তেল নিয়ে তেলেসমাতি অসহায় বাণিজ্যমন্ত্রী!

জসীম চৌধুরী সবুজ | সোমবার , ১৬ মে, ২০২২ at ৫:০৩ পূর্বাহ্ণ

সয়াবিন হচ্ছে দেশে রান্নার কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভোজ্যতেল। এই তেল নিয়ে তেলেসমাতি শুরু হয়েছে ঈদুল ফিতরের আগে এবং তা এখনো শেষ হয়নি। আসন্ন কোরবানির ঈদের আগে তেলের দাম নিয়ে স্বস্তির কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এরমধ্যে পেঁয়াজের বাজারেও অস্থিরতার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। দাম বাড়তে শুরু করেছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। দু’বছর আগে এই সময়ে পেঁয়াজের দাম প্রতিকেজি সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে নাজেহাল ভোক্তা সাধারণের পকেট থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছিল সিন্ডিকেট সদস্যরা। সয়াবিন নিয়ে সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে প্রশাসন। স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী নিজেও তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে তিনি ভুল করেছেন। তারা কেউ কথা রাখেননি। এক্ষেত্রে তিনি নিজের ব্যর্থতা স্বীকারও করেছেন।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে এবং পরে প্রায় ১৪/১৫ দিন সয়াবিন তেল বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি ঘোষণা এর পেছনে কাজ করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে আসছিলেন ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর। তাদের খুশী রাখতে ঈদের সপ্তাহখানেক আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় ৫ মে থেকে ভোজ্যতেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে। ব্যস্‌ তেল আর পায় কে? বাজার থেকে রাতারাতি উধাও হয়ে তেল চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডে। মিল মালিক, ডিলার (ডিও ব্যবসায়ী), পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী সবাই মিলে তেলকে দুষ্প্রাপ্য করে তুললেন। ঈদের একদিন পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু বাজারে সৃষ্ট কৃত্রিম সঙ্কটের কারণে লিটার প্রতি ২০০ টাকায় পৌঁছে যায় সয়াবিনের দাম। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করলে মাটির নিচে, সুড়ঙ্গে, গুদামে, পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে টনে টনে সয়াবিন তেল উদ্ধার করে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সংবাদ সম্মেলনে জানান, তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে মাত্র কয়েকদিনে ভোক্তাদের পকেট থেকে ১৬০ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। সব হিসাব করলে লোপাটের পরিমান এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলেও তিনি জানান। কোরবানির ঈদ পর্যন্ত সময়ে তেল ও পেঁয়াজ নিয়ে তেলেসমাতি কমবে এ রকম নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। সে হিসেবে কত হাজার কোটি টাকা লোপাট হবে তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা সহজ হবে না।
ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধের আগে এবং পরে সয়াবিনের যে আমদানি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এবং পাইপ লাইনে যা রয়েছে তাতে করে তেলের সঙ্কটের কোনো কারণ দেখা যায় না। দেশে একমাসে যে পরিমান তেলের চাহিদা রয়েছে পরিসংখ্যান বলছে তেলের মজুদ রয়েছে তার দ্বিগুণেরও বেশি। তাহলে সঙ্কটটা যে কৃত্রিম এটা সহজেই অনুমেয়। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ঈদের পরে মূল্য সমন্বয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আগাম ঘোষণা দেওয়াটা ছিল হটকারি সিদ্ধান্ত। দাম বাড়বে জেনেও মজুদ সব মাল বাজারে ছেড়ে দেবে এমন ব্যবসায়ী খুঁজে পাবেন কোথায়? পূঁজির ধর্মই হচ্ছে কিভাবে তার বিকাশ ঘটানো যায় তার চেষ্টা করা। লাভ ঘরে তুলে নিতেই ব্যবসায়ী প্রাণান্ত চেষ্টা চালান। এখানে পাপ-পুণ্য, নীতি- নৈতিকতার বিষয় কাজ করে না। দ্বিগুণ- তিনগুণ লাভ ঘরে তুলতে পারলেই তারা মহাকশি। এজন্যে যেখানে যেভাবে গুটি চালতে হয় তারা চালান। সয়াবিন নিয়েও চালিয়েছেন। সুযোগটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় করে দিয়েছে দাম বাড়ানোর আগাম ঘোষণা দিয়ে। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে একজন ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখেন- এ রকম আলোচনা সংবাদ মাধ্যমে দেখে তিনি এর আগে তার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছিলেন, উকিল, ডাক্তার বা অন্য কেউ যখন মন্ত্রী হন তখন এত সমালোচনা হয় না। ব্যবসায়ী হলে কেন এত দোষ?
