বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ১৪ জুন, ২০২১ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

রাজনৈতিক সমালোচনার এপিঠ ওপিঠ
আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায়, নিউজ পোর্টালে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার চাইতে কম বয়সের তরুণ প্রজন্মের লেখকগণ অনেক জ্ঞানগর্ভ কলাম লিখেন। অনেক কলাম প্রশংসনীয় মনে হয়। কোন তরুণ লেখকের মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করলেও আমি কখনো তাদের মনে কষ্ট লাগে এমন মন্তব্য করি না। যে কারণে আমি মন্তব্য করি না, তা হলো, আমাদের প্রজন্মের লোকজন এখন থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর আগে, আমাদের তরুণ বয়সে আমরা যে মাইন্ডসেট, দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবন প্রণালী গঠন করেছি, আজকের তরুণরা কিংবা যুবকেরা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নতুন মাইন্ডসেট, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছে। আজ মানুষের জীবন প্রতিযোগিতাময়। আজকের দিনের যুবকদের মধ্যে কেউ হয়েছে উদ্যোক্তা, কেউ পরিকল্পনাবিদ, কেউ সিইও, কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা রাজনীতিবিদ। তারা তাদের জীবনপ্রণালীতে প্রতিযোগিতা এবং স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করে টিকে থাকার যুদ্ধ করে। তারা যখন তাদের মনোভাব প্রকাশ করে আমি তাতে ভুলত্রুটি খুঁজতে যাই না। আমার মাথার ভিতরে সবসময় কাজ করে আমি শত চেষ্টা করলেও, আমার চিন্তাকে শত আপগ্রেড করলেও আমি আমার সনাতনী ভাবধারাকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে দিতে পারবো না। ফেসবুকে তরুণ স্ট্যাটাসদানকারীর সাথে বৃদ্ধ মন্তব্যদানকারীর তর্ক বিতর্ক দেখলে আমি ব্যথিত হই। আমি মনে করি তরুণ লেখকদের উচিত বৃদ্ধ লোকটির অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং বৃদ্ধ জ্ঞানী ব্যক্তির উচিত তরুণের আধুনিক চিন্তা চেতনাকে সম্মান করা। দ্বন্দ্ব এবং সমঝোতার মধ্যে-সমঝোতাই সবচাইতে ভালো।
টিভি টকশোতে সত্তরোর্ধ্ব বিশেষজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদরা যেমন অংশ নেন তেমনি তরুণ বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদেরাও অংশ নেন। অনেক সময় টকশোতে বিস্তর তর্ক বিতর্ক হতে দেখি। তেমনি একটি টকশোতে বিরোধীদলের একজন নেতা মন্তব্য করলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাই সরকার চালাচ্ছেন। সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনা ছাড়া অন্যদের ভূমিকা কম। সংগতভাবেই টকশোতে উপস্থিত সরকারি দল এবং বিরোধী দলের দুই নেতার মধ্যে তর্ক লেগে যায়। আমি বিরোধী দলের ঐ নেতার মন্তব্য প্রসঙ্গে অনেক চিন্তাভাবনা করেছি। এই অভিযোগটি কি চমক সৃষ্টি করার জন্য স্রেফ একটি রাজনৈতিক বক্তব্য? আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠনমূলক সমালোচনা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আমাদের রাজনীতিতে ব্লেম গেমের প্রাধান্য বেশি।
বিএনপি’র কোন রাজনৈতিক নেতাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন-আপনাদের দলে কি বেগম খালেদা জিয়ার প্রাধ্যান্য নেই? বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসার পর উনি উনার দলকে জোরদার নেতৃত্ব দিয়ে শক্ত ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠা করেন। এবং ১৯৯১ সালে বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। তিনি দীর্ঘদিন বিএনপিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিলেন। আজ তিনি অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী। বহুদিন থেকে উনার দল বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। বিএনপিতে বেগম জিয়া এবং উনার ছেলে তারেক জিয়ার প্রাধান্য ছাড়া অন্য কোন বিএনপি নেতার প্রাধান্য দেখা যায় না। বেগম জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নেতারা এই দলকে আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারবেন কিনা সেটা কেউ বলতে পারে না। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বেগম জিয়াকে ছাড়া উনারা এগুতে পারবেন কিনা সেটাও বলা মুশকিল। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির বিপুল জনসমর্থন আছে সেটা স্বীকার করতে হবে। বিএনপি যদি বেগম জিয়ার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে থাকে, জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও বেগম জিয়াকে ছাড়া নেতারা সামনে এগুতে না পারে তাহলে আওয়ামীলীগে শেখ হাসিনার প্রাধান্যকে বিএনপি নেতারা সমালোচনার দৃষ্টিতে কেন দেখেন?
