শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা

| শনিবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৪:১০ পূর্বাহ্ণ

আজ ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস। আজ থেকে ৬০ বছর আগে ১৯৬২ সালে পরাধীন পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছাত্র আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন শিক্ষা দিবস। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের দমনপীড়নের বিপরীতে তৎকালীন ছাত্রসমাজের প্রতিরোধ যুদ্ধের এক গৌরবগাথা। ১৯৬২ সালের এই দিনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের করা শিক্ষানীতির প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে মারা যান কয়েকজন ছাত্র। এরপর থেকে এই দিনটিকে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বিভিন্ন শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন।
আমাদের দেশে এ দিবসটিতে তেমন কোন কার্যক্রম বা প্রচারণা সরকারি-বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে খুব একটা নজরে আসে না। অথচ, আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ ইত্যাদি বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন। সবাই জানি, যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। শিক্ষা ছাড়া উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণ কল্পনামাত্র। তাই একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তার শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিলেই হয়। আগে দেখা গেছে, অনেক বড় বড় যুদ্ধে বিজয়ী শক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরি ধ্বংস করে দিয়েছে যেন সে জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবগত না হতে পারে।
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে শিক্ষাকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণের উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং সুশিক্ষার মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ সুশিক্ষার মাধ্যমে মানবমুক্তির বন্ধুর পথ অতিক্রমের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁদের উত্তরসাধক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুশিক্ষার সুষ্ঠু কর্মপন্থাকে মানব-মুক্তির সোপান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি জানতেন, একটি দেশ গড়ার ক্ষেত্রে যে কয়েকটি বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তার একটি হচ্ছে শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে জীবনের সব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। শিক্ষার ওপর তিনি যে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে। শিক্ষা খাতে সে বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো। এমনকি প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শতকরা ৭ ভাগ (৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা) বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো শিক্ষাখাতে। বঙ্গবন্ধু একটি দেশ গড়ার মূল উপাদান হিসেবে শিক্ষাকে অপরিহার্য হিসেবে গণ্য করেছেন।
শিক্ষা গবেষক মাছুম বিল্লাহ বলেছেন, শিক্ষার লক্ষ্য মনে হচ্ছে যেন একজন কেরানি ও প্রশাসক হওয়া মানেই জীবনের সব পাট চুকে যাওয়া। জ্ঞানের আলোচনা নেই, সৃজনশীলতা নেই, মানবতা নেই, সহমর্মিতা নেই, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানা না জানার বালাই নেই, দেশপ্রেম নেই। এ কেমন সমাজ আমরা নির্মাণ করেছি যে, একজন সরকারি কর্মকর্তা হওয়াটাই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় ব্রত। শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রসমাজের সঙ্গে সেদিনের বিক্ষোভ মিছিলে মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ৯৫ শতাংশ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে এপার পর্যন্ত নৌকার মাঝিরা বইঠা হাতে মিছিলে চলে এসেছেন। চারটি বড় দাগের ঘটনা বা বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর আন্দোলন বা গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন। ১৭ সেপ্টেম্বর এত গুরুত্বপূর্ণ দিন হওয়া সত্ত্বেও দিনটি এখনো জাতীয় দিবসের স্বীকৃতি পায়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে যুগোপযোগী পরিবর্তন আসেনি যদিও ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে এক মাইলফলক। দূর হয়নি বরং আরো বেড়েছে গ্রাম ও শহরের মাঝে শিক্ষাবৈষম্য।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিক্ষা দিবসের চেতনায় উঠে আসা সার্বজনীন, বৈষম্যহীন, একই ধারার বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষাকে করা হয়েছে বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ। যার প্রভাবে সারা দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা- সর্বস্তরেই চরম নৈরাজ্য চোখে পড়ছে। দেশে এখনও প্রাথমিক স্কুলের ঘাটতি রয়েছে; রয়েছে শিক্ষক সংকট। এখনও জাতীয়করণের দাবিতে এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের আমৃত্যু অনশনে যেতে হয়, যা শিক্ষা দিবসের চেতনার পরিপন্থী। বিশ্লেষকদের মতে, শিক্ষাদানের ব্যাপ্তি বেড়েছে কিন্তু মান কমেছে সর্বত্র। শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষা দিবস