শ্রীলঙ্কার সংকট চরমে-সমাধানের পথ কোথায়?

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | সোমবার , ১৬ মে, ২০২২ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে লঙ্কা। ইতোমধ্যে লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে তুমুল গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। দেশব্যাপী কারফিউ চলছে। এমপিসহ বেশ কয়েকজনের নিহতের খবর পাওয়া গেছে। মাহিন্দা রাজাপাকসে তাঁর ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। রাজাপাকসের মুখপাত্র রোহান ওয়েলিউইটা বলেন, নতুন জোট সরকার গঠনের পথ তৈরি করতে তিনি পদত্যাগ করেছেন। রাজধানী কলম্বো ও দেশের অন্য গুরুত্বপূর্ণ শহরে সরকারপন্থী লোকজনদের সাথে সরকারবিরোধীদের সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। সরকারবিরোধী এ বিক্ষোভ দিন দিন আরো জোরালো হওয়ায় গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের শীর্ষ নেতাদের পদত্যাগের চাপ বাড়তে শুরু করে। গত এপ্রিল মাস থেকে দেশটিতে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মধ্যে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে এই পদত্যাগের ঘটনা ঘটলো। অর্থনৈতিক সংকটসহ নানাবিধ সংকটে জর্জরিত দেশটিতে অনেকদিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগের অনুরোধ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে।
স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ আর্থিক সংকটের মোকাবেলা করতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে। অর্থনৈতিক পরিচালনায় ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় বসে থাকা গোতাবায়া ও মাহিন্দা পরিবারকে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার দাবি জানাচ্ছিল ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্রটির সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা। এদিকে প্রেসিডেন্ট এর পদত্যাগ চেয়ে কারফিউ ভেঙ্গে বিক্ষোভ করছে সাধারণ মানুষ। তারা প্রেসিডেন্ট এর কার্যালয়ের বাইরে অবস্থান করছে। সহিংসতা দমনে সেনাবাহিনীর পর পুলিশকেও দেখামাত্র গুলি চালানোর ক্ষমতা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণর আগামী ০৩ দিনের মধ্যে (আজ ১৩ মে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) নতুন সরকার গঠন করা না হলে দেশের অর্থনীতি একেবারে ধসে পড়বে। রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যত্যয় ঘটলে তিনিও পদত্যাগ করবেন। অর্থনৈতিক চরম সংকটে পতিত দেশটির হাতে বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে ১ সপ্তাহের বেশি আমদানিপ্রক্রিয়া চালানো সম্ভব হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণর নন্দলাল বিরাসিংহে বলেছেন, এই অস্থিরতা কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ঋণ নিতে হবে। শ্রীলংকার প্রধান বিরোধী দল সমাজি জনা বালাভেগায়া দলটির নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা সম্প্রীতি বলেছেন, শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে বের করার লক্ষ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনে তাঁরা রাজি আছেন। তবে এর মধ্যে তারা ৪টি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। তারমধ্যে প্রথম শর্ত হল: দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হবে কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিজের গদি ঠেকাতে রনিল বিক্রমাসিংহেকে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছেন গোতাবায়ে রাজাপাকসে। এর আগে ৫ দফায় দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা বিক্রমাসিংহে তার দল থেকে শুধু তিনি নিজেই সংসদ সদস্য। ক্ষমতা থাকাকালে স্বজনপ্রীতি, দুর্র্নীতিসহ নানা ঘটনায় সমালোচিত বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধান বিরোধীদল এসজেবি। শুধুমাত্র তাই নয়-শ্রীলঙ্কার প্রভাবশালী বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতারাও তার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। যদিও কলম্বোর প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে গণবিক্ষোভ চলছে, এরপরও প্রেসিডেন্ট এর পদত্যাগের কোন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না অদ্যাবধি। তবে ব্যতিক্রম যে কোন কিছু ঘটতেই পারে।
ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র নতুন প্রধানমন্ত্রীর সরকারের সাথে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আর ভারত বলেছেন, শ্রীলঙ্কার জনগণের পাশে তারা থাকবে। ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতা নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে ক্ষমতায় বসিয়ে শ্রীলঙ্কার চলমান অর্থনৈতিক সংকট কতটুকু সমাধানের পথ দেখাবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রধান বিরোধীদল এসজেবি নেতা সাজিদ প্রেমাদাসা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে রাজি হওয়ার কথা জানিয়ে প্রেসিডেন্টকে চিঠি পাঠান। তবে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে তিনি কোন সিগন্যাল পাননি। পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে নিজ বাসভবন থেকে পালিয়ে ইতোমধ্যে একটি নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজাপাকসে সরকারের ডজন-ডজন মন্ত্রী-এমপি ও তাদের দলীয় নেতাদের গাড়ি বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। চরম বিক্ষোভের মধ্যেও দুর্নীতিবাজ বলে খ্যাত নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে কোনমতে মেনে নিবে না বলে প্রধান বিরোধীদলসহ সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার বিরুদ্ধে বিরোধীদের গুম করার জন্যে ডেথ স্কোয়াড গড়ার অভিযোগ রয়েছে। রাজাপাকসে পরিবার দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কা সরকারে অধিষ্ঠিত থাকায় দেশটির অর্থনীতিতে নজিরবিহীন ধস পড়েছে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান। স্বাধীন ভূমির দাবিতে দীর্ঘদিন লড়ে আসা তামিল গেরিলাদের পরাস্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখায় নিজ পরিবার থেকে তিনি টার্মিনেটর উপাধি পান। তিনি খুব দ্রুত মেজাজ হারান বলে প্রতিপক্ষ গোতাবায়াকে ভয় পান। শ্রীলঙ্কার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে গোতাবায়া। রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, করোনা মহামারির সময় নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলেছেন গোতাবায়া। ৭৩ বছর বয়সী বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে গোতাবায়া সংকটের আপাতত সমাধান চাইলেও তা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অনেকে। দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাঙ্গা জয়সুরিয়া বলেন, রনিলকে প্রধানমন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে- যারপ্রতি কোন জনসমর্থন নেই। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে বিক্রমাসিংহে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন বিক্রমাসিংহে। সেই সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন জুনিস জয়াবর্ধানে। ঐ সরকারের সর্বকনিষ্ট মন্ত্রী হন তিনি। তামিল গেরিলাদের হাতে সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা নিহত হওয়ার পর ১৯৯৩ সালে প্রথমবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হন বিক্রমাসিংহে। সেই বার এক বছরের কিছু সময়ের বেশি ক্ষমতায় ছিলেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। সেই সময় তাঁর বাল্যবন্ধু দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণর অরজুনা মাহেন্দ্রানের বিরুদ্ধে ১ কোটি ১০ লাখ ডলার অনিয়মের ঘটনা প্রকাশিত হয়।
সাবেক আইনজীবী বিক্রমাসিংহে ৫ দফায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী হলেও কোনবারেই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। এদিকে চলমান বিক্ষোভ সহিংসতার মধ্যে নিরাপত্তা শঙ্কায় কলম্বো ছাড়ছেন সাধারণ মানুষ। তারা রাজধানী ছেড়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন। সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেসহ তার ছেলে নামাল রাজাপাকসে ও ১৫ সহযোগীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন দেশটির আদালত। সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের উপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল তাদের উপর এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এখন সাধারণ মানুষ চাইছে, ২ দশক ধরে শ্রীলঙ্কার শাসন ক্ষমতা নিজেদের মুঠোয় রাখা রাজাপাকসে পরিবারের শাসনের অবসান । রাজপথে স্লোগান তোলা হচ্ছে ‘গোতা গো হোম’। মূলত ২০১৯ সালে সংঘটিত ইস্টার সানডেতে আত্নঘাতি হামলায় ২৫০ লোকের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা যে ধাক্কা খেয়েছিল তা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই করোনা মহামারি শুরু হয়েছিল। আর এতেই দেশটি আরেকটি ধাক্কা খায়।
করোনাজনিত কারণে পর্যটক আসা এবং পণ্য আমদানি-রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মহামারি কেটে গিয়ে যখন পরিস্থিতি একটু ভালোর দিকে যাচ্ছিল তখনই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। আর এর প্রভাব এসে পড়ে শ্রীলঙ্কায়- যাতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ওষুধের ঘাটতি ও নিত্যপণ্যের অনুপস্থিতি দেশটিতে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বজনপ্রীতির কারনে দেশটি এখন ৫,১০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণখেলাপী। এর পিছনে রয়েছে- রাজাপাকসে পরিবারের প্রশাসনের দুর্নীতি, অপশাসন, ট্যাক্স কমানো, অযৌক্তিক সরকারের ব্যয়, অস্বাভাবিক ব্যাংকনোট ছাপানো ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ক্ষমতাসীনদের স্বজনদের বসানো। এখন ভেঙ্গে পড়া প্রশাসন আইএমএফ এর দ্বারে দ্বারে ঘুরছে ঋণ পাওয়ার আশায়। তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, স্থিতিশীল সরকার না থাকলে তারা কোনভাবেই ঋণ দিতে পারবে না।
লেখক : সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিরাপদ নৌ-রুট চাই
পরবর্তী নিবন্ধশব্দ ও বায়ু দূষণ রোধে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি