মাজেদ এতদূর এসে ভেতরে ঢুকতে পারবে না ভাবতে পারেনি। আসার সময় কোন ক্লান্তি বোধ করেনি। কিন্তু এখানে এসে যখন দেখল গেইট বন্ধ তখন শক্তিতে আর কুলাতে পারছে না। তারপরও ধৈর্য ধরে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আশে পাশের লোকজন যে যারমত করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ এটা সেটা বিক্রি করছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মা বাবার সাথে এসে গেইটের বাইরে ছুটাছুটি করছে। মা বাবার কাছে এটা ওটা কিনে দেওয়ার বায়না ধরছে। তবে গেইট কেন বন্ধ এটা বলার কেউ নেই। কেউ বলছে অনেক দিন থেকে বন্ধ। কখন আবার খুলবে তা ঠিক নেই। তবে বিজয় দিবসের দিন খুলে দিতে পারে। একজন দাঁড়িয়ে মাস্ক বিক্রি করছে, সে বলছে করোনার সময় যে বন্ধ হয়েছে তারপর আর খোলেনি। পার্ক রেস্তোরাঁ বিনোদন কেন্দ্র চিড়িয়াখানা একে একে সবই খুলে দেওয়া হলো এটা কেন খোলা হলো না। এর গেইট কেন বন্ধ থাকবে? এ মাসে এর সব দ্বার খুলে যাওয়ার কথা। শুধু কি দ্বার জানালা গুলোও। কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। মাজেদ এদিক ওদিক কোন দিকে তাকায় না। এখানে তার বয়সী কেউ নেই। আশে পাশে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা অনেক তরুণ। বলতে গেলে এ প্রজন্মের কিংবা এর আগের প্রজন্মের। এদের সাথে কিছুই মেলাতে পারেনা। এদের কাছে এটা বিনোদনের একটি স্থান, এখানে অনায়াসে ঘুরাফিরা করা যায়। এত সহজে বিনোদনের এরকম উত্তম জায়গা আর কোথায় পাওয়া যায়? ছেলে মেয়ে, মা-বাবা, জিনিস বিক্রেতা কে কি করছে সেদিকে তাকানোর সময় কোথায়। তাদের কথা শোনারও মানসিকতা নেই। এখন লোকজন কোন কিছুর ভেতরে যেতে চায় না। বাইরের দিকটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সে গেইটের কাছে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকে। সূর্যটা তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। পথের দু’ধারে ছোট ছোট গাছ গুলো সবুজ পাতা পল্লবে ছেয়ে আছে। আশে পাশের ঘাসগুলো কারা যেন সবুজ গালিচার মত বিছিয়ে দিয়েছে। সবুজের মাঝে লাল ইটগুলো সরু পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছে। ইটের পর ইট সবুজের সমারোহে লালের সীমারেখাকে অনেক দূর টেনে নিয়েছে। এটা কি রক্তের লাল নাকি রঙের লাল ঠিক বুঝার যায় না। ইটের রংতো ধূসর লাল আর রক্তের রং টকটকে লাল। সূর্যের রক্তিম আভায় এ লালকে চেনা বড় কঠিন। এ লালকে চিনতে আরো অনেক আগে ফিরে যেতে হবে। যে ফেরা এত সহস নয়। অনেকে পারে না সেখানে আবার ফিরে যেতে। তবে কেউ কেউ পারে সেখানে যেতে। মাজেদ সেখানে আর সহজে যেতে চায় না। এ মাসটিতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। সব বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে এ মাসটি তাকে এখানে নিয়ে আসে। সে তখন কারো কথা শুনে না। এ সময়টাতে সে খুব অস্থির হয়ে উঠে। কোন কিছুতে মনকে স্থির করতে পারে না। বয়সের ভারও তাকে থামাতে পারে না। এ মাসটিতে জ্বরা ব্যাধিও কোথায় যেন পালিয়ে যায়। মনের সাহস বড় সাহস। মনের তারুণ্য সবচেয়ে বড়। এখানে এলে মনটা যেন তারুণ্যে ভরে যায়। সে সময়টাকে খুঁজে পায়। এটা শুধু তারুণ্যের সময় নয় যেন যৌবনেরও অকুতোভয় সময়। কোন কিছুতেই