অধ্যাপক লায়লা জামান

স্মরণ

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১৩ জানুয়ারি, ২০২৪ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

মানিকজোড়’ বলতে যা বোঝায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণালী সময়ে তাঁরা দু’জন ছিলেন ঠিক তাই। একজন ব্যক্তির স্মরণে রচিত নিবন্ধের শুরুতে ‘তাঁরা’ দেখে বিভ্রান্ত হতে পারেন পাঠক। কিন্তু তাঁদের দু’জনকে দু’টি আলাদা সত্তায় ভাগ করা যায় না, ভাগ করা যায়নি। তাইতো একজন চোখ বোজার পর পরই অন্যজন নিস্তেজ হয়ে পড়তে শুরু করেন। অল্পদিনের মাথায় হাসপাতাল, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ঘুরে, ছেলেদের অনাথ করে দিয়ে পাড়ি দেন নিজ গন্তব্যে, প্রিয়তমের কাছে। বলছিলাম ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩এ প্রয়াত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ড. আমাতুল লায়লা জামানের (জন্ম ১৯৫৪) কথা। তাঁর চার দশকের জীবনসঙ্গী ছিলেন অধ্যাপক ড. ভুঁইয়া ইকবাল (১৯৪৭২০২১)। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে, গ্রন্থাগারে, শিক্ষক মিলনায়তনে, পরিবহনেতাঁদেরকে জোড় বেঁধে চলতে দেখা যেত। একজনকে দেখলেই বোঝা যেত আরেকজন আশেপাশেই আছেন। এই পারস্পরিক নির্ভরতা তাঁদেরকে নিষ্ক্রিয় করেনি, বরং কর্মতৎপর করেছে, শক্তি যুগিয়েছে। এরই নাম হয়তো অমর প্রেম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী লায়লা জামান, ভুঁইয়া ইকবালকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সরাসরি তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের (১৯৩৭২০২০) সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর পরিবারের। ভুঁইয়া ইকবালও ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রিয়ভাজন, স্নেহধন্য। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উদ্যোগে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয় ১৯৭৭ সালের ২ নভেম্বর। অভিজাত পরিবারের কন্যা লায়লা জামান তখন এম. . পরীক্ষা শেষ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষকের দীনহীন ঘরে মলিন শয্যা, আলমারি ভরা বই, আর পরিপাটি করে গোছানো একজোড়া পড়ার টেবিলচেয়ার নিয়ে যুগল জীবনের যাত্রা শুরু তাঁদের। টুক টুক করে ফুলে ফলে ভরে উঠে তাঁদের সংসার, ইংরেজির অধ্যাপক হারুনর রশিদ তাঁদের ঘরের নাম দিয়েছিলেন ‘টুকুর আবাস’। অধ্যাপক লায়লা জামানকে কাছের মানুষরা ‘টুকু’ নামে চিনতেন। স্মৃতিকথায় তাঁদের ঘর বাঁধার দিনগুলোর যে ছবি তিনি এঁকেছেন, একালে তা রূপকথা বলে মনে হতে পারে– “বাড়িটা সুন্দর, বারান্দায় দাঁড়ালে দুপুরের আলোছায়ায় দূরে রাঙ্গামাটির পাহাড়গুলো আবছা দেখা যেত”। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে যে একটা আত্মীয়তার বন্ধন ছিল, তাও জানা যায় তাঁর রচনা ‘ফিরে দেখা’ হতে। তাঁদের ভালোবাসা আর আনন্দ ছিল তাঁদের লেখাপড়াকে ঘিরে। গবেষণা আর গবেষণার প্রয়োজনে ভ্রমণতো ছিলই, সেই সঙ্গে পারিবারিক মিলনমেলা আর বন্ধু পরিজন নিয়ে অকৃত্রিম সময় কাটানো ছিল তাঁদের নৈমিত্তিক জীবনের অংশ। ২০২২ সালের মার্চে প্রকাশিত ‘ভুঁইয়া ইকবাল স্মারকগ্রন্থের’ প্রায় সকল লেখকই লায়লা জামানভুঁইয়া ইকবাল পরিবারের সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটানো এবং একই সঙ্গে তাঁদের আতিথেয়তার কথা উল্লেখ করেছেন।

