শ্রমবাজারে নারীর অবদান: ক্লডিয়া গোল্ডিনের গবেষণা

উম্মে সালমা | শনিবার , ১৩ জানুয়ারি, ২০২৪ at ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ

ইতোমধ্যেই আমারা জেনেছি যে ২০২৩ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লডিয়া গোল্ডিন যিনি নারী শ্রমবাজারের প্রভাব বিষয়ে মানুষের বোঝাপড়া বা জ্ঞানের উন্নয়ন সাধনের জন্য কাজ করছেন এবং তারই স্বীকৃতি স্বরূপ এই পুরস্কার লাভ করেছেন। বিশ্বের কাছে তিনিই প্রথম যিনি নারীদের শ্রম বিনিময়সূত্রে উপার্জন এবং চলমান শতাব্দীতে শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের ফলাফল বা প্রভাব বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা হাজির করেছেন এবং বিশ্বের তৃতীয়তম নারী হিসেবে তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন। ইতোপূর্বে যে দ’ুজন নারী অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন তারা হলেন ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এলিনর অস্ট্রম এবং ২০১৯ সলে ফ্রান্সের এসথার দুফ্লো।

ক্লডিয়া গোল্ডিনের জন্ম ১৯৪৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৭২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শ্রম অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পিএইচডি অধ্যয়নশেষ করে ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনম্যাডিসনএ শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৯০ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন কয়েক বছর। তিনি জাতীয় অর্থনৈতিক গবেষণা কার্যালয়ের অর্থনীতিতে লিঙ্গ বিষয়ক গবেষণা দলের সহপরিচালক। তিনি প্রায় তিন দশক ধরে আমেরিকান ইকোনমি প্রোগ্রাম ডেভেলপম্যান্টের পরিচালক ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন, যাদের মধ্যে নারী শ্রমশক্তি, আয়ে লিঙ্গগত বৈষম্য, আয় বৈষম্য, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, শিক্ষা ও অভিবাসনের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত। তার বেশিরভাগ গবেষণাকর্মে অতীতলব্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমানকে অবলোকন ও ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে এবং বর্তমান সময়ের উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর উৎস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হয়।

শ্রমবাজারে নারীর অবদান নিয়ে তার গবেষণায় নতুন দিকনির্দেশনা, পরিবর্তনের চিত্র ও বিদ্যমান লিঙ্গ পার্থক্যের মূল উৎস বা কারণগুলো উঠে এসেছে। বৈশ্বিক শ্রমবাজারে নারীদের অবদানের তথ্য এখনও সেভাবে উঠে আসে না। কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে মজুরিও কম পান তারা। ক্লডিয়া গোল্ডিন এবিষয়ে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণা করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে লিঙ্গ পার্থক্য কীভাবে আয় ও কাজের ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে। এর কারণও তুলে ধরেছেন তিনি। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে নারীরা পুরুষদের চেয়ে আয়ও করে কম। বিষয়টি নিয়ে গোল্ডিন যুক্তরাষ্ট্রের গত দুইশ বছরের তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান চালিয়েছেন। আর্কাইভগুলো তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে দেখেছেন। এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন উপার্জনের ক্ষেত্রে সময়ের পরিক্রমায় কীভাবে ও কেন লিঙ্গ বৈষম্য ও পার্থক্য গড়ে উঠেছে নারীপুরুষের মধ্যে। নারীপুরুষের কর্মসংস্থানের হারও কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে সেটিই খুঁজে দেখেছেন এই অধ্যাপক।

