উপমহাদেশে শিল্পায়নের পথিকৃত ব্যক্তিত্ব মরহুম এ. কে. খানের জ্যেষ্ঠপুত্র– তাঁর প্রথম পরিচয়। কিন্তু পরবর্তীতে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে তিনি নিজেও প্রতীক ও প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি পেয়েছিলেন। সরকারের শিল্প, পরিকল্পনা মন্ত্রী হয়েছিলেন।
কেবল শিল্পপতি নয়, শিল্পী হিসেবে তার উঁচু মাপের একটি পরিচয় আম–জনতা জানেন না। পঞ্চাশ দশকের কবি এ.এ.এম. জহির উদ্দিন খানকে কেউ চেনে? তিনি কবিতা লিখেছেন। কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। তাঁর চিন্তা ও চেতনায় আধুনিক বোদ্ধা ও চিন্তক মানবের পরিচয় পাওয়া যায়। এ দেশের সৃজনশীল শিল্পী ও কবিদের সঙ্গে তারুণ্যে তার একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই কর্মযোগী মননশীল ব্যক্তিত্বের বহুমাত্রিক অভিমত পড়লে অভিভূত হতে হয়। প্রবাদ আছে জহির উদ্দিন খান দু’টো ভাষা জানেন, চাটগাঁইয়া, আর ইংরেজি। আমাদের জাতিস্মর প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের মতো।
আঞ্চলিকতায় না আন্তরিকতায় চাটগাঁইয়া বলতেন, বক্তৃতা করতেন। আধুনিক ও চমৎকার তাঁর ইংরেজি বক্তৃতাগুলো ধারণ করে প্রকাশ করা হলে, একজন আন্তর্জাতিক মানের বুদ্ধিজীবীর পরিচয় পাওয়া যেত।
১৯৯৭ সালে প্রকাশিত কমলেশ দাশগুপ্ত ও ইউসুফ মুহম্মদ সম্পাদিত ‘সুচরিত চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ’–এ প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তাঁর মননের ব্যাপ্তি ও গভীরতা, ক্ষুরধার অন্তর্দৃষ্টি এবং উপলব্ধির স্বাতন্ত্র্যে পরিস্ফুট।
একটি গাছ, ছায়া নেই
১৯৬১ সালের এপ্রিলে জহির উদ্দিন খানের প্রথম ও একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘একটি গাছ, ছায়া নেই’ প্রকাশিত হয়েছিলো ‘কঞ্চি’ ছদ্মনামে। ঢাকার ইডেন প্রেস থেকে মুদ্রিত এই বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন কবি নিজেই। প্রকাশনায়: জলসীমা। এই প্রকাশনী থেকে জাহির উদ্দিন খানের চমৎকার প্রচ্ছদে বেরিয়েছিলো সুচরিত চৌধুরীর আলোড়িত গল্পগ্রন্থ ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি’।
এ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ পত্র এরকম– ‘পাথর বালি ছায়া গাছ পাতাকে।’ সাড়ে ৪ ফর্মার এই হ্যান্ডসাম কাব্যে ৬৮টি ছোট পরিসরের কবিতা সন্নিবেশিত।
অত্যন্ত আর্দ্রস্বরে তিনি কথা বলেন– অনুচ্চ স্বরে। প্রকৃতির সঙ্গে সত্তার সম্পর্ক– ভালোবাসা ও অনুভূতির অন্বেষণ তার মানস ভাবনার অনুবর্তী।
