শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতিমনা করে গড়ে তুলতে হবে

| সোমবার , ৪ জুলাই, ২০২২ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমশ বেড়েই চলছে নানা অপতৎপরতা। যার লাগাম টানা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে জাতিকে চরম মাশুল দিতে হতে পারে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন। তাঁরা বলছেন, এখনই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে জাতি হিসেবে আমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবো।
যেখানে শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত, যেখানে দিনের আলোয় জনসম্মুক্ষে একজন স্ত্রীর সামনে তার স্বামীকে হত্যা করা হয়, সেখানে দেশের মানুষের নৈতিকতা কোন্‌ পর্যায়ে পৌঁছেছে তা আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি অনেক আগেই। প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের মা-বোনরা নির্যাতিত হচ্ছেন; এমনকি শিশুরা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এসব কিছুই আমাদের নৈতিকতা বিপর্যয়ের চরম অবক্ষয়ের নমুনা। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পারিবারিক শিক্ষাব্যবস্থার গলদের কারণে আমাদের নৈতিকতার আজ এ বিপর্যয় ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। আমাদের দেশের পিতামাতারা সন্তানকে মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করে থাকেন; কিন্তু সে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে কিনা তার চেষ্টা আমরা করি না। নৈতিকতা বিপর্যয়ের ভয়াবহ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে বিশ্লেষকরা ভাবছেন। তাঁরা বলছেন, ‘মানুষের নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা, মূল্যবোধে চরম আঘাত করেছে। অপরাধ, অপকর্ম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি থেমে নেই। বরং নৃশংসতা অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। খুনীরা খুন করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, লাশ গুম করতে কুপিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলছে। কখনো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে লাশ বিকৃত করে দিচ্ছে। মেয়ে বাবা-মা, বোন ও স্বামীকে খুন করে নিজেই আত্মসমর্পণ করছে। প্রতিহিংসা এতটাই নির্মম যে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। কে কখন কিভাবে নির্মমতার শিকার হবে, তা কেউ বলতে পারে না। এমনকি আপনজনদের হাতেও কেউ নিরাপদ নন। সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ থাকবে, এটা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে অপরাধ যাতে সহনীয় ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, এজন্য পারিবারিক ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চা ও বিকাশ অব্যাহত রাখা জরুরি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর ধারাবাহিকতা থাকতে হয়। দেখা যাচ্ছে, মূল্যবোধের এ জায়গাটি নাজুক হয়ে পড়েছে। নীতি-নৈতিকতা কি জিনিস মানুষ তা ভুলতে বসেছে। যে যেভাবে পারছে নিজের আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে সমাজে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনার উদ্ভব হচ্ছে। একটি নৃশংস ঘটনার পর আরেকটি ঘটছে। কোনোভাবেই এর প্রতিকার করা যাচ্ছে না।’
আমাদের দেশ দিন দিন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে, অগ্রগতির দিকে ধাবিত হচ্ছে ক্রমশ। প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স, জাতীয় আয়, গড় বয়স, শিক্ষার হার, অবকাঠামোর উন্নয়ন সূচক বাড়ার খবরে আনন্দিত হচ্ছি, পুলকিত হচ্ছি আগামীর সম্ভাবনার খবরে। কিন্তু এই বর্তমান ভাবিত করছে এক ভয়ানক ভবিষ্যৎ বাস্তবতাকে। কেননা আমাদের দেশে সততার চর্চার বদলে আর্থিক লাভবান হওয়ার চর্চা বেশি হচ্ছে বলে ধারণা। মনে রাখা দরকার যে, সততার মূলে রয়েছে নৈতিক শিক্ষা। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো নাগরিকদের আদর্শবান হিসেবে গড়ে তোলা। শিক্ষাবিদরা জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার প্রশংসা করেন। যেখানে নৈতিকতা, নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব, মানবিকতা, শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষার প্রারম্ভিকা বিবেচনা করা হয়। তাঁরা বলেন, ‘শিশুকাল থেকেই তার দীক্ষা হয়। আসলে শিক্ষার উদ্দেশ্য কিন্তু তাই। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মানেই বোঝানো হয় চাকরিনির্ভর বা সামাজিক কিছু সূচক বিবেচনায় সব মানুষ তৈরির কারখানা। কারিকুলামে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব বা পাঠ অন্তর্ভুক্ত যতটুকু হচ্ছে তার বাস্তব প্রয়োগ চোখে পড়ার মতো কই? বস্তুত গোটা সমাজ হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক। বলতে গেলে চাকরিনির্ভর পাঠদানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে আমাদের পাঠ ও পঠন। শিশুদের অহেতুক প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তোলা হচ্ছে। যার ফলে নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো অপরাধকে শিশুকাল থেকে ডালভাত বিবেচনা করে এগোচ্ছে একটা প্রজন্ম।’
আজকে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উত্থাপন হয়েছে, তারজন্য দুঃখ লাগে। সরকারকে এ ধরনের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে দৃশ্যনীয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের যে নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে, এর জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাদের সংস্কৃতিমনা করে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য রাষ্ট্রকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধআমেরিকার স্বাধীনতা দিবস ও আন্তর্জাতিক সমবায় দিবস