সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলি

সালমা বিনতে শফিক | সোমবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৭:২১ পূর্বাহ্ণ

দুহাজার বিশ খ্রিষ্টাব্দটা শুরু হয়েছিল আতংক নিয়ে। অজানা এক রোগের প্রাদুর্ভাবে মড়ক লেগেছিল চীন দেশে, দুহাজার উনিশ বিদায় নেবার আগ মুহূর্তে। বিশ্বায়নের কাল। ভাল হাওয়া, মন্দ হাওয়া সবই ছড়িয়ে পড়ে জগতময়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবও সবার অলক্ষে বিমানে চড়ে, জাহাজে ভেসে পাড়ি দেয় মহাকাশ ও মহাসাগর। পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় পুরে দম্ভে ফেটে পড়া মানবজাতির অসহায়ত্ব নতুন করে মনে করিয়ে দেয় সর্বশক্তিমান বলে আছেন একজন কোথাও না কোথাও, যিনি সবই দেখছেন, সবাইকে দেখছেন। চিকিৎসক বলছেন, প্রার্থনা করুন; ধর্মগুরু বলছেন, বিজ্ঞানের জয় হোক। ধরিত্রী বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, ক্ষুব্ধ হয়েছে মানবের অমানবিক আচরণে- এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ সকলে। কেউ বলছেন প্রকৃতির প্রতিশোধ, আবার কেউবা বলছেন শুদ্ধি অভিযানে নেমেছে প্রকৃতি। সত্যি কি তাই?
কোভিড-১৯ নামের অণুজীব চীন দেশ থেকে সরাসরি ইউরোপ, আমেরিকা অভিমুখে যাত্রা করে। মানবজাতির যত আয়োজন জীবন সাজাতে। জীবন বাঁচাতে ভাবনা নেই, বলাই যায়। যায় যাবে যাক প্রাণ, প্রাণের চেয়ে অর্থ বড়। বাণিজ্যের চাকা অচল রাখা যায়না। বিলাস বসন আনন্দ বিনোদন কোন কিছুতেই তাই কাটছাঁট করা চলেনা। পৃথিবীর অর্থনীতিকে সচল রাখতে দেশে দেশে আগমন নির্গমন অব্যাহত থাকে। মহামারী প্রতিরোধের একমাত্র উপায় সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া, এবং যে যেখানে আছে সেখানেই থেকে যাওয়া- বিশ্বনবী বলে দিয়েছিলেন চৌদ্দশ বছর আগে। পৃথিবীর সকলে সংযমী হয়ে অল্প কিছুদিন সুস্থির থাকতে পারলে অণুজীব এমন করে বিশ্ব পরিক্রমায় বের হতে হয়তো পারতনা। কিন্তু ধর্মের বিধান আমরা মানব কেন? আধুনিক পৃথিবীতে ধর্মকে আস্তাকুঁড়ে পাঠানোর যাবতীয় বন্দোবস্ত পাকা।
ফেব্রুয়ারি জুড়ে আমাদের বিশেষজ্ঞদের অনেকে আশ্বস্ত করেছিলেন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বাংলাদেশে টিকে থাকতে পারবেনা করোনা নামের অণুজীব। চৈত্র এসে পড়ল বলে। এর পরেই গ্রীষ্মের দাবদাহ। কোভিড হার মানতে বাধ্য বাংলার বুকে। অতএব ভাবনা নেই। জনগণ, জনপ্রতিনিধি সবাই নির্ভার। নগরে-নগরে পুনর্মিলনের উৎসব লেগেছিল মধ্য মার্চ অবধি। অতঃপর খবর আসে আকাশ পাড়ি দিয়ে আমাদের বাংলাদেশে এসে পড়েছে কোভিড-১৯। বহুল প্রতীক্ষার মুজিববর্ষের প্রাক্কালে জনসাধারণের সুরক্ষায় সরকারপ্রধানের জরুরী ঘোষণায় তড়িঘড়ি ঘরে ফিরে সকলে।
কোভিড যে এমন করে ঝাঁকুনি দিল পৃথিবীটাকে, আমাদের মতো খাওয়া পরার ভাবনাবিহীন মানুষগুলো কী আদৌ তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত? আমাদের প্রাত্যহিক জীবনধারায় সত্যিই কী ইতিবাচক কোন পরিবর্তন দৃশ্যমান? হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে নেমেছেন, দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেকেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আশেপাশের কর্মহীন মানুষদের দিকে। শুধুমাত্র সেকারণেই পৃথিবীটা আজও নরক হয়ে যায়নি । কিন্তু যারা মিথ্যা বলত, আজও বলছে; যারা চুরি (ছোট চুরি-বড় চুরি) করত, আজও করছে। যারা প্রতারণা করত, আজও করছে। যারা দুর্নীতি করত, আজও করছে। যারা ভেজাল পণ্য তৈরি করত, আজও করছে। যারা মাদক পাচার করত, আজও করছে। যারা মানব পাচারে জড়িত ছিল ছুটি নেয়নি তারা। খুন ধর্ষণ চলছে বিরামহীন। আর যারা সাফাই গাইত, আজও গেয়ে চলেছে।
রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দুর্দশাগ্রস্তদের জন্য ত্রান বরাদ্দ হয় অকাতরে। কিন্তু বিতরণের বেলায় অকাতরে হাত খুলতে বড় বাঁধে আমাদের নামিদামী নাগরিক ও জনপ্রতিনিধিদের। ত্রানের অর্থ ও চাল ডাল আলু তেল আটা লুটপাট হয়নি- এমন দিন আমার বাংলাদেশ কোনদিন দেখেনি। দেখবে কোনকালে- সে আশাও নেই। কাজ হচ্ছে প্রচুর, ম্যালা কর্মযজ্ঞ চতুর্দিকে। তবে সর্বত্র অন্যায়, অনিয়ম, অসমন্বয়, অসামঞ্জস্য, অশোভন আচরণের ছড়াছড়ি। প্রতিদিন এত এত প্রাণহানির খবর! সাধারণ মানুষ থেকে নামীদামী নাগরিক মারা পড়ছে। করোনার ছোবল কেবল নয়, চিকিৎসাব্যবস্থার ‘কঙ্কালসার’ অবস্থা বড় নগ্নভাবে ফুটে উঠছে। সম্মুখসারির যোদ্ধা প্রাণরক্ষাকারী চিকিৎসক ও চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত সহকারীগণ সঠিক সুরক্ষা সামগ্রীর অপ্রতুলতায় বড় অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন কোভিডের কাছে। অপরদিকে মৃতের সংখ্যা উন্নত বিশ্বের তুলনায় কম বলে জনপ্রতিনিধিগণ স্বস্তি প্রকাশ করেন। আমজনতাও কম যায়না, নিয়ম কানুনের বাঁধন আলগা করে দুরন্ত কিশোরের মতো কেবলই বেপরোয়া ছুটে চলে।
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে পৃথিবী জুড়ে। বড়দিন ও বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা স্থগিত করা হয়েছিল পশ্চিমের সকল দেশে। আমাদের এখানে সকলে বাধাবন্ধনহীন। অতিথি সৎকার, শীতকালীন ছুটি, মৃতের শ্রাদ্ধ কুলখানি কোন কিছুতে কাটছাঁট করতে রাজি নয় কেউ। আমাদের পাহাড়, সাগর, অরণ্য লোকে লোকারণ্য; বিপণীবিতান, রেস্তোরাঁ, বিনোদন কেন্দ্র উপচে পড়ছে। কাগজে দেখলাম, ছোট ও বড় পর্দার এক ঝাঁক রঙমাখা রূপবতী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, গায়ে গা লাগিয়ে ফিতা কেটে, কেক কেটে কি একটা ফ্যাশন হাউজের শুভউদ্বোধন করছেন। শাড়ির রঙে রঙ মিলিয়ে মুখোশ থুতনিতে আঁটা ছিল দু’একজনের। সকলেই নগ্নমুখে হাসছিলেন। খ্যাতনামা দু’তিনজন পুরুষ তারকাও ছিলেন তাঁদের আশেপাশে। এই হল আমাদের স্বাস্থ্যবিধির হালচাল। এরই মাঝে আমাদের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে বঙ্গোপসাগরের বুকে বিলাসবহুল প্রমোদতরী ভাসানো হয়েছে বিজয়ের মাসে। উৎসবের নৃশংসতা চলমান ছিল বছর জুড়ে। থেমে নেই নির্বাচনের ডামাডোল ও সহিংসতা।
বিশ্বজুড়ে সকল দেশের সকল জাতির মানুষ কোন না কোনভাবে স্বাস্থ্যবিধি লংঘন করেছে, প্রতিনিয়ত করছে, যদিও সব দোষ গিয়ে পড়ে অভাগা বাঙালির ওপর। স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকারী যুবরাজ নগ্ন মুখে লন্ডনের দ্বিতীয় মাত্রার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বৈকালিক আনন্দভ্রমণে বের হন। গণমাধ্যম দুয়ো দেয়, ধুয়ে দেয়। তথাপিও শালগ্রাম শিলাসম ব্রিটিশ রাজতন্ত্র মুকুট সিংহাসন ভোগ করেই চলেছে গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার ও সমতার কাগজি পৃথিবীতে।