শব্দ চয়নের মধ্যেও নিতান্ত আটপৌরে–ঘরোয়া ও সাদামাটা শব্দগুলো আশ্চর্য ব্যঞ্জনা পেয়ে যায় তার সংবেদী স্বরের মাধুর্যে ও মোহমায়ায়।
একাকীত্বের আবহে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তাই চাঁদ ও রাত যেনো দেখা দেয় অন্য অভিধায়। এজন্যই তাঁর মন্ত্র উচ্চারণ– ‘আমরা সব একা একা।’
হারিয়ে যাওয়ার কেউ বা কিছু এই যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠে তার রাত এবং হাওয়াগুলো তাই ধারণ করে নিরেট কালো রঙ। এই বিমূর্ত চিত্রকল্প রচনা নিশ্চয়ই তাঁর কবি সত্তা ও ক্ষমতার স্মারক।
তাঁর শব্দকোষের দিকে চোখ ফেরানো যাক। এখানে রয়েছে– সাববকবালি, শামুক, ঝিনুক, সাগর, কান্না, প্রজাপতি, পাথর, আকাশ, পাহাড়, রামধনু নীল–ইত্যাকার মোলায়েম, পরিচিত, নরম ও সাধারণ শব্দরাজি।
অপূর্ব ছায়াচ্ছন্ন কণ্ঠে জহির উদ্দিন খান নির্মাণ করেন তার পঙ্ক্তি। এখানে নৈঃসঙ্গ এসে থমকে দাঁড়ায়। আসে বিচ্ছেদ হারানোর আর্তি। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার সৌন্দর্য চেতনা ঝলসে উঠে এই প্রকৃতি মগ্নতায়। সংশয় ও অনিশ্চয়তার হাহাকারও পাথরের বোবা কান্নার ভেতরে মূর্ত হয়ে ওঠে।
তিনি ল্যান্ডস্কেপ রচনা করেন পাহাড় ও সমতলের।
জহির উদ্দিন খানের রচনার আর একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য– বিশ্ববোধ। বাংলার নিসর্গমুগ্ধ এই কবি মোমার্ত–এর প্রেমেও আচ্ছন্ন। জমজমাট রাতের ক্যাফে, অ্যাকর্ডিয়ান বা স্যাক্রিকার করুণ সুর, পীগালের ন্যুড বা পুত্রেকের শিল্পকর্ম এসে প্রাণ প্রায় তার কবিতায়।
বিষয়–আশয় হিসেবে তিনি নির্বাচন করেন জাপান ও হংকং–এর প্রেক্ষাপটও। এই বিশ্ববীক্ষা তার রচনার বলা যায় এক দুর্লভ প্রাণ–সম্পদ।
জহির উদ্দিন খানের কবিতার আঙ্গিক ও কৃৎকৌশল আশ্চর্য সরল। এই সিম্পলিসিটির কারণে তার কাব্যদর্শন আরোপিত বলে বিচার করার কোনো অবকাশ নেই। তা যেনো মজ্জাগত, স্বতঃ ও স্বাভাবিক, আধুনিক ও চিরকালীন।
‘একটি গাছ, একটি ছায়া নেই’ কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত কবিতা উদ্ধৃত করা হলো–
আসছি আমি
শব্দের পাথর
ভাঙ্গা পথ
স্তব্ধ ছায়া
দূরের আলো
ভাসছে আকাশ নিয়ে।
একা
পথ হারানো
আসছি আমি পাথর নিয়ে।।
মোমার্ত
মোমার্ত জাগে রাতে কতো রঙের নিয়ন নিয়ে
রাস্তায় ক্যাফেগুলি রঙবেরঙের পর্দার ছায়ায়
ভরা লোকজনে,
দূর হোতে শোনা যায় বাজনা অ্যাকর্ডিয়ানের
রাত আলোর সজ্জায় আছে জাল হয়ে
লোক খুঁজছে রহস্যকে
শোনা যায় কখনো স্যাক্রিকার করুণ ঘণ্টাসুর
পীগালের ন্যুডপি জ্বলে আর নেভে
মলান রোজের চরকাটি ঘোরে অলীক মনে।।
মনে পড়ে তলৌশ লুত্রেকের কথা
এমিল জোলা যেন বসে আছে কোনো এক ক্যাফের কোলে
শোবে মোমার্ত সকাল হোলে।।