পুড়তে পুড়তে প্রান্তটি ছুঁয়ে আছি শুধু…
শেষ হয়ে এলো বুঝি সময় আমার
আলো ছড়াবার,
কিন্তু তোমার চোখ ভেজা কেন?
… আমার যাবার পরে
বিলিয়ে দিও সর্বত্র ভালোবাসার কথা
পাখিদের ভালোবাসার কথা
বিলিয়ে দিও অবাধ বিচরণের কথা
নয়তো করবে গ্রাস সফল আকাশ দ্রুত
চেতনার দাস
ঘন হবে অন্ধকার আরো।
সময় নেই বড়ো বেশি আর
যাবার আগে তাই যেতে চাই আরেকটিবার
সমুদ্রস্নানে, তুমি যাবে কি?
(ভালোবাসার কথা)
এ-কবিতা কেন লিখেছিলেন প্রণয় কান্তি? নিয়মানুযায়ী এটা তো তাঁর চলে যাওয়ার সময় নয়। কিন্তু যে-দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল শরীরে, তা তাঁকে দীর্ঘকাল মর্ত্যের ভালোবাসা, আলো-হাওয়া উপভোগ করতে দেবে না- এটা উপলব্ধি তাঁর হয়েছিল। আপাদমস্তক কবি, নিঃশেষিত হতে থাকা জীবনের সঙ্গে দাহ্য বস্তুর তুলনা টেনেছিলেন। আলো ছড়াবার জন্য আরও কিছু সময় হয়তো চেয়েছিলেন, কিন্তু জীবন দৈর্ঘ্যের যে-বস্ত্রটি জড়িয়ে নিয়েছিলেন গায়ে, আগুন এসে ছুঁয়েছিল তার শেষ প্রান্তটি।
ঝড়ের মুখে একটি প্রদীপশিখা দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কিন্তু শেষও কি হয়ে যায় চিরতরে? কিছুটা রেশ তার থেকে যায় না কোথাও? থাকে। রেশ থেকে যায়। সেই স্পর্শে যারা আলোকিত হয়েছিল, তাদের মধ্য দিয়েই আলোর বেঁচে থাকা।
প্রণয় কান্তি শিক্ষক ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সনদ নিয়ে বৈষয়িক নানা প্রলোভনের হাতছানি থেকে মুক্ত থেকে একজন স্কুল শিক্ষকই ছিলেন। চাকরিজীবী নন, প্রকৃত একজন আলোর দিশারি। যাঁরা তাঁর ছাত্র ছিলেন তাঁদের কাছ থেকে জেনেছি, আগুনে পুড়তে পুড়তেও আলোকবর্তিকাটি তিনি তুলে দিয়ে গেছেন তাঁদের হাতে। পরশমণির স্পর্শে এসে সেই শিক্ষার্থীদের অনেকেরই জীবন পুণ্য হয়েছে, পূর্ণ হয়েছে- এক জীবনে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা ও সাফল্যই বা আর কী হতে পারে?
প্রণয় কান্তির সঙ্গে আমার পরিচয় অল্প দিনের। প্রথম দেখা হয়েছিল বইবিপণি বাতিঘরে। বয়সে আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবেন হয়তো। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাঁড়ি-গোঁফ, একটি বিষণ্ন মুখের মধ্যেও উজ্জ্বল গভীর বাঙ্ময় দুটি চোখ। তাঁর সান্নিধ্য সংক্রামক। নিম্নকণ্ঠের মানুষটি খুব সহজে কাছে টানতে পারেন। অন্তত আমি প্রথম দিনটিতেই স্পর্শ করতে পেরেছিলাম তাঁর হূদয়ের উত্তাপ। পরে তাঁর কবিতা পড়ে সহজাত কবিত্বের পাশাপাশি তাঁর বোধের গভীরতা, মেধার দীপ্তি অনুভব করেছি।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, ফলে পাঠ ও প্রস্তুতি ছিল। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাস জানেন, তার পরম্পরা, তার সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলো জানেন। এসব জেনেবুঝেই নিজের সাহিত্যসাধনার পথটি তৈরি করেছিলেন। কবিতা লিখেছেন বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই।
তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা-অনুষ্ঠানে আলোচক হিশেবে উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। আলোচনার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে তাঁর কাব্যগ্রন্থটি (আকাশলীনার সঙ্গে কিছুক্ষণ/As I Loved you madly) পাঠ করে তাঁকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিলাম। সম্ভবত আমার সেই মুগ্ধতার কথা অকপটে জানিয়েওছিলাম মিলনায়তনভরা পাঠক-দর্শকদের।
প্রেম তাঁর কাব্যের মূল বিষয়। ভালোবাসাময় পৃথিবীই ছিল আরাধ্য। সংসারের যাবতীয় মহার্ঘ বস্তুর চেয়ে প্রেমিকার গোলাপি ঠোঁট আর দুটি পিপাসার্ত চোখের জন্য নিঃসঙ্কোচে তাঁর কাব্যপঙ্ক্তি হয়ে উঠেছে আবেগে কম্পমান :
No God, no soul
The rosy lips are my only goal
No truth, no lies
My prayer is only for thirsty eyes
… If you grant my prayer
I promise every night I’ll comb your hair.
(‘A coloured Asking’)
কিন্তু জীবনের অসুন্দর দিকটাও তো দেখেছেন। এই উল্টো পিঠটাকেও এড়িয়ে যাননি। বিরূপ-প্রতিকূল পরিবেশে মানুষের অসহায়ত্বকেও শনাক্ত করেছিলেন। তাই সমাজমনস্কতা কখনও উত্তীর্ণ হয়েছে দার্শনিকতায় :
আতসবাজির মতো এরই নাম কি তবে জীবন
না কি এ শুধুই অস্তিত্ব?
যুদ্ধ কি আমাদের কেবল বাইরে, ভেতরেও নয় কি?
মনে হয় বন্দি হয়ে আছি নিজেরই তৈরি অদৃশ্য খাঁচায়…
সত্যি কি তা নিজেরই তৈরি, শুরুটা কি নয় শুরুতেই?
(‘আকাশলীনার সাথে কিছুক্ষণ’)
প্রণয় কান্তির সঙ্গে সেই অর্থে কখনও বন্ধুত্ব তৈরি হয়নি আমার। কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুতে প্রকৃত বন্ধুবিয়োগের বেদনায় আক্রান্ত হয়েছি। অদ্ভুত বিষণ্নতা নিয়ে তাঁর বইগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে প্রণয় কান্তির সম্ভাবনার বৃত্তটি বোধহয় অসম্পূর্ণই থেকে গেল। আরও কিছু দেওয়ার ছিল তাঁর।