সয়াবিনের সঙ্কট নিয়ে মিল মালিক, ডিলার, খুচরা বিক্রেতা একে অপরকে দূষলেও কেলেঙ্কারির আসল হোতারা বরাবরের মত এবারও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। সংবাদ মাধ্যমে গত কয়েকদিন আলোচিত বিষয় সয়াবিন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ঈদের আগে সারাদেশের ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা মিল থেকে তেল তুলে যে যার মতো লুকিয়ে ফেলে। এতে বাজারে তেলের সঙ্কট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলেছেন, ঈদের আগে ও পরে ১৫ দিন মিল মালিকরা তেলের কোনো ডিও(ডেলিভারি অর্ডার) ইস্যু করেনি। এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন তেলের সঙ্কট সৃষ্টির জন্যে যে কারণটির কথা বলেছেন সেটিও আলোচনার দাবি রাখে। তিনি বলেছেন, টিসিবি ঈদের আগে বাজার থেকে এক কোটি লিটার তেল কিনে নেয় কার্ডধারীদের কাছে সুলভমূল্যে বিক্রি করবেন বলে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দূরদর্শীতার অভাব এবং বাজার মনিটরিংয়ে ঘাটতির বিষয়টি সামনে চলে আসে। দেশে ভোজ্যতেলের যে স্বাভাবিক চাহিদা তা বেড়ে যায় রমজান এবং কোরবানির সময়ে। সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবির মাধ্যমে সরাসরি পরিশোধিত তেল আমাদানি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আগাম প্রস্তুতির কথাটি মাথায় রাখেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর এখন টিসিবি সরাসরি তেল আমদানি করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। মাসখানেক আগে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে আমদানি শুল্ক কমিয়ে নামমাত্র করলেও তার কোনো সুফল ভোক্তারা পাননি। মিল মালিকদের একাউন্ট স্ফিত হয়েছে মাত্র।
সামনে আসছে কোরবানির ঈদ। তার আগেই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া বন্ধ করেছে সরকার। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, কৃষকরা যাতে উৎপাদিত পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য পান সেজন্যেই এ ব্যবস্থা। এটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। ঢালাও আমদানির সুযোগে আমাদের কৃষকরা সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হন। লবণের যখন বাম্পার উৎপাদন হয় তখন বিদেশ থেকে আমদানির অনুমতি দিয়ে লবণ চাষীদের সর্বনাশ করা হয়। সেদিক দিয়ে সরকারের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে এই পদক্ষেপকে পূঁজি করে যেন সিন্ডিকেট বাজার অস্থিতিশীল করে ভোক্তাদের পকেট কাটতে না পারে সেজন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিতে হবে।
পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি বন্ধের সিদ্ধান্তের পরদিন থেকেই পেঁয়াজের দামও কেজিতে ১৫/২০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
কোরবানির আগে পেঁয়াজ নিয়েও আরেকটা কেলেঙ্কারির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সঙ্কট শুরু হলে দৌঁড়ঝাপ শুরু না করে এখনই আগাম প্রস্তুতি না নিলে বাণিজ্যমন্ত্রীকে হয়তো আবারো বলতে হতে পারে – ব্যবসায়ীরা এবারও বিশ্বাস ভঙ্গ করলেন।
ক’বছর আগেও কোরবানির পশু নিয়ে আমাদের সঙ্কট পোহাতে হত। ভারত থেকে গবাদি পশু আমদানি বা চোরাচালান হয়ে না আসলে আমাদের বাজারের চাহিদা মিটত না। দাম থাকত অনেক চড়া। গত কয়েক বছরে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ দেশে গবাদি পশুর উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে। দেশের চাহিদা দেশের পশু দিয়েই এখন আমরা মিটাতে পারছি। পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়িয়ে আমরা এক্ষেত্রেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি। কৃষকরা যেন তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান সেটিও পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে।
ভোজ্যতেলের চাহিদার সিংহভাগই আমদানি নির্ভর। দেশে মাত্র ছয়টি শিল্পগ্রুপের হাতে ভোজ্যতেলের বাজার। তারাই আমদানি করে নিজস্ব মিলে পরিশোধন করে ডিলারদের মাধ্যমে বাজারে ছাড়ে। মনোপলি হওয়ায় বাজার ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব এবং তা-ই হচ্ছে। এদের কাছে সরকার অসহায়, আর জনগণ জিম্মি। এই জিম্মি অবস্থা থেকে বাজারকে মুক্ত করতে টিসিবিকে আরও শক্তিশালী করে বিকল্প সাপ্লাই চেইন চালু করার মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখার বিষয়টি এখনই বিবেচনার দাবি রাখে।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশব্দ ও বায়ু দূষণ রোধে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধসুবিধাবাদী চক্র পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে