সংকটের মুখে প্রগতি

সরকারের ক্রয় নীতির কারণে সংযোজন করা হচ্ছে না ২শ কোটি টাকার গাড়ি

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দেশের গাড়ি তৈরির রাষ্ট্রায়ত্ত্ব একমাত্র প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে দুইশ’ কোটিরও বেশি টাকার গাড়ি ‘বাক্সবন্দি’ হয়ে পড়ে আছে। সব আয়োজন সম্পন্ন করা হলেও গাড়িগুলো সংযোজন করা সম্ভব হচ্ছে না। কোভিড পরিস্থিতির কারণে বহু কষ্টে অর্জিত ফসল ঘরে তুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজকে। সরকারের গাড়ি ক্রয় নীতিতে পরিবর্তন আনা না হলে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বড় ধরনের সংকটে পড়বে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, জাপানের বিশ্বখ্যাত মিৎসুবিশি মোটর্সের এল-২০০ মডেলের ডাবল কেবিন পিকআপ বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড। জাপান থেকে এই মডেলের অনেক গাড়ি দেশে আমদানি করা হয়েছে। আমদানিকৃত প্রতিটি গাড়ির দাম পড়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। অথচ প্রগতিতে সংযোজন করে বাজারজাত করা হলে এই গাড়ি পাওয়া যাবে ৪০ লাখ টাকার কাছাকাছিতে। এতে করে এই মডেলের গাড়ি সংযোজন এবং বাজারজাতকরণে আবেদন করে দেশে গাড়ি তৈরির রাষ্ট্রায়ত্ত্ব একমাত্র কারখানা প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। মিৎসুবিশির পক্ষ থেকে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের কারিগরি সক্ষমতা পরীক্ষা শেষে ৩২টি গাড়ি সংযোজন করতে দেয়া হয়। এরমধ্যে প্রগতিতে সংযোজিত ৩টি গাড়ি জাহাজে বোঝাই করে পাঠানো হয় জাপান। মিৎসুবিশির কারখানায় গাড়িগুলোর বিভিন্ন দিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। সংযোজিত গাড়িগুলো জাপানে সংযোজিত গাড়ির মতো হয়েছে কিনা, প্রগতি মিৎসুবিশির মান রক্ষা করে গাড়ি সংযোজন করতে পারবে কিনা, প্রগতি গাড়ি সংযোজন করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারে ছাড়লে মিৎসুবিশির বাজারে নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়বে কিনা ইত্যাদি খতিয়ে দেখতে ওই তিনটি গাড়ি জাপানে পাঠানো হয় গত ৮ অক্টোবর।
জাপানের কারখানায় পৌঁছার পর গাড়িগুলোর রঙ থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধাগুলো পরীক্ষা করা হয়। দেখা হয় গাড়ি সংযোজনের দক্ষতা, ফিনিসিং। পরীক্ষায় প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ রেকর্ড সংখ্যক মার্কস নিয়ে উত্তীর্ণ হয়। মিৎসুবিশির পক্ষ থেকে জানানো হয়- গাড়ি সংযোজনে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছে। সচরাচর এই ধরনের গাড়ি সংযোজনের সময় মিৎসুবিশির জাপান কিংবা থাইল্যান্ড থেকে আসা দুইটি বিশেষজ্ঞ টিম উপস্থিত থাকে এবং একটি টিমের তত্ত্বাবধানে গাড়ি সংযোজনের কাজ চলে। অপর টিম খুঁটিনাটি বিষয়গুলো দেখে থাকে। কিন্তু করোনা মহামারীকালে তিনটি গাড়ি সংযোজনের সময় জাপান কিংবা থাইল্যান্ড থেকে কোনো টিম পাঠাতে পারেনি মিৎসুবিশি। প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উপ প্রধান প্রকৌশলী এবং কারখানা প্রধান ইঞ্জিনিয়ার কায়কোবাদ আল মামুনের নেতৃত্বে কারখানার নিজস্ব প্রকৌশলীদের মাধ্যমে গাড়িগুলো সংযোজন করা হয়। জাপানে পাঠানো তিনটি গাড়ি পরীক্ষা করে মিৎসুবিশির বিশেষজ্ঞরা বেশ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। গাড়িগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সংযোজিত হয়েছে বলেও মতামত দিয়েছেন তারা। মিৎসুবিশির এই ধরনের পরীক্ষায় পাশের বেঞ্চমার্ক নির্ধারণ করা হয় ৩৫ পয়েন্ট। অর্থাৎ গাড়ি সংযোজনে ৩৫ পয়েন্ট বিচ্যুতি বা ত্রুটি মাইনাস ৩৫ পয়েন্ট (-৩৫ পয়েন্ট) হলেও পাশ বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু প্রগতির সংযোজিত গাড়িগুলো পায় মাইনাস ১৪.৭ পয়েন্ট (-১৪.৭ পয়েন্ট)। এর আগে আর কোনোদিন মিৎসুবিশির বিভিন্ন মডেলের গাড়ি সংযোজন করলেও এত কম ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আর কোনো মডেলের গাড়ি উত্তীর্ণ হতে পারেনি। মিৎসুবিশি লিখিতভাবে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ তৌহিদুজ্জামানকে এ কথা জানায়। সেই সাথে প্রগতিকে গাড়ি সংযোজন এবং বাজারজাতকরণের অনুমোদনও দেয়া হয়।
