সংবাদের ময়নাতদন্ত

সালমা বিনতে শফিক | সোমবার , ৭ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:১৮ পূর্বাহ্ণ

চব্বিশ নভেম্বর, ২০১৬। আগুনে ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় উপস্থিত গ্যাস লাইটার কারখানার শ্রমিক। পাশে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে স্বজন। খবরে প্রকাশ নারী আর শিশু শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। দগ্ধ শরীর নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে তারা। কেউই আশঙ্কামুক্ত নয়। চিকিৎসা চলছে। উন্নত চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি আছে। আছে আর্থিক সাহায্যও। তাতে কিবা এসে গেল !
পরের খবর- শিশুর গলিত লাশ উদ্ধার। হত্যাকারী হিসেবে গ্রেফতার দু’জন; দুই শিশু। অভিযুক্তদের আকুতি- তাদেরকে ভয় দেখিয়ে দায় স্বীকারে বাধ্য করা হয়েছে। যে চলে গেছে সেতো গেছেই, সব হিসেবের বাইরে, সীমানা পেরিয়ে। কিন্তু খুনের দায়ে ধরা পড়া এই দুজনের কি হবে ! ওদের শৈশব তো গেলই, কেমন করে বড় হবে ওরা! স্বাভাবিক জীবন কি আছে ওদের ভাগ্যে! তবে কি কপালটাই পুড়ল ওদের। এর দায় কিংবা দায়িত্ব কি নেব আমরা !
এই সব খবরে চমকে ওঠার মত কিছুই নেই। বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী আমাদের কাছে এসব নিতান্তই মামুলি ব্যাপার। অহরহই এমন ঘটনা ঘটছে আমদের চারপাশে। আমরা নির্বিকার। কয়লা হয়ে যাওয়া মানব সন্তান কিংবা পচে-গলে যাওয়া মানবশিশুর ছবি থেকে নিমিষেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আমরা চলে যেতে পারি সাহিত্য-সংস্কৃতি পাতায় যেখানে লিট ফেস্টিভ্যালের খবর আর ছবি আছে, কবিতা পাঠের আসর নিয়ে আছে কোন নিবন্ধ।
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর বসছে ঢাকার বুকে। চৌরাসিয়ার বাঁশিতে মুখরিত হবে আর্মি স্টেডিয়াম। দেশ বিদেশের আরও নানা নামজাদা শিল্পীরা আসবেন সুরের মূর্চ্ছনা তুলতে। সংস্কৃতিমনা বোদ্ধা শ্রোতাগন উচ্চমূল্যের প্রবেশপত্র নিয়ে যাবেন সেখানে। উপভোগ করবেন আনন্দসন্ধ্যা কিংবা রজনী। ঢাকা শহরের ভূগোল সম্পর্কে অজ্ঞ আমি গুগোল করে দেখি, আশুলিয়া (যে কারখানায় পরশু রাতে আগুন লেগেছিল) থেকে আর্মি স্টেডিয়ামের দূরত্ব মাত্র ২১ কিলোমিটার।
বিনোদন পাতায় আরও আছে দেশ-বিদেশের তারকাদের হাঁড়ির খবর। বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান হাঁটুর বয়সী মেয়েদের নায়ক হয়ে কেমন করে ধরে রেখেছেন তাঁর সিংহাসন, সেই খবর।
খেলার খবরে আছে বিস্ময় বালক মুস্তাফিজের প্রত্যাবর্তন নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনা। শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে দেশে-বিদেশে বেড়াতে যাবার তথ্য, আছে লোভনীয় ‘প্যাকেজ অফার’ ও। ফ্যাশন পাতা দেখে মনে হয় আমার বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে বিশ্বকেও।
আমাদের আগ্রহের সীমা নেই আটলান্টিকের ওপাড়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। মানবতা কেঁদে মরছে মিয়ানমারে। কথাটা যদিও সত্য সারা পৃথিবীর জন্য। তাতে কি-ই বা এসে গেল!
