সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহারের কথা একুশের পর যেন ভুলে না যাই

মুহাম্মদ শামসুল হক | বুধবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমাদের ভাষার কথা মনে পড়ে, ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি মানসপটে ভেসে ওঠে। আবেগে উদ্বেলিত হয়ে মাস জুড়ে নানা আচারঅনুষ্ঠানের আয়োজন করে সরকারিবেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সংবাদ মাধ্যমগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি সংবাদ মাধ্যমে একুশ দিন ধরে শহীদ মিনারের প্রতীকসহ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও এর চর্চার ওপর গুরুত্ব দিয়ে কলাম/নিবন্ধ ছাপে। বিভিন্ন এলাকায় অযত্নঅবহেলায় নিভৃতে পড়ে থাকা ভাষা সৈনিকদের খোঁজখবর নিয়ে প্রকাশ করে আবেগময় প্রতিবেদন। একুশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার আলোচনা পর্বে কর্তাব্যক্তিদের মুখে বাংলা ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব ও অঙ্গীকার নিয়ে প্রাঞ্জল বক্তৃতাও শোনা যায় প্রতিবছর। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। আমরা আমাদের ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের নিয়ে গর্ব করি। গর্ব করি বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায়। কিন্তু এত আয়োজনের ফলাফল কী, ভাষার মর্যাদা তথা সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহারের অঙ্গীকার কতটুকু রক্ষা হচ্ছে, যা হচ্ছে তা সঠিকভাবে হচ্ছে কীনা এসব খবর কী ভালোভাবে নেওয়া হয় সারা বছর? একুশকে সামনে রেখে মাথা নত না করার অঙ্গীকার কী রক্ষা করা হচ্ছে সর্বত্র?

আমরা দেখি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় নামফলক, দাপ্তরিক চিঠি, দরপত্র বিজ্ঞপ্তি, বিয়েখৎনাসহ বিভিন্ন পারিবারিক আমন্ত্রণপত্র, পণ্যের মোড়ক ইত্যাদি লেখা হচ্ছে ইংরেজিতে। অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজিবাংলার মিশ্রণে এক ধরনের খিচুরি ভাষায়। স্থানীয়ভাবে আয়োজিত অনেক অনুষ্ঠানে মঞ্চে পরিচিতি ফলকেও দেখা যায় ইংরেজির অহেতুক ব্যবহার। মান্ধাতা আমলের শব্দ গাঁথুনি ও ভুল বানান তো আছেই। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের সংবাদবিজ্ঞপ্তি ও চিঠির ভাষা পড়ে মনে হয় না এগুলো বাংলা ভাষায় শিক্ষিত কোনো ব্যক্তি তৈরি বা তত্ত্বাবধান করেছেন। আসলে বাংলা অক্ষরে লেখা এসব চিঠি ও বিজ্ঞপ্তি বাংলা ভাষাকে বিদেশি ভাষার কাছে ঠাট্টার বস্তু করার নামান্তর।

প্রসঙ্গক্রমে অতি সম্প্রতি একটি বাংলা জাতীয় দৈনিকে ইংরেজিতে প্রকাশিত দুটি দরপত্র বিজ্ঞপ্তির কথা উল্লেখ করা যায়। চট্টগ্রাম বন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পোশাক তৈরির, অপরটি পটিয়া পৌরসভার সড়ক ও নালা নির্মাণ এবং সংস্কারের জন্য দরপত্র। দেখেই বোঝা যায় এগুলো কোনো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য নয়, যার জন্য বাংলা পত্রিকায় ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞাপন দিতে হলো। এমনকি এই ফেব্রুয়ারি মাসের চলতি সপ্তাহেই একটি বিয়ের আমন্ত্রণপত্র এবং অন্য একটি ওষুধ কোম্পানির প্রচারপত্র হাতে পেলাম যেগুলোর বেশিরভাগই বিতরণ করা হচ্ছিল ভালো ইংরেজি না জানা বাঙালিদের কাছে।

তা ছাড়া এমনকি জেলাউপজেলা পর্যায়ে আয়োজিত বিভিন্ন আলোচনা বা কর্মশালায় দেশি লোকদের মুখে বিদেশি ভাষার ফুলঝুড়ি দেখে মনে হয় ওইসব বক্তা হয় বাংলা ভাল জানেন না অথবা তাঁরা ভেবে দেখেন না যে, ওই অনুষ্ঠানের অধিকাংশ শ্রোতা ইংরেজি বক্তৃতার সব মানে বোঝেন কী না।

