শিক্ষার্থীদের কিছু নেতিবাচক প্রবণতা ও আমাদের করণীয়

বিচিত্রা সেন | সোমবার , ১৪ জুন, ২০২১ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। কয়েক বছর আগে আমার সাথে ব্যাপারটা ঘটেছিল। আমাদের কলেজের মিডটার্ম পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। নিয়মানুযায়ী কোনো বিষয়ে কেউ ফেল করলে তার অভিভাবককে রেজাল্ট হস্তান্তর করা হয়। এজন্য অভিভাবক সভার আয়োজন করা হয়। আমাদের কলেজে একেকজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ২০/২৫ জন ছাত্রকে গাইড স্টুডেন্ট হিসেবে রাখা হয়।সেইবছর আমার তত্ত্বাবধানে ২০ জন স্টুডেন্ট ছিল। তার মধ্যে ৬/৭ জন ফেল করেছিল।নিয়মানুযায়ী সেসব স্টুডেন্টের অভিভাবককে অভিভাবক সভায় আমন্ত্রণ জানানো হলো। নির্ধারিত তারিখে একজন বাদে সব অভিভাবক আসলেন এবং আমাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে রেজাল্ট নিয়ে চলে গেলেন। যে ছাত্রটির অভিভাবক আসলেন না ফোন নম্বর বের করে তাঁকে ফোন করলাম। কিন্তু পাঁচ/ছয়বার ফোন করেও সংযোগ পেলাম না। বাধ্য হয়ে পিয়ন দিয়ে ছাত্রটিকে ক্লাস থেকে ডাকালাম।
ছাত্রটি এসে আমার সামনে মাথা নিচু করে মুখ কাঁচুমাঁচু অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমি তাকে অভিভাবক না আসার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। সে কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই রইলো। বার বার জিজ্ঞেস করার পর সে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ছলছল করে বললো,”ম্যাডাম আমার বাবা মা কেউ আসবে না, কারণ তাঁদের সামনের সপ্তাহে ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।” ষোল/সতেরো বছর বয়সী একটা ছেলের মুখে এ কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এ বয়সে যখন মা-বাবার সঙ্গ বেশি দরকার, তখন এরকম একটা বিপর্যয় না জানি তাকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে। আমি উঠে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, ‘সরি, আমি তো ব্যাপারটা জানতাম না। ঠিক আছে, তোমার অভিভাবক আসতে হবে না। আজ থেকে এ কলেজে আমিই তোমার অভিভাবক। ছেলেটা আবারও আমার দিকে চোখ ছলছল চোখে তাকিয়ে আমাকে ধন্যবাদ দিলো।
এরপর আমি ছেলেটাকে নিয়ে উঠেপড়ে লাগলাম। সে যে তিন বিষয়ে ফেল করেছিল, সে বিষয়ের অধ্যাপকদের সাথে কথা বলে বিনাবেতনে তাদের কাছে প্রাইভেট পড়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। এর মধ্যে বার বার তার অভিভাবকের নম্বরে ফোন করতে লাগলাম, কিন্তু কোনোবারই সংযোগ পেলাম না। সপ্তাহখানেক পর থেকে ছাত্রটি কলেজে আসা বন্ধ করে দিলো,এমনকি খবর নিয়ে জানলাম সে আর প্রাইভেটেও যায় না। বুঝলাম, মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যাওয়াতে সে হয়তো মানসিকভাবে মুষড়ে পড়েছে। খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো ছাত্রটিকে নিয়ে। অন্য ছাত্রদের কাছ থেকে তার বাসা চেনে কিনা জানতে চেয়ে নিরাশ হলাম। ফোনে সংযোগ না পাওয়াতে কোনোভাবেই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না। এভাবে মাসখানেক কেটে গেলো।
একদিন টিফিনছুটিতে চা খাচ্ছি,এমন সময় এক ভদ্রলোক এসে অভিভাবক পরিচয় দিয়ে আমার সাথে তার ছেলের ব্যাপারে কথা বলতে চাইলেন। ছেলের রোল নম্বর এবং নাম জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলাম, উনিই সেই ছাত্রের বাবা। আমি তাঁর ছেলে কেন এক মাস যাবৎ কলেজে আসে না জানতে চাইলাম। তিনি উল্টো রেগে গিয়ে জানতে চাইলেন আমরা কেন কলেজ থেকে এতটা দিন তাঁর স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করিনি। কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারলাম তিনি আমেরিকা থাকেন, এক সপ্তাহ আগে দেশে ফিরে ছেলের কাণ্ডকীর্তি ভালো না লাগাতে কলেজে এসেছেন খবর নিতে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তাহলে যে ছাত্রটি বলেছিল একমাস আগে তার বাবামায়ের ডিভোর্সের কথা। তাঁকে বললাম সে কথা। কতক্ষণ তিনি নির্বাক আমার দিকে তাকিয়ে থেকে স্ত্রীকে ফোন করলেন এবং ছেলেকে নিয়ে তখনি কলেজে চলে আসতে বললেন। তারপর এক অভূতপূর্ব কাণ্ড! বাবা-মা ছেলে তিনজনই অঝোরে কাঁদছে। বাবা-মা কাঁদছেন অপমানে, ছেলেকে মানুষ করতে পারেননি বলে। ছেলে কাঁদছে ধরা পড়ে যাওয়ায়। ভয়ে, লজ্জায়। জানতে পারলাম ছেলেটি আমাকে যা বলেছিল সব মিথ্যে। তাঁদের মধ্যে অত্যন্ত সুসম্পর্ক। জানা গেলো আমার ফোন নম্বর ছাত্রটি ওর মায়ের ফোনে ব্লক করে রেখেছিল। আর ওর মা আমাকে ফোন করতে চাইলেও নাকি বলতো আমি ভীষণ বদরাগী, অভিভাবকরা ফোন করলে আমি খুব খারাপ ব্যবহার করি। এছাড়াও সে নাকি ছয় সাবজেক্ট প্রাইভেটের কথা বলে প্রতিমাসে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতো। সব দেখে, শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আমার ছাত্রছাত্রীরা আমাকে খুব ভালোবাসে, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ যে আমার সাথে এত বড় প্রতারণা করতে পারে তা আমার স্বপ্নেও ছিল না। সুখের কথা পরবর্তীতে ছাত্রটিকে আমি কাউন্সিলিং করে খুব ভালো রেজাল্ট করিয়ে কলেজ থেকে বিদায় দিতে পেরেছিলাম।
এতবড় কাহিনিটা লিখলাম আমাদের সমাজের কিছু মানুষের মিথ্যা বলার প্রবণতা নিয়ে। এটা আসলে ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠে। মা-বাবা এবং শিক্ষকদের নজরে না পড়লে তারা আর নিজেদের শোধরাতে পারে না। ২৬ বছর ধরে শিক্ষকতা পেশায় থাকাতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে। তাদের মধ্যে দেখেছি অনেকে অকারণে মিথ্যে বলতে ভালোবাসে। মজাচ্ছলে মিথ্যা বলে অন্যকে ঠকিয়ে তারা এক ধরনের মজা পায়।
পরবর্তীতে বয়স বাড়লেও তারা আর তাদের স্বভাবজাত অভ্যাস থেকে সরে আসতে পারে না। এজন্য পরিবার থেকেই প্রথমে নজর রাখতে হবে শিশুর মিথ্যা বলার প্রবণতার দিকে। একবার আমার সহকর্মীর এক গাইড স্টুডেন্ট চারমাসের বেতন না দেওয়াতে তাকে তলব করা হলো। সে জানালো তার বাবা মারা যাওয়াতে তারা খুব আর্থিক সংকটে পড়েছে। তাই সে বেতন দিতে পারছে না। আমার সহকর্মী যখন তার মাকে নিয়ে এসে অধ্যক্ষের সাথে দেখা করতে বললো সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না। পরবর্তীতে নানা ঘটনার পর প্রমাণিত হলো তার বাবা মারা যাননি। সে প্রতিমাসে বাবার কাছ থেকে বেতন নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কলেজে সে বেতন পরিশোধ না করে নিজেই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে খরচ করে ফেলেছে। সেই ছাত্রেরও বাবা কলেজে এসে অঝোরে কেঁদেছিলেন।
আমার এক পরিচিতা আছেন, ষাটের কাছাকাছি যাঁর বয়স। তিনি অনর্গল মিথ্যা বলে যান। তাঁর মিথ্যাগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যে কেউ শুনলে তা বিশ্বাস করবে। তাঁর আরও একটা প্রবণতা চট্টগ্রাম শহরের যত স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আছেন তাঁদের সবার সাথে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে বলে তিনি প্রচার করে বেড়ান। এভাবে তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নেন। আমি তাঁকে প্রায় তিন দশক ধরে চিনি। এতবছরেও তাঁর স্বভাবে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আমার চোখে পড়েনি। আশঙ্কা করছি আর হবেও না।
আমার মনে হয় মানুষ মিথ্যা বলে তিনটা কারণে। এক. নিজেকে কোনো বিপদ থেকে বাঁচাতে। দুই. নিজেকে সমাজের উচ্চস্তরে আসীন দেখাতে। তিন. মজাচ্ছলে অন্যকে ঠকাতে। তবে যে কারণেই মিথ্যা বলুক না কেন, তা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে পরবর্তীতে যে কোনো সময় তাকে তার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। রাখাল বালকের গল্পটা আমাদের প্রায় সবারই কম বেশি জানা আছে। তাই আমাদের প্রথমে পরিবার থেকেই উচিত শিশুদের প্রতি নজর রাখা, যেন তার ভেতর মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরি না হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদেরও উচিত কোনো শিক্ষার্থীর মধ্যে এ প্রবণতা দেখলে তাকে কাউন্সিলিং করে শুধরিয়ে দেওয়া। এছাড়াও আমাদের আশেপাশের মিথ্যাবাদী মানুষদের সামাজিক জীবনে সবাই মিলে এড়িয়ে চলা উচিত। তবেই মানুষের মধ্যে মিথ্যা বলার প্রবণতা একেবারে দূরীভূত না হলেও কমে আসবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপারিবারিক সুখগুলো নিয়েই জীবন হোক আন্তরিক
পরবর্তী নিবন্ধব্ল্যাক ফাঙ্গাস