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি নিষ্ঠুরভাবে নিরব রয়েছেন। দেখেও দেখছেন না তাঁর দেশের নাগরিকদের দুর্ভোগ। গদিটা ধরে রাখাই কি সব !
শেষটা না হোক ঘরের খবর দিয়ে। আগের রাতে সমগ্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সেজেছিল নিয়ন আলোয়, পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে। আজ সেখানে থাবা বিস্তার করেছে অন্ধকার, রক্ত আর এঙ ফাইলসের চেয়ে জটিল গল্প। বিশ্ববিদ্যালয়ে শতকোটি টাকার দরপত্র নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রাক্তন ছাত্রের মৃত্যু। তার মৃত্যু নিয়ে যে রহস্য, তার কোন কূলকিনারা হবে কিনা জানা নেই। দরপত্রের টাকার ভাগাভাগিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জড়ানোর নজির পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা, জানা নেই তাও।

চার বছর পর আজ মিলিয়ে দেখা যাক- কতটুকু বদলেছে পৃথিবীর জীবনধারা। আজও সুচি মাথায় ফুল পরেন, মিষ্টি করে হাসেন। পৃথিবীর তাবৎ শান্তি ও মানবাধিকার রক্ষার সম্মেলনে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার ওড়াওড়ি করে। প্রতিনিধিবর্গের পকেট ভারী হয়। ঘরহারা মানুষদের ঘরে ফেরা হয়না। ধরিত্রীর অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান রোহিঙ্গারা টিকে থাকার আশায় আজও নানান অপকর্ম করে বেড়ায় বঙ্গভূমিতে। ওদের ত্রিপল ঘেরা কুটিরে কত হাতি ঘোড়া পায়ের চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেলেন একে একে! মানবতাবাদী হিসেবে ব্যাপক নাম কুড়োলেন সেসব তারকা। নাফ নদীতে অনেক জল গড়ালেও ওদের কপাল ফেরেনি, ভাগ্যের চাকা ঘোরেনি। তদুপরি, সুচি বিপুল ভোটে পুনঃনির্বাচিত।
সুচির কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই বোধ হয় নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ইথিওপিয় প্রধানমন্ত্রী আবি আহমদ উত্তরের রাজ্য তাইগ্রেতে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালাতে নির্দেশ দিয়েছেন সরকারি বাহিনীকে। নির্যাতনের মুখে সংখ্যালঘুরা দেশ ছাড়ছে। জাতিসংঘ একটু নড়েচড়ে বসছে। দেখা যাক কি হয় শেষ অবধি।
মার্কিন নির্বাচনে রাষ্ট্রপতিকে ছাপিয়ে উপ-রাষ্ট্রপতিকে নিয়েই যত জল্পনা কল্পনা। মার্কিন মুলুকে প্রথম নারী ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুর একেবারে কাছাকাছি। আফ্রো-এশিয় বংশোদ্ভূত অশ্বেতাঙ্গ কমলা হ্যারিসকে নিয়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে গণমাধ্যম। বঙ্গোপসাগরের তীরেও ঢেউ লাগে তার। নারীমুক্তির নামে কমলার জয়ধ্বনি করছে ভারতীয় ও বঙ্গ ললনারা। গৌরবের অংশীদার হতে চায় পৃথিবীর তাবৎ নারী। কমলা যুক্তরাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্রপতির চেয়ারে সমাসীন হলেই যেন দুনিয়ায় আর কোন নারী নিগৃহীত নির্যাতিত অসম্মানিত হবেনা, আর কোন ফ্লয়েড জর্জকে সাদা পুলিশের হাঁটুর চাপে ‘আমি শ্বাস নিতে পারছিনা’ বলতে বলতে প্রাণ দিতে হবেনা। দুহাজার বিশের শেষার্ধে এসেও রাজনীতির নাটকীয়তা, প্রহসন, ভোজভাজির রকমফের ধরতে না পারলে ক্ষমতার মসনদ চিরটাকালের জন্য ওপরতলার মানুষদের কব্জাতেই থেকে যাবে। একালে কেউতো আর নজরুলের মতো সাহস নিয়ে বলতে পারবে না-
তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে, আমরা রহিব নিচে
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে।
ফিরে যাওয়া যাক সংবাদের ময়নাতদন্তে। আজও আমাদের কাগজের বিনোদন পাতায় বলিউড পাত্রপাত্রীরা কেন্দ্রীয় ভুমিকায়। আমাদের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে প্রতিদিন প্রিয়াংকাদের খবর। ওদের কাজের খবরের চেয়ে হাঁড়ির খবর, বিবাহের খবর, মধু চন্দ্রিমা যাপনের খবর, ঘরভাঙার খবর; বাড়তি পাওয়া নানা ভঙ্গিমায় তোলা রঙিন আবেদনময়ী বিশালাকৃতির ছবি। প্রিয়াংকা, দীপিকা, আনুশকা, ঐশ্বরিয়া, কারিনা, কঙ্গনা…… প্রভাস ও বলিউডি খান সাহেবেরা… তাদের পুত্র কন্যা, এমনকি সৎ সন্তান… সবার স্থান সংকুলান হবার পর কাগজের পাতায় কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকলে তবেই আমাদের শিল্পীদের খবর ও ছবি ছাপা হয়, নিতান্ত বর্ণহীনভাবে। আমাদের বিনোদন জগত আর ঢাকাই ছবির তারকারা আমাদের কাগজে বরাবর পার্শ্বচরিত্র। ওদের নামই আমরা জানি না ভাল করে।
বিশ্ব সংবাদ ও বিনোদন পাতা থেকে চোখ বুলানো যাক ঘরের খবরে। রাজধানীর বুকে সাততলা বস্তির অধিবাসী বীথিরানির পোড়া বেনারসি, কিশোরী তানিয়ার পুড়ে যাওয়া ছড়ার বইয়ের জন্য হাহাকার ভুলে যেতে দুদণ্ড লাগেনা আমাদের। খুন, গুম, পোড়া লাশ, ডুবন্ত লাশ, ভাসমান লাশের খবর বলে দেয় রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক সহিংসতা চলমান নতুন নতুন রূপে। দেশের সকল জনপদ হতে নারী জাতির দুর্ভোগের সংবাদ প্রতিদিনের পাতায়। অপরাধীকে রক্ষা বা আড়াল করার কসরত চলে সমাজের নানা স্তরে। প্রতারণাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে সকল পেশাজীবী, বিশেষত সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর কর্মোদ্দীপনার বদৌলতে, ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ মদদে। আজকাল খুব আসছে প্রবাসে বেগমপাড়ার খবর, সেইসঙ্গে খ্যাতিমান শিল্পীদের ঝাঁকে ঝাঁকে দেশছাড়ার খবর।
এখন বিশ্ব জুড়ে চলছে মড়কের কাল। অতিমারি বলে ভয় পাবে মানুষ, সেদিন আর নেই। একুশ শতক কোন কিছুর তোয়াক্কা না করার শিক্ষা দিয়েছে আমাদের। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর বলে দেয় কতটা বেপরোয়া, অসংযত, অসহিষ্ণু ও অমানবিক হয়ে পড়েছে মানবজাতি। অধ্যাপক এমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো প্রচণ্ড আশা জাগানিয়া মানুষ লিখেছেন ‘দুঃসংবাদের শেষ নেই’ (১২ নভেম্বর, দৈনিক আজাদি)। তবু অপেক্ষায় থাকি সুসংবাদ নিয়ে আসবে খবরের কাগজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ- এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধফাদার গাস্তঁ রোবের্জ: চলচ্চিত্রের নিবেদিত পুরোহিত