দূরের পাহাড় দেখার পথতো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এযুগের অধিবাসীগণও সেকালের মতো ক্লান্তিবিহীন আড্ডায় মাতি না। নির্দয় এক প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক বিভাজন আর তথ্যপ্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমণ আমাদেরকে নির্ভেজাল মিলনমেলা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমরা এগিয়ে চলেছি হৃদয়হীন এক সমাজ ও পৃথিবী নির্মাণের পাশবিক সংকল্প নিয়ে। একালের বলা যায়, ছেলেবুড়ো সকলেই তথ্যপ্রযুক্তির নেশায় বুঁদ হয়ে স্থানকাল ভুলে অন্যজগতে চলে যায়। কিন্তু লায়লা জামান, ভুঁইয়া ইকবাল দুজনেই তথ্যপ্রযুক্তির স্পর্শ বাঁচিয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। সন্তানদের কম্পিউটার প্রকৌশলী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও তাঁরা দুজন জীবন ও সময়টাকে অযান্ত্রিক মায়ায় ভরিয়ে রেখেছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি গ্রন্থাগারিক ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সহধর্মিণী সিদ্দিকা জামান তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “ভুঁইয়া ইকবাল ও লায়লা জামান দুজনে দুজনের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল ছিল। সব ধরনের কাজে, তা লেখালেখি হোক বা সংসারের কাজ হোক, সবসময় পরস্পরকে সাহায্য করত। এরকম জুটি সহজে দেখা যায় না”।

ফিরে যাই গেল শতকের সত্তর থেকে আশির দশকের সেই প্রাণবন্ত দিনগুলোতে। ‘টুকুর আবাস’ পরিপূর্ণতা লাভ করে নতুন শিশুর আগমনে। বন্ধু পরিজনের পরামর্শে দুধের শিশুকে মায়ের কাছে রেখেই দুজনে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভারত গমন করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন।

ভুঁইয়া ইকবাল পিএইচডি লাভ করেন ‘বাংলাদেশের উপন্যাসে সমাজচিত্র’ শিরোনামে। আর লায়লা জামানের গবেষণার শিরোনাম: ‘সওগাত পত্রিকার সাহিত্যিক অবদান ও সামাজিক ভূমিকা (১৯১৮১৯৫০)’। তাঁদের দু’জনের অভিসন্দর্ভই প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমি থেকে। দেশে ফিরে আসার পর লায়লা জামান প্রভাষক পদে যোগ দেন (১০ অক্টোবর, ১৯৮৭) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ১৯৯১ সালে সহকারী অধ্যাপক, ১৯৯৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক, এবং ২০১১ সালে অধ্যাপক পদে পদন্নোতি লাভ করেন। ড. লায়লা জামান ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ও রোকেয়া চেয়ার (২০২০) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০২০ সালে। পাঠদান, গবেষণার পাশাপাশি সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন লায়লা জামান। ব্যক্তিগত আলাপচারিতা থেকে খেলাধুলোর সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) মনোনীত রোকেয়া চেয়ার হিসেবে তাঁর পথচলাটা ছিল একা যুদ্ধের মতো। অতিমারির ছোবলে জীবনসঙ্গী পরলোকে চলে যাবার পর ঢাকার আবাস হতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রবন্ধ পাঠ করাটা তাঁর জন্য ছিল ক্লান্তিকর, একই সঙ্গে মর্মান্তিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন, গ্রন্থাগার, শিক্ষক মিলনায়তন, পরিবহনসবকিছুই তাঁর শূন্যতাকে চোখে ধরিয়ে দেয়, মন ভার করে দেয়। বড় একা আর অসহায় বোধ করেন তিনি। মনে পড়ে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের তারকা শিক্ষক দম্পতি হিসেবে যখন তাঁরা ছিলেন সকলের মধ্যমণি, কত আয়োজন করেছেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রোকেয়াসহ আরও কত মনিষীকে নিয়ে! বিভাগে বিভাগে চিঠি পাঠানো ছাড়া নিজেরাও ব্যক্তিগতভাবে বলতেন সহকর্মীদেরকে, এমনকি আনকোরা একজন প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপককেও। বড় প্রাণবন্ত ছিল তাঁদের সেই কর্মমুখর দিনগুলো !