পর ভয় মানতে চায় না। এমন নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে আছে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে সে। এ হারানোর মাঝে সবকিছু আবার খুঁজে ফিরে। শৈশব কৈশোর এমনকি যৌবনও কখনো ফিরে আসে না কিন্তু এ অসীম সাহসের সময়টা যেন বার বার ফিরে আসে। এটা কোন বয়সের সীমারেখা মানতে চায় না। সব বয়সের সকল সময়কে যেন ধারণ করে আছে এ অসম সময়টা। এটা যেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সময়। একটু একমনে তাকিয়ে থাকারও সুযোগ হচ্ছে না। ছেলে ছোকরাও শব্দ করে চলছে। বেচা বিক্রিও হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে। গেইট বন্ধ সবাই এখানে জড়ো হচ্ছে। যানবাহনের শব্দ তো কানে লেগেই আছে। এসব ভাবনায় ধারে কাছে তো কেউ নেই। কিছুক্ষণ পরপর এটা সেটা নিয়ে এসে কিনব কিনা জানতে চায়। চা ওয়ালা এরি মধ্যে কয়েকবার এসেছে। না শুনে মত হয়ে থেকেছি। কিছুতেই ছাড়ে না। হাত ইশারায় বলতে হয়েছে, না। চা খেতে খানিকটা মন চাইলেও এ সময়টাতে চা খাওয়ার কথা ভাবতে পারেনি।
স্মৃতি সৌধটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। সূর্যের আলোতে কখনো কখনো ঝলমল করে উঠছে। বিটিভিতে সংবাদ পরিবেশনের আগে এ স্মৃতিসৌধটা এমন ভাবে দেখানো হতো যারা এখানে কখনো আসেনি তাদের কাছেও এটা অতি পরিচিত হয়ে উঠেছিল। মনের ভেতর গৌরব গাথার যেন অমর এক স্মৃতি। এ গৌরবের সাথে ত্যাগ আর বিসর্জনের অন্যরকম শোকগাথার কথা মনে করিয়ে দিতো। তখন একটি মাত্র চ্যানেল বিটিভি। একটি গানের সুর বেজে উঠতো। সবকটি জানালা খুলে দাওনা। সত্যি মনটা তখন বিজয়ের আনন্দে ভরে উঠতো। যে বিজয়ের সাথে করুণ কান্না মাখা ঘাসে শিশিরের শব্দ ভেসে আসতো। এ বিজয় কি আনন্দের, আবার কি দুঃখের। গেইটের সামনে লোকজন আরো বেড়ে গিয়েছে। তারা সবাই ভেতরে ঢুকতে চায়। সবুজ চত্বরে হেঁটে বেড়াতে কতই না আনন্দ লাগে। ছেলে মেয়েদের মনটাও খুশীতে ভরে যায়। কেউ কেউ ছুটাছুটি করে। ফুল পাতায় হাত দিতে চায়। মোবাইলে ছবি তোলে। এখন ঢুকতে পারছে না কেউ। বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকে সময়টা পরে করে দিচ্ছে। মাস্ক বিক্রেতা ছেলেটা জনে জনে গিয়ে সাধছে। তেমন একট বিক্রি হচ্ছে না। বেশি চলছে ঝালমুড়ি, বাদাম, চানাচুর। ধূলা বালি থেকে রক্ষা পেতে কেউ কেউ মাস্ক আগেও পড়েছে। করোনাকালীন সময়ে শহরে সবাইকে মাস্ক পরতে হয়েছে। দ্বিতীয় ডেউয়ের কথা শোনা গেলেও এখনও অনেকে মাস্ক না পরে ঘর থেকে বের হচ্ছে। সচেতনতা এসব সহজ বিষয় নয়। না, এসবতো এখন ভাবার কথা নয়। মাস্ক বিক্রেতা ছেলেটি কাছে আসায় এসব কিছু চলে এসেছে। মাজেদ আবার স্থির দৃষ্টি মেলে তাকায়। সবুজ চত্বর লাল ইট বিছানো সরু পথ। কতদূর গিয়ে কেমন যেন দৃষ্টি আটকে যায়। অনেকটা থির হয়ে থাকে কিছুটা উঁচু জায়গাটিতে। চারিদিকে লালচে ইটের বেষ্টনী দেওয়াল। জাগাটা জুড়ে সবুজ ঘাসের সমারোহ। গভীর মমতায় ঘাসেরা যেন এ জায়গাটিকে জড়িয়ে রেখেছে। এখানে যারা ঘুমিয়ে আছে, তারা চিরনিদ্রায় এ শীতল মাটিকে অনির্বাণ করে তুলেছে। বিশাল এই জায়গাটি জুড়ে তারা শায়িত আছে। কতজন তারা? কেউ বলে কয়েক শত। আবার কেউ বলে কয়েক হাজার। হাজার মানুষের গণকবর, একি সহজে ভাবা যায়। একটি ছোট্ট নামফলকে লেখা