আমাদের স্বনামধন্য এক প্রবীণ সাংবাদিকের নেতৃত্বে বা কর্তৃত্বে প্রকাশিত একটি দৈনিক দেখলে মনে হতো পাকিস্তানিদের বাংলা হরফে আরবি শেখানোর অপচেষ্টার মতো বাংলা হরফে ইংরেজি শেখানোর একটা উদ্ভট চেষ্টা হয়তো চালানো হচ্ছে। মফস্বল শহরের অনেক অর্ধশিক্ষিতমধ্যশিক্ষিত লোক ঢাকাচট্টগ্রামের মতো মহানগরে এসে নামকরা দোকানপাট, বিপণিবিতান বা সড়কের নামফলক দেখে ঠিকানা বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু নগরে প্রায় স্থাপনা বা সড়কে সাধারণ মানুষের বোধগম্য বাংলা ভাষায় লেখা নামফলক তেমন একটা দেখা যায় না। অথচ প্রায় ১০ বছর আগে, ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতের এক নির্দেশনায় দেশের সব নাম ফলক, বিজ্ঞপ্তি ফলক, পরিচিতি ফলক, এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছিল। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ এর ৩ ধারায়ও সব কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালের ১৪ মে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও সেনানিবাস কর্তৃপক্ষগুলোকে আদালতের আদেশ কার্যকর করার করতে বলে। ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অপর এক চিঠিতে নাম ফলক, বিজ্ঞপ্তি ফলক, পরিচিতি ফলক ও গাড়ির নম্বর ফলকে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ জানায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে সরকারিআধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক নথি, চিঠিপত্র, পরিচিতি ফলক ব্যবহার দৃশ্যমান হলেও বেসরকারি প্রায় প্রতিষ্ঠানে আদালতের আদেশ উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে সরকারি প্রশাসন বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর কোনো উদ্যোগও দেখা যায় না। অনেকের মতে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চালানোর ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের মতো অনুমোদনদাতা কর্তৃপক্ষ অনুমোদন নবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং অন্যথায় অনুমোদন বাতিল করার মতো পদক্ষেপ নিলে অনেকটা সুফল মিলতে পারে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা থাকাও জরুরি। বলা বাহুল্য, গত বছর ফেরুয়ারিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বইমেলা সংক্রান্ত এক সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমানসহ একাধিক ব্যক্তি নগরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বা প্রচার ফলকে বাংলা লেখার ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান। মেয়র মহোদয় এ ব্যাপারে আশ্বাস দিলেও তার কোনো ফলাফল দেখা যায়নি। অনেকের ধারণা, এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক মনোাভাবই দায়ী।

প্রকৃত অর্থে আমরা ইংরেজি, জার্মান, জাপান, আরবি বা অন্য বিদেশি ভাষা শেখার বা জানার বিরুদ্ধে নই। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিসহ নানা বিষয়ে জানা ও দেশবিদেশে কূটনৈতিক মিশনসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপন, তথ্য বিনিময় এবং সরকারি বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন ইত্যাদিতে চাকরির জন্যও ইংরেজি জানা আবশ্যক। কিন্তু অবশ্যই নিজের ভাষাকে অবজ্ঞাঅবহেলা করে বা ভুলে গিয়ে নয়। ফেব্রুয়ারি মাস এলে শহীদদের স্মরণে নানা কথা বলব, ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে প্রয়োজনে আবারও নতুন লড়াইয়ের শপথ নেব, একুশের সকালে জনতার ভিড়ে মিশে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলব। অথচ ফেব্রুয়ারি যাবার পর সবকিছু ভুলে নতুন করে ঘরেবাইরে বিদেশি ভাষার চর্চা করে যাব, এটা শহীদদের আত্মার প্রতি প্রতারণা ছাড়া আর কীইবা হতে পারে? নিজের অস্তিত্ব ও মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের জাতীয়তাস্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা ও সর্বস্তরের মানুষের সামনে গর্ব করার মতো মানসম্পন্ন বাংলাভাষা জানা এবং সর্বোচ্চ চর্চা করা সবার জন্য জরুরি। বিষয়টি প্রতি ফেব্রুয়ারি শুধু নয়, সারা বছরই সবার মনে রাখা অবশ্য কর্তব্য।

প্রসঙ্গক্রমে আমরা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করতে পারি ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলায় ভাষণ দানের কথা। তিনি দাপ্তরিক নথিগুলোতে আদেশনিষেধ কিংবা মন্তব্য লিখতেন বাংলায়। ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন। বিদেশিদের সামনে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে জাতির পিতা ও দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা জাতির মানসম্মান নষ্ট না হয়, আমাদের দেশের ভেতর নিজেদের মধ্যে লেখায় বলায় বাংলার ব্যবহার অগৌরবের হবে এমনটি যারা ভাবেন তাদের মধ্যে স্বজাত্যবোধ নেই বললে চলে।

লেখক : বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, ফেলো বাংলা একাডেমি, সম্পাদক ইতিহাসের খসড়া

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষাই ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধচাণক্য গুরু প্রার্থনা শুনুন