রোকেয়া চেয়ার হিসেবে পাঁচটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক লায়লা জামান। রোকেয়ার সমাজভাবনা ও সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় লিখিত প্রবন্ধের বাইরেও রোকেয়া সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য উপস্থাপন করেন তিনি। সমাজের অন্ধকার দূর করার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করতে গিয়ে রোকেয়া তথাকথিত অভিজাতদের এতোটাই বিরাগভাজন হয়েছিলেন যে মৃত্যুর পর তাঁকে সমাহিত করা হয় অনেকটা গোপনে। তাঁর সমাধিও অনেককাল ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে অযত্নে পড়েছিল। মিলনায়তনে সুধী দর্শকের খরা দেখে মনে হল শতবছরে আমরা আসলে কতটুকুইবা এগিয়েছি?

পরবর্তী আলোচনা সভাগুলোতে লায়লা জামান নজরুলের ধূমকেতু পত্রিকায় আত্মসচেতন নারী, বাংলা গদ্যের ইতিহাসে উপেক্ষিতা, প্রথম বাংলা আত্মজীবনী (রাসসুন্দরী দাসী ১৮০৯১৯০০) এই বিষয়গুলোর ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

মাঘের মেঘাচ্ছন্ন সকালে তাঁর সেই প্রবন্ধ পাঠের স্মৃতি ভোলার নয়। ব্যথা বেদনার উপসর্গ তাঁর অনেক কালের। হাত ধরে দোতলায় বাংলা বিভাগে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাই নিজের কাজে। একটু পর মুঠোফোনে জানান, শহরে যাওয়ার পথে আমি তাঁর সফরসঙ্গী হতে চাই কি না। লুফে নিই এই অভাবনীয় প্রস্তাব। হাতের কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখেই তাঁর সঙ্গে যাত্রা করি। ত্রিশ মিনিটের মাথায় আমাকে আমার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে শহরস্থ ভাইয়ের বাড়ির পথ ধরেন তিনি। এই ত্রিশ মিনিট সময়টা আমার কাছে এক শিক্ষা সফরের মতো মন হল। প্রাণের মানুষের কথাই বলে গেছেন পুরোটা সময়। তাঁর কাজের কথা, ছেলেদের কথা, নাত্নিকে বাংলা পড়ানোর কথাও বলছিলেন

কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে যায়! এক পর্যায়ে অকপটে বলে ফেলেন– ‘তোমার চাচাকে ছাড়া আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার সবকিছু ওই গুছিয়ে দিত। প্রতিটা লেখার আগে ওর সাথে আলাপ হত, কীভাবে কি করবআলোচনা হত। এখন বড় একা লাগে। কাজ করতে পারি না’। মনে হল ওপারে যাওয়ার জন্য তৈরি তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গানটা মনে পড়ে গেল

আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো

সে ছুঁয়ে গেল নুয়ে গেল রে, ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত ……

সে চলে গেল বলে গেল না, সে কোথায় গেল ফিরে এলোনা

সে ঢেউ এর মতো ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে

যেখান দিয়ে হেসে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে রে

মনে হল আঁখির কোণে আমায় যেন ডেকে গেছে সে

আমি কোথায় যাব, কোথায় যাব

ভাবতেছি তাই একলা বসে

কবিগুরু বুঝিবা তাঁর জন্যই গানটি বেঁধেছিলেন। শরীর মন দুইই ভেঙে পড়ে তাঁর। স্বপ্নে এসে দেখা দেন প্রাণের মানুষ, হাত বাড়িয়ে ডেকে যান প্রেয়সীকে। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে। তিনি যাত্রা করেন পরপারে– ‘কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই’।

. সালমা বিনতে শফিক, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধছোট্ট একটি সেতু বদলে দিয়েছে লাখো মানুষের জীবন
পরবর্তী নিবন্ধশ্রমবাজারে নারীর অবদান: ক্লডিয়া গোল্ডিনের গবেষণা