আছে, অসংখ্য মানুষের গণকবর। এরকম একটি নয় দু’টি নয়, কয়েকটি। আরো হয়েতো রয়েছে দৃষ্টি সীমার বাইরে সেখানে সবুজ বন বনানী এখনো ছায়াশীতল করে রেখেছে। অনন্তকাল ধরে তারা এরকম ছায়াতলে ঘুমিয়ে থাকবে। কেউ স্মরণ করলে কি, না করলে কি? এখানে যারা আসে তারা সবাই স্মৃতি সৌধটা দেখে। আশে পাশে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বই পত্রের পাতায় যে স্মৃতি সৌধের ছবি এ যেন ভিন্ন এক স্মৃতি সৌধ। পাহাড়ের সমান উঁচু যেদিকে তাকাই যেন একই রকম। পাদদেশ যত বিস্তৃত যেন পাহাড়ের মত। উপরের দিকে পাহাড়ের ঢালগুলো খাড়া হয়ে যেন একের পর এক খুঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি যতই উপরের দিকে উঠে এসব ঢাল যেন বাকল ছাড়িয়ে মিনারের মত সরু হয়ে আকাশ স্পর্শ করছে অনেকটা পিরামিডের মত। একবার তাকালে সহজে চোখ ফেরানো যায় না। হাজার বছরের দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনা শোষণ বঞ্চনা আশা নিরাশায় অপরূপ স্বপ্নগাথা চোখের ওপর ভাসতে থাকে। হৃদয় মনকে একাকার করে তোলে। কি ত্যাগে কি ভালবাসায়, নাকি উভয়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। মাজেদ অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কোন শব্দ আর তার মুখ থেকে বের হতে পারে না। যুদ্ধও সে করছে, একেবারে সম্মুখ যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ। পাশের জন গুলিবিদ্ধ হয়ে শুয়ে পড়েছিল। সে থেমে যায়নি, যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে গিয়েছে। তখন একবারও বাকরুদ্ধ হয়নি। কোন ভাবাবেগ কাছে আসতে পারেনি। এত শক্তি অসীম সাহস কোথা থেকে আসাতো ভাবতে পারে না। এখন এসব কথা ভাবতেই চোখে জল এসে যায়। এটা হয়তো আনন্দ অশ্রু নাকি আনন্দ বেদনার জল কে জানে। সূর্যটা যেন একেবারে মিনারের সাথে লেগে আছে। একটু পরেই পশ্চিম আকাশে বিলীন হয়ে যাবে। টকটকে লাল গোল সূর্যটার দিকে এখন সহজে দৃষ্টি রাখা যায়। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আলোটা স্মৃতি সৌধের পরতে পরতে এমন করে রঙিয়ে তুলেছে যেন চির সবুজের এ মাটিতে যারা শায়িত আছে তাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। এত পাখি আগে কখনো দেখা যায়নি। এতদিন নিথর নিশব্দ থাকায় পাখিদের আনাগোনাও বেড়ে গিয়েছে। দলে দলে পাখিরা পাশের বন বনানীতে উড়ে যায়। আবার জলাশয়ের দিকেও ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখিরা উড়তে থাকে। সাঁঝের বেলায় সব পাখিরা নীড়ে ফিরতে চায়। সূর্যটা ডুবে গিয়েছে। কিন্তু সব রক্তিম আভা যেন স্মৃতি সৌধের মিনার শৃঙ্গ মেখে রেখে গিয়েছে। এতক্ষণ পর মাজেদ ডানে বামে তাকায়। সে কিছুটা হতবাক হয়ে যায়। এত তরুণ কখন তার আশে আশে এসে দাঁড়িয়েছে সে টের পায়নি। পেছনেও অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও কি এতক্ষণ এ অপূর্ব দৃশ্যে বিভোর হয়েছে। কি জন্য তারা এখানে জড়ো হয়েছে? এসবের উত্তর তার কাছে জানা নেই। তবে কিশোর বালক একজন তার কাছ থেকে জানতে চায়। আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা? মাজেদ বালকটির দিকে অপলক চেয়ে থাকে। তখন কিশোর বালকটি মাজেদের চোখের ভেতর একজন মুক্তিযোদ্ধার ছবি খুঁজে পায়।
লেখক: প্রাবন্ধিক