটা সময় দূরে ছিলেন পেলে। ১৯৭০ বিশ্বকাপে খেলা নিয়েও দ্বিধায় ছিলেন। পরে অবশ্য খেলার সিদ্ধান্ত নেন। বাছাইপর্বে ৬ ম্যাচে করেন ৬ গোল। আন্তর্জাতিক ফুটবলে পেলে শেষবারের মতো মাঠে নামেন ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই। তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ইতি টানেন ব্রাজিলের জার্সিতে তার গৌরবময় অধ্যায়ের। ইউনিসেফের হয়ে শিশুসুরক্ষায় কাজ করার জন্য ‘আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয় পেলেকে। ১৯৮১ সালে ‘এস্কেপ টু ভিক্টরি’ সিনেমা দিয়ে অভিনয়ে অভিষেক হয় ফুটবলের রাজার।

১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের হল অব ফেমএ অন্তর্ভুক্ত করা হয় থাকে। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কোর শুভেচ্ছাদূত হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৯৫ সালে ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। ফুটবল ও ক্রীড়াক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করতে নানা পদক্ষেপ নেন তিনি, প্রণয়ন করেন আইন, যা পরিচিত পেয়ে যায় ‘পেলে আইন’ নামে। ১৯৯৮ সল পদত্যাগ করেন এই দায়িত্ব থেকে। ১৯৯৭ সালে পান ব্রিটেনের রানীর দেওয়া সম্মানসূচক নাইটহুড খেতাব। ব্যালন ডি অর জয়ী ফুটবলারের মধ্যে শতাব্দী সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন তিনি ১৯৯৯ সালে। একই বছরে পান ওয়ার্ল্ড সকারের শতাব্দী সেরা ফুটবলারের সম্মান, বার্তাসংস্থা রয়টার্স ও আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির চোখে ‘অ্যাথলেট অব দ্য সেঞ্চুরি।’ ফিফার শতাব্দী সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি পান পরের বছর। এছাড়াও অসংখ্য খেতাব, অর্জন, স্বীকৃতি পান তিনি নানা সময়ে। গত জুনে তিনি যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে খোলা চিঠি লেখেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। ক্যান্সারের সঙ্গে তার লড়াই চলছিল অনেক দিন ধরেই। হাসপাতালেও যেতে হয়েছে প্রায়ই। কখনও কখনও অবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছে যে মৃত্যুর গুজবও ছড়িয়েছে। অবশেষে ২৯ ডিসেম্বর হাসপাতালে থেকেই তিনি চলে গেলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ৩ আনসারকে অব্যাহতি সরানো হলো পুলিশ কর্মকর্তাকে
পরবর্তী নিবন্ধমহেশখালীতে ঘরে ঢুকে যুবককে কুপিয়ে হত্যা