গোল্ডিন দেখিয়েছেন যে, শতাব্দী ধরে শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী ছিল না। বরং এটি ছিল উল্টো প্রকৃতির। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্পভিত্তিক সমাজে রূপান্তরের সময় কর্মক্ষেত্রে বিবাহিত নারীদের অংশগ্রহণ হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু তারপর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সেবা খাতের বৃদ্ধির সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। গোল্ডিন এই ধরণকে কাঠামোগত পরিবর্তন এবং ঘর ও পরিবারে নারীর দায়িত্ব সম্পর্কিত সামাজিক রীতির বিকাশের ফলাফল হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বিংশ শতাব্দীতে নারীদের শিক্ষার হার ক্রমাগত বেড়েছে এবং উচ্চ আয়ের বেশিরভাগ দেশে এখন পুরুষদের তুলনায় নারী শিক্ষার হার বেশি। এই ক্ষেত্রে গোল্ডিন দেখিয়েছেন, ক্যারিয়ার গড়ার জন্য নারীদের গর্ভনিরোধক পিল তাদের নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বৈপ্লবিক পরিবর্তনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ক্লডিয়া গোল্ডিনের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মূল বিষয় হচ্ছে, আগেকার সময়ে এবং এখনও নারীর সিদ্ধান্ত মূলত তার বিয়ে ও পরিবারের প্রতি দায়িত্বকর্তব্য পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করলেও তার অন্তর্দৃষ্টি কালসীমানার গণ্ডি পেরিয়ে যায়। স্বভাবতই এই গবেষণার জন্য তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করার কাজটি ছিল অনেক চ্যালেঞ্জিং। কারণ এক সময় সরকারি পরিসংখ্যানে শুধু পুরুষদের কাজের তথ্যউপাত্ত থাকত, নারীদের থাকত না। ফলে আর্কাইভে তাকে রীতিমতো ‘তথ্য গোয়েন্দা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। অনেক পরিশ্রম করে আর্কাইভের বিপুল তথ্যভাণ্ডার ঘেঁটে তাকে নারীর ভূমিকা বের করতে হয়েছে।

গোল্ডিন দেখিয়েছেন, গর্ভনিরোধক পিলের ব্যবহার নারীদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনার জন্য নতুন সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটা নারীকে ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনা করার সুযোগ দিয়েছে, স্বাধীনতা দিয়েছে। তবে এত পরিবর্তন সত্ত্বেও কিছু পুরোনো বিষয় এখনও রয়ে গেছে এরকমটাই বলছেন এই অর্থনীতিবিদ। তার মতে, দীর্ঘদিন ধরে নারীপুরুষের আয়ের ব্যবধান তেমন একটা কমছে না অর্থাৎ ব্যবধানটা একই রকম আছে। তিনি মনে করেন, আয়ের বৈষম্যের আংশিক কারণ হচ্ছে, শিক্ষাবিষয়ক সিদ্ধান্ত সাধারণত কম বয়সে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, যদি যুবতী নারীদের প্রত্যাশাগুলো পূর্ববর্তী প্রজন্মের, যেমন সেইসব মায়েরা যাদের শিশুরা বড় না হওয়া পর্যন্ত কাজে ফিরে যাননি, যারা অভিজ্ঞতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, ফলে তাদের বিকাশ আরও ধীর গতির হয়।

ক্লডিয়া’র মতে শ্রমবাজারে বিশ্বব্যাপী নারীদের ব্যাপকভাবে উপেক্ষা করা হয়। আয়ের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীরা কম উপার্জন করেন। তিনি এবিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান করে দেখিয়েছেন, কেন ও কীভাবে সময়ের সাথে সাথে আয় ও কর্মসংস্থানে নারীপুরুষের মধ্যকার পার্থক্যের পরিবর্তন ঘটে। আয়ের ক্ষেত্রে লিঙ্গপার্থক্যের সঙ্গে শিক্ষা ও পেশাগত পছন্দের সম্পর্ক রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, উপার্জনের ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্যের বেশির ভাগই শিক্ষা এবং পেশাগত পছন্দের পার্থক্য দ্বারা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। গোল্ডিন দেখিয়েছেন যে, এই উপার্জনের পার্থক্যের বেশিরভাগই এখন একই পেশায় হয় এবং নারীদের মধ্যে যা মূলত প্রথম সন্তানের জন্মের সময় স্পষ্ট হয়।

কাজেই এই আলোচনা ও তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে আমরা আশা করতে পারি যে অধ্যাপক ক্লডিয়া গোল্ডিনের উক্ত গবেষণা শ্রমআইন, মজুরিনীতি, মাতৃত্বকালীন সুযোগসুবিধা প্রণয়নসহ শিক্ষা নীতিকে প্রভাবিত করবে। অর্থনীতির প্রয়োজনীয় নীতিনির্ধারণে তার কাজের উল্লেখযোগ্য প্র্রভাব বিবেচনায় রেখেই তাই নোবেল কমিটি তাকে এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅধ্যাপক লায়লা জামান
পরবর্তী নিবন্ধটেক্সির সাথে বাইকের ধাক্কা, আহত ৪