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের সুবর্ণ সময়ে প্রচারিত জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ ফিরে এসেছিল টেলিভিশনের পর্দায়, করোনাকালে মানুষকে ঘরে রাখার অভিপ্রায়ে। “আশা ও আনন্দের যে অপরূপ দিন তার উল্টো পিঠে আছে দুঃখ ও বেদনার দীর্ঘ রজনী। আশা-আনন্দ, দুঃখ- বেদনা নিয়েই আমাদের এইসব দিনরাত্রি”। মানবজীবনের চিরায়ত দিনলিপির এমন নিখাদ ছবি যিনি এঁকেছিলেন তিনি কিংবদন্তী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। টেলিভিশনের পর্দায় ‘এইসব দিনরাত্রি’ ধারাবাহিকের শেষের দিকে চরম দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যায় নাটকের চরিত্রগুলো। যেকোন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রতিনিয়তই সম্পর্কেও টানাপোড়েন চলে। এটা জগতের রীতি। কিন্তু চরম দুঃসময়ে শক্তি আসে তখনই যখন পরিবারের সবাই এক হয়ে যায়। একে অন্যকে সাহস দেয়, শক্তি যোগায়। সমস্যার তাৎক্ষনিক সমাধান করতে না পারলেও মায়া মমতায় জড়াজড়ি করে থাকা মানুষগুলোর চোখেমুখে দেখা যায় স্বর্গীয় প্রশান্তি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ডঃ তেদরোস আধোনেম দুহাজার বিশের পুরোটা জুড়েই বৈশ্বিক সমপ্রীতি ও আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন; প্রতিদিনের কাগজে তাঁর সেই একই কপাল কুঁচকানো ছবি। কে শোনে কার কথা! করোনার সামনে অসহায় আত্মসমর্পণের পরও আমাদের দম্ভের শেষ নেই। প্রতিহিংসা ও প্রতিযোগিতার মানসিকতা এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি মানবজাতি।
আমরা যদি মনে করি, পৃথিবী নামক গ্রহটা একটা বৈশ্বিক পরিবার, তাহলে তার শাখা-প্রশাখা মহাদেশ ও দেশগুলো, ঠিক যেমন একান্নবর্তী পরিবারের শাখা-প্রশাখা একক পরিবারগুলো। ধরিত্রী মাতার এমন দুঃসময়ে আমরা কী পারিনা সব ভেদাভেদ, মতপার্থক্য আর প্রতিহিংসার কথা ভুলে এক হয়ে যেতে? চোর, হত্যাকারী, দুর্নীতিবাজ ধনকুবের, ভেজাল পণ্য প্রস্তুতকারী, আইন অমান্যকারীসহ দিনরাত অকারণে সাফাই গেয়ে যাওয়া মানুষগুলো একটু সংযত হয়ে অতিমারির ভয়াবহতা নিয়ে ভাবলে, বিশেষত ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য জীবাণুমুক্ত ও বাসযোগ্য একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখলে একতার শক্তি ফিরে আসবেই আমাদের মাঝে।
২০২০। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক ভৌতিক ও অভিশপ্ত বর্ষপঞ্জীর নাম। পৃথিবী কিন্তু কোন কালে ভুলে যাবেনা এই বর্ষটির কথা। ইতিহাসেতো লেখা থাকবেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থবিজ্ঞান, রাজনীতিবিজ্ঞান, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সংগীত এমনকি ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসেও নতুন অধ্যায় রচিত হবে এই বছরটিকে নিয়ে। আশা করা যায় নতুন ও নিরাপদ আগামীর কথা শোনাবে ২০২১। বিজ্ঞানীদের বছরব্যাপী হাড়ভাঙা খাটুনির বদৌলতে কোভিডকে পৃথিবী ছাড়া করার ব্যবস্থা একপ্রকার চূড়ান্তই বলা যায়। করোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনের সকল হীনতা-দীনতা দূর হয়ে যাক। ২০২১ মানব জাতির জন্য বয়ে নিয়ে আসুক মঙ্গল বারতা-
“সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলি শোন শোন পিতা
কহ কানে কানে শোনাও প্রাণে প্রাণে
মঙ্গল বারতা” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাম গোপাল ভার্মার সাক্ষাৎকার
পরবর্তী নিবন্ধমৃদুল কান্তি দাশ