শব্দ ও বায়ু দূষণ রোধে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি

রেজাউল করিম স্বপন | সোমবার , ১৬ মে, ২০২২ at ৫:০৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের রাস্তায় উচ্চঃস্বরে হর্ন বাজিয়ে গাড়ি চালানো একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মধ্যে দেখা যায়, উচ্চৈঃস্বরে সাইরেন বাজিয়েও অনেকে গাড়ি চালান। অথচ সাইরেন বাজিয়ে গাড়ি চালানো আইনত নিষিদ্ধ। এতে সাধারণ জনগনের বিশেষ করে শিশু বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষের চরম ক্ষতি হয়। সেজন্য রাস্তার বিভিন্ন জায়গা বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সামনে হর্ন না বাজানোর সংকেত দেওয়া থাকে। এইভাবে উচ্চৈঃস্বরে হর্ন বাজানো মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। উন্নত বিশ্বে পারতপক্ষে কেউ হর্ন বাজিয়ে গাড়ি চালায় না। কোনো গাড়ি হর্ন বাজিয়ে চললে বুঝা যায়, এর ড্রাইভার আনাড়ি ও অপরিপক্ক। কিন্তু আমাদের দেশে উচ্চঃস্বরে হর্ন বাজানোকে ক্রেডিট বলে মনে করা হয়। অথচ সরকার উচ্চঃস্বরের হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করেছে। শুধু গাড়ির হর্ন নয়, উচ্চঃস্বরে কথা বলা, বিকট শব্দে গান পরিবেশন করা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পার্বণে বিকট শব্দ বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে শব্দ দূষণের শীর্ষে নিয়ে গেছে। বর্তমানে বিশ্বে শব্দ দূষণের শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) শব্দদূষণ নিয়ে এক প্রতিবেদনে এই কথা বলা হয়েছে। ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ নয়েজ ব্লেজেস এন্ড মিসম্যাচেস শীর্ষক এই প্রতিবেদন ইউএনইপির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, বিশ্বের ৬১ টি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ হয় ঢাকায়। এই শহরে বেশির ভাগ সময় শব্দের মাত্রা থাকে সহনীয় মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। যা ঢাকার বাসিন্দাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি করে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় ঢাকায় শব্দের গড় তীব্রতা ১১৯ডেসিবল, যা বিশ্বের ৬১টি শহরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারতের মুরাদাবাদ যার তীব্রতা ১১৪ ডেসিবল। তৃতীয় পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ যার তীব্রতা ১০৫ ডেসিবল। বাংলাদেশের রাজশাহীর তীব্রতা ১০৩ ডেসিবল আর টাংগাইলে শব্দের তীব্রতা ৭৫ ডেসিবল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর ১৯৯৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল ও বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালে করা নির্দেশিকায় সড়কে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায়ও একই মাত্রাকে সহনীয় ও সর্বোচ্চ মাত্রা হিসাবে রাখা হয়েছে। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকা শহর এখন শব্দ দূষণের স্তর থেকে শব্দ বোমার স্তরে চলে গেছে। বোমার আঘাতে যেমন মানুষের ক্ষতি হয়, তেমনি শব্দ দূষণের ফলেও মানুষের মানসিক ও শারীরিক বৈকল্যের সৃষ্টি হয়। তারা বলেন বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণের নেতিবাচক প্রভাবে ঢাকা শহর ইতিমধ্যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
তবে দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। যেমন উম্মুক্ত স্থানে ইট ভাঙার যন্ত্র চালানো। উচ্চ শব্দ হয় এমন ভাবে ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করা থেকে শুরু করে টাইলস কাটার বিকট শব্দও নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনায় রয়েছে। এসব নির্দেশনা পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু প্রতিবছর শব্দ নিয়ন্ত্রণ দিবস পালন ছাড়া সংস্থাটির তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। এদিকে বাংলাদেশের স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় অধ্যয়ন কেন্দ্রের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ হয় গুলিস্তান ও পল্টন এলাকায়। এতে বলা হয়, রাজধানীতে ৩০% এর বেশি যানবাহনে নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করে। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকা শহরে উন্নয়নের নামে যা কিছু হচ্ছে, তা ক্রমাগত ভাবে আমাদের মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত করছে। একই সংগে শব্দ দূষণের ফলে একটি প্রজন্মকে অসুস্থ করে তুলছে। ইউএনইপির প্রতিবেদনে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশি শব্দ হয় এমন যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে কাজ করা ও সামাজিক বা বিনোদন মূলক অনুষ্ঠানে শব্দ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। শব্দের তীব্রতায় শরীরিক বিকলাঙ্গতা সম্পর্কে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন ঢাকাসহ বড় শহরগুলো থেকে যত রোগী আসে তার বেশিরভাগই শব্দ দূষণের কারণে কানে কম শোনা, ভো ভো শব্দ শোনা, উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার সমস্যায় ভোগে। তারা বলেন ঢাকার ১৭% মানুষ এখন শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার সমস্যায় ভুগছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে এ সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে মোট বাসিন্দার এক তৃতীয়াংশ। যা ঢাকার জন্য মহা বিপর্যয়কর।
অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশও বাংলাদেশ। ২০২০ সালের মত ২০২১ সালেও বাংলাদেশ এই অবস্থান ধরে রেখেছে। আর সবচেয়ে দূষিত বায়ুর রাজধানীর তালিকায় গতবারের মত এবারো ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। সুইজারল্যান্ডের দূষণরোধকারী প্রযুক্তি সেবাদান সংস্থা আইকিউএয়ারের ‘বিশ্ব বায়ুমাণ প্রতিবেদন ২০২১’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বিশ্বের ৬,৪৭৫টি শহরের বায়ুমান পর্যালোচনা করা হয়েছে। সংস্থাটির এবারের প্রতিবেদনে কিছুটা ভিন্নতা আনা হয়েছে। আগে অতি সুক্ষ বস্তুকণা পিএম ১০ ও পিএম ৫ এর উপস্থিতিকে আমলে নেওয়া হতো। এবার নেয়া হয়েছে আরো অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম ২.৫ কে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই বস্তুকণা নিঃশ্বাসের সাথে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে মারাত্মক ক্ষতি হয়। ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে মূলত ধুলা ও ধোঁয়াদূষণের কারণে এ ধরনের বস্তুকণার পরিমাণ বাড়ছে। এই দূষিত বায়ু দেশের মানুষের গড় আয়ু ১-৩ বছর পর্যন্ত কমিয়ে দিচ্ছে। এর সত্যতাও পাওয়া যায় স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায়। এতে দেখা যায়, রাজধানীর সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ু হচ্ছে শাহবাগ এলাকায়। আর সব চেয়ে কম হলো জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায়। ২০২১ সালের এপ্রিল হতে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এই গবেষণাটি করেছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। এতে অর্থায়ন করে ইউএসআইডি ও ইউএকেএআইডি। এতে বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্য কর বায়ুর মানমাত্রা হলো প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ১৫ মাইক্রোগ্রাম ধুলিকণা। আর ঢাকার বিভিন্ন স্পটে পাওয়া গেছে এর পাঁচগুণ (৭৪.৮১) বেশি ধুলিকণা যা খুবই বিপদজনক।
আইকিউএয়ারের তথ্য মতে অনেক দেশ বায়ুদূষণ কমানোর জন্য বড় উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের অবস্থা অতীতে খারাপ ছিল তবে তারা দিন দিন উন্নতি করছে। প্রতিবেদনে দেখা যায় সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পরে রয়েছে চাদ, পাকিস্তান, তাজাকিস্তান ও ভারত। আর সবচেয়ে দূষিত রাজধানী হলো দিল্লি, দ্বিতীয় ঢাকা। তারপর এনজামেন (চাদ), দুশানবে (তাজাকিস্তান), মাসকাট (ওমান)। ঢাকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকার বায়ু দূষণের ৫০% হলো তরল জ্বালানী পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরী হওয়া ধোঁয়া ও রাস্তাঘাটের ধুলা যা আমাদের সৃষ্টি। ৪০% দূষণের উৎস খড়, কাঠ ও তুষের মতো জৈব বস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা। আশংকার বিষয় হলো এইসব ক্ষতিকর ধোঁয়া ও বস্তুকণা দিন দিন বাড়ছে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, একটি রাস্তা সংস্কার করার পর পরই কোনো একটি সংস্থা ঐ রাস্তাটি কেটে কিছু একটা করে। এতে ঐ রাস্তা হতে ধুলিকণা বাতাসে মিশে মানুষের চরম ক্ষতি করে। অথচ সমন্বিতভাবে কাজটি করে কয়েক বছরের জন্য একেবারে সংস্কার করলে অর্থের সাশ্রয় যেমন হতো, পরিবেশও ভাল ও ইকো ফ্রেন্ডলি থাকতো। তাই জরুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া এই পরিস্থিতি হতে উত্তরণের আর কোনো পথ খোলা নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রীলঙ্কার সংকট চরমে-সমাধানের পথ কোথায়?
পরবর্তী নিবন্ধতেল নিয়ে তেলেসমাতি অসহায় বাণিজ্যমন্ত্রী!