ট্রায়াল প্রোডাকশনের জন্য দেয়া ৩২টি গাড়ির মধ্যে প্রগতি ইতোমধ্যে ২৮টি উৎপাদন সম্পন্ন করেছে। আর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করতে প্রগতি ১০০ ইউনিট গাড়ি আমদানি করে। এর আগেরও পঞ্চাশটির মতো ডাবল কেবিন গাড়ি রয়েছে প্রগতিতে। সিকেডি অবস্থায় গাড়িগুলো আমদানি করা হয়। প্রয়োজনীয় অনুমোদনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও প্রগতিতে বর্তমানে ১৮০টি গাড়ি ডাবল কেবিন পিকআপ ‘বাঙবন্দি’ হয়ে পড়ে আছে। এগুলোর উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। গাড়ি বিক্রির সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় প্রগতি গাড়িগুলো নিয়ে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে।
এল-২০০ ডাবল কেবিন পিকআপের পাশাপাশি প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ বেশ কয়েক বছর ধরে মিৎসুবিশির পাজেরো স্পোর্ট কিউএঙ জিপ সংযোজন করে বাজারজাত করছে। এই মডেলের ১৮০ ইউনিট গাড়িও বাঙবন্দি।
দুই মডেলের দুইশ’ কোটির বেশি টাকার গাড়ি বাঙবন্দি হয়ে পড়ে থাকায় প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। অপরদিকে গাড়ি বিক্রি না থাকায় কোনো কাজ নেই প্রগতির চার শতাধিক শ্রমিক কর্মচারীর হাতে। বসিয়ে বসিয়ে বেতন ভাতার যোগান দেয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রগতি মহাসংকটে পড়বে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের কৃচ্ছ সাধন নীতির অংশ হিসেবে আগামী জুন পর্যন্ত সব ধরনের যানবাহন ক্রয় স্থগিত করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে সব ধরনের সরকারি গাড়ি ক্রয় বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। প্রগতির বড় ক্রেতা হচ্ছে সরকার। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা প্রগতি থেকে গাড়ি ক্রয় করে। কিন্তু অর্থবিভাগের নির্দেশের ফলে প্রগতি আর গাড়ি বিক্রি করতে পারছে না। এই অবস্থায় প্রগতি গাড়ি সংযোজন এবং বাজারজাতকরণের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও কাজ করতে পারছে না। বাঙবন্দি গাড়ি নিয়ে প্রগতি কর্তৃপক্ষ দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে। এত কষ্টের ফসল আদৌ ঘরে তোলা যাবে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, মিৎসুবিশির সব ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা আমরা সফলভাবে পার হয়েছি। এখন ফসল ঘরে তোলার পালা। কিন্তু সরকারের নির্দেশনায় পরিবর্তন আনা না হলে এই সংকট থেকে প্রগতি নিস্তার পাবে না। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে জানানো হয়েছে বলেও প্রগতির শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানান।
প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ তৌহিদুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা বেশ ভালোভাবেই মিৎসুবিশির সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। এখন মিৎসুবিশির দুইটি মডেলের গাড়ি আমরা সংযোজন এবং বাজারজাতের অনুমোদন পেয়েছি। আমাদের কাছে তাদের প্রায় চারশ’ গাড়ি রয়েছে। এই গাড়িগুলো বিক্রি করতে না পারলে আমরা সংকটে পড়বো। বিষয়টি শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান। সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা অনেক কষ্টে একটি ফসল ঘরে তোলার অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি। এখন সরকারের বিশেষ বিবেচনা না পেলে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব এই প্রতিষ্ঠানটি চরম সংকটে পড়বে। তিনি বলেন, আমাদের গাড়ি বেসরকারি খাতে বিক্রির সুযোগ খুব একটা নেই। এগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানই ব্যবহার করবে। এখন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব যেসব প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কেনা জরুরি সেগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে কিছু গাড়ি কেনার অনুমোদন দেয়া হলে প্রগতি রক্ষা পাবে। প্রগতি গাড়ি বিক্রি করে যে টাকা পাবে তা সরকারের হাতেই থাকবে বলে মন্তব্য করে প্রগতির এমডি ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ তৌহিদুজ্জামান বলেন, আমরা এত কষ্ট করে যদি সফল হতে না পারি তাহলে আমার শ্রমিক কর্মচারীদের মাঝে হতাশা তৈরি হবে। আমাদের বড় বড় কিছু স্বপ্নও নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি প্রকৃত পরিস্থিতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর জানাতে মাননীয় শিল্পমন্ত্রীকে একটি পত্র লেখা হয়েছে বলেও দৈনিক আজাদীকে জানান। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সরকারের সুদৃষ্টি পেলেই প্রগতি দেশের মোটরযান সেক্টরে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতিন স্তরের নিরাপত্তা
পরবর্তী নিবন্ধকাফনের কাপড় পরে উখিয়ায় বেকারদের বিক্ষোভ