ব্ল্যাক ফাঙ্গাস

ডা. দুলাল দাশ | সোমবার , ১৪ জুন, ২০২১ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

আমরা অনেকেই জানি ফাঙ্গাস অর্থ ছত্রাক। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস অর্থ কালো ছত্রাক। দেশে দেশে করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। এর মধ্যে মে মাসের শুরুতে ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নামে সংক্রামক রোগটির প্রাদুর্ভাব শুরু হল। ইহার বৈজ্ঞানিক নাম মিউকর মাইকোসিস। সাধারণ জনগণ এই রকম একটা রোগের নাম শুনেছে বলে মনে হয় না। আবার কিছু দিন যেতে না যেতে এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রবেশ করল। তিনটা রোগী শনাক্ত হয়েছিল। তার মধ্যে একজন মারা গিয়েছিল বলে শুনেছি। তবে রোগটা নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ হয় নি। দেশের সর্বত্রই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। কারণ ভারত আমাদের লাগানো একটি দেশ। অদ্যাবধি দেখা গেল ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ আমাদের দেশে বিস্তার লাভ করেনি। সুতরাং ভয় পাবার কারণ নেই। সবাইকে বলব স্বাস্থ্যবিধি কঠোর ভাবে মেনে চলুন- ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আপনার ধারে কাছেও আসবে না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম লগ্ন থেকে কোটি কোটি ছত্রাকের জন্ম। আজ হতে ৬১ বছর আগে চট্টগ্রাম কলেজে উদ্ভিদবিদ্যা পড়ার সময় বিভিন্ন প্রকারের ছত্রাক সম্পর্কে পড়েছি ও তাদের নিয়ে ব্যবহারিক ক্লাস করেছি। নদী, নালা-নর্দমা, সারে-গোবরে, খরে, সমুদ্রের তলদেশে, ডোবায়, পুকুরে, পাহাড়-পর্বতে, শিলায়, বাড়ীর আশে পাশে অর্থাৎ যেখানে আর্দ্রতা, অপরিচ্ছন্নতা সেখানে ছত্রাক জন্মাবে। আমরা যে ওল (মাশরুম) খাই সেটাও এক ধরনের ছত্রাক।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকর মাইকোসিস বিশেষ ধরনের অণুবীক্ষণ ছত্রাক এবং মারাত্মক সংক্রমক। এদের মধ্যে আরও দুই প্রকার ছত্রাকের কথা শুনা যাচ্ছে- সাদা ও হলুদ। আমাদের আশে পাশে কোটি কোটি ছত্রাক নিয়ে আমাদের বসবাস। তবে সুখের কথা হল অধিকাংশ ছত্রাকের সংক্রমণ ক্ষমতা খুবই দুর্বল। অনেক ছত্রাক আছে আমরা কাঁচা খাই এবং সুস্বাদুও বটে। বিভিন্ন দেশে রান্না করা ছত্রাক খাদ্য হিসাবে পরিবেশন করা হয়। এই ফাঙ্গাস থেকেই বিজ্ঞানী, গবেষক আলেকজান্ডার ফ্লেমিং যুগান্তকারী এন্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কার করে কোটি কোটি লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। এখনও ওষুধ কোম্পানিরা পেনিসিলিন ডেরিভেটিব তৈয়ার করে। জেনে রাখা ভাল আমাদের খাদ্য হজম প্রক্রিয়া ও পরিপাকতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য হাজার হাজার এই অনুজীব অংশ গ্রহণ করে। ফল, শাকসবজি ও গাছের পাতায় ফাঙ্গাস নিয়মিত সংক্রমণ করে। এইগুলি আমরা কীটনাশক দিয়ে নিবারণ করি। মানুষের শরীরে সাধারণত যে ফাঙ্গাস সংক্রমিত হয়- তা এন্টিফাঙ্গাল মলম ব্যবহারে ভাল হয়ে যায়। কিন্তু ব্ল্যাক ফাঙ্গাস এতই মারাত্মক সংক্রমক যে ইহা মানবদেহে প্রবেশ করে ভীষণ ক্ষতি সাধন করে। এমনকি মৃত্যু ঘটায়। ভারতের ৫টি রাজ্যে ও রাজধানী দিল্লীতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগের প্রকোপ এতই বেড়ে গিয়েছিল যে সরকার মহামারী ঘোষণা করেছিল এবং এই রোগে কয়েক হাজার লোক মারা যায়। ইদানীং ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের কথা বিশেষভাবে উঠে আসল এই কারণে যে ইহা করোনা মহামারীর সাথে সম্পর্কিত। এই রোগ এতই সংক্রমক যে মস্তিষ্কে এবং বিশেষ বিশেষ অঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে মৃত্যু হার পঞ্চাশ শতাংশ।
কোভিড-১৯ মহামারীতে কেন এই রোগ? কারণ কোভিড রোগীদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আশংকাজনক হারে হ্রাস পায়। ফলে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগ ওদের শরীরে আক্রমণ করে বেশী। যাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী সে কোভিড বা ননকোভিড হউক তাদের কাছে আসে না। এই রোগ ছোঁয়াাছে নয়।
কাদের এই রোগ বেশী হয়? কোভিড রোগীরা যাদের স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ অতিমাত্রায় এবং অনেকদিন ধরে ব্যবহ্নত হচ্ছে, যে সমস্ত ডায়বেটিক রোগীদের সুগার লেভেল বেশী এবং রক্তে সুগার অনিয়ন্ত্রিত, যারা কিটোএসিডোসিসে আক্রান্ত, কিডনী ট্রান্সপ্লেন্ট রোগী, যাদের কোমরবিডিটি আছে, দীর্ঘমেয়াদী কোভিড চিকিৎসা যারা পাচ্ছে, চামড়ায় গভীর ক্ষত, যে সমস্ত রোগী অপরিচ্ছন্ন ভেন্টিলেটরে ছিল, ওরাল হাইজিন যারা মেন্টেইন করে না তাদের এই রোগ বেশি হয়। ভারতে তীব্র অঙিজেনের স্বল্পতার কারণে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের ব্যবহার একটা কারণ হতে পারে। স্টেরয়েড ইনহেলার ব্যবহারের পর কুলি না করলে মুখ গহ্বরে সাদা ফাঙ্গাস হতে পারে এবং জিহবা ও খাদ্যনালীতে সংক্রমিত হতে পারে। অনেকদিন ধরে একই মাস্ক ব্যবহার করলে এই রোগ হতে পারে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের লক্ষণ সমূহঃ ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রাইনো অরবিটাল রিজিয়ন (নাক চোখ) দিয়ে মানবদেহে প্রবেশ করে। নাকে ও চোখে প্রদাহ হয়। ফলে নাকের এক পাশে ফুলে যায়। চোখ লাল হয়ে যায়। চোখ দিয়ে জল পরে। চোখ খুলতে কষ্ট হয়। মুখ ফুলে যায়, নাকের দুপাশে সাইনাসগুলোতে ঢুকে এবং সেগুলি থেকে রক্ত ও পুঁছ পরে। এরা চোখের উপরে ফ্রন্টাল সাইনাস পর্যন্ত চলে গিয়ে মস্তিষ্ক আক্রান্ত করে। কিডনী, লিভার এবং নাড়িভুঁড়িও সংক্রমিত হয়।
রোগ নির্ণয়ঃ আক্রান্ত জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ। Endoscopic biopsy from nose, sinus wall, pre maxilla. এমনকি সিটি স্ক্যান করে ংরহঁং ধিষষ দেখা হয়, হাড় আক্রান্ত হয়েছে কিনা দেখা হয়। রোগ কতটুকু বিস্তৃতি লাভ করেছে জানার জন্য গজও করা যেতে পারে।
চিকিৎসাঃ কোভিড আক্রান্ত রোগীদের বেলায় অন্যান্য ওষুধের সাথে এন্টিফাঙ্গাল ড্রাগ, সাথে সাপোরটিভ চিকিৎসা। অতিশয় আক্রান্ত রোগীদের বেলায় শৈল্য চিকিৎসা। কোন কোন ক্ষেত্রে রোগী বাঁচানোর জন্য চোয়াল, দাঁত, চোখ শরীর থেকে বাদ দিতে হয়। এই চোয়াল আবার প্রতিস্থাপন করা হয়।
সতর্কতাঃ আতঙ্কগ্রস্ত না হওয়া। মধ্য মুখমণ্ডল ও চোখের সাবধানতা অবলম্বন। যে সমস্ত কোভিড রোগী হাই ডোজে স্টেরয়েড পেয়েছে ও হাইফ্লো অক্সিজেন পেয়েছে কোভিড ভাল হওয়ার পর ডাক্তারের চেকআপে থাকা। ডায়াবেটিক রোগীরা এই রোগে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সুগার লেভেল নিয়মিত দেখা ও সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখা, যারা কোভিড রোগী নয় তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, ফুল শার্ট পরিধান করা, ফেইস শীল্ড ব্যবহার করা, একই মাস্ক বেশী দিন ব্যবহার না করা। মিডিয়াতে বা প্রচার মাধ্যমের বরাত দিয়ে বাংলাদেশে যে ভাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের আশঙ্কা করা হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তা বিস্তার লাভ করতে পারেনি। পরিশেষে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসসহ কোটি কোটি অনুজীব নিয়ে আমাদের বসবাস। তাই ভয় নয়- সচেতনতায় জয়।
লেখক : প্রাক্তন চিফ এনাসথেসিওলজিস্ট,
বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষার্থীদের কিছু নেতিবাচক প্রবণতা ও আমাদের করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধবহমান সময়