মানুষের জীবন স্বল্পস্থায়ী। টেনেটুনে তাকে লম্বা করা যায় না। যারা রাজনীতি করেন উনাদের লক্ষ্য হলো মানুষের উপকার করা, দুঃখ কষ্ট থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়া, নির্যাতিতদের শান্তির পথে নিয়ে আসা, শিশুদের সুন্দর জীবন দান করা। স্বল্প সময়ের জীবনে মানুষ কতো ভালো কাজ করতে পারে, সেটা একটা বড়ো পরীক্ষা। যে রাজনৈতিক নেতা বেশি ভালো কাজ করবেন জনগণ তাকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করবে। সমালোচনা করে জনপ্রিয়তা ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। আমি রাজনীতি করিনা এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথেও সম্পর্কিত নই। কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ অবলম্বন করা কিংবা কারো বিরোধিতা করা আমার কাজ নয়। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনায় কিভাবে সাফল্য অর্জন করতে হবে সেটা লোক প্রশাসনের ছাত্ররা ভালো বলতে পারবেন। আমি ম্যানেজমেন্টের ছাত্র হিসেবে সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা প্রসঙ্গে একাডেমিক আলোচনা করতে পারি। বিএনপি নেতার প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বলা ‘ওয়ান ম্যান শো’ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে আমি রাজি নই। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমন্বয়ের প্রয়োজন হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে শীর্ষ পর্যায়ের অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সম্মতির প্রয়োজন হয়। যেমন-শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে ৩৪/৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাত্রছাত্রীর হাতে তুলে দেয়। কিংবা ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়া হয়। এই ধরনের সিদ্ধান্তে সরকার প্রধানের সম্মতি লাগে। কারণ সরকার প্রধানের ভূমিকা না থাকলে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ পাওয়া সহজ হয়না। বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা দরকার হয়। করোনা বিপর্যয়ের সময়ে বিশ্বব্যাপী টিকা রাজনীতির চক্র ভেদ করে ১৭ কোটি মানুষের জন্য ৩৪ কোটি টিকা সংগ্রহ করতে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা দরকার এটা আমরা বুঝতে পারি। একা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পক্ষে কিংবা একা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে দেশের সকল মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব নয়। আমরা যদি পদ্মাসেতু নির্মাণের অতীত ইতিহাস দেখি তাহলে এটা স্বীকার করতেই হবে যে বিশ্বব্যাংকের চাপ, দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ, অনেক বড়ো বড়ো মানুষের ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন বলেই আজ পদ্মাসেতু বাস্তবে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে বিপ্লব ঘটেছে এটাতে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যায়। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের মতো প্রকল্প, মহাশূন্যে স্যাটেলাইট পাঠানোর প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প, সমুদ্রসীমা বিজয়ের সাফল্য কাহিনী শেখ হাসিনার দুঃসাহসী চিন্তার ফসল। আওয়ামী লীগের শাসন আমলে দেশকে ডিজিটালাইজড করা, কৃষি ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এবং সার, বীজ ও পোকা দমনের ব্যাপারে কৃষকদের সহায়তা প্রদান করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের নিজ দেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত লালন পালন করা নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য। করোনা বিপর্যয়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী জেলা উপজেলা পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে করোনা মোকাবেলায় সক্রিয় রেখেছেন এটা আমাদের মানতেই হবে। শেখ হাসিনার সরকারের সবচাইতে ভালো দিক হলো গরীব মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষার বলয় সৃষ্টি করা। গৃহহীনদের গৃহ দেওয়াও একটি প্রশংসনীয় কাজ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সফলভাবে উনার দায়িত্ব পালন না করলে দেশের এতো উন্নয়ন সম্ভব হতো না। কিন্তু আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা খুবই জরুরি।
থিউরিটিক্যালি বলা হয়ে থাকে ক্ষমতা এবং দায়িত্ব পাশাপাশি চলাচল করে। যেখানে বেশি ক্ষমতা, সেখানে থাকে বড়ো দায়িত্ব। দেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা যেমন বেশি দায়িত্বও তেমন বেশি। সরকারের যে কোন মন্ত্রণালয়ের বড়ো আকারের ব্যর্থতা হলে প্রধানমন্ত্রীকেই তা সামাল দিতে হয়। পদ্মা সেতুর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এটা বুঝতে পারি। ক্ষমতা দুই রকম (১) কর্পোরেট পাওয়ার (২) ডেলিগেটেড পাওয়ার। মন্ত্রীগণসহ প্রধানমন্ত্রী নিরংকুশ ক্ষমতা পান জনগণের কাছ থেকে। কারণ জনগণ উনাদেরকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার ম্যান্ডেট দিয়ে থাকে। উনাদের কাছ থেকে সচিবেরা ডেলিগেটেড ক্ষমতা পান। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীর ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকে পাওয়া নিরংকুশ ক্ষমতা আর সচিবদের ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে পাওয়া অর্পিত ক্ষমতা। মন্ত্রী এবং সচিবদের কর্মকাণ্ডের উপরে প্রধানমন্ত্রীর নজর রাখার বিষয়টি কোন মতেই সমালোচনার বিষয় হতে পারেনা। প্রধানমন্ত্রী চুপচাপ বসে থাকলে সরকারের কর্মক্ষমতা বাড়বে না। প্রধানমন্ত্রী সক্রিয় থাকলে সরকার, মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের সকল কর্মকাণ্ড জোরদার হতে পারে। এইদিক থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একজন সফল প্রধানমন্ত্রী বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের ইন্টারনেটের যুগে প্রবেশের প্রাক্কালে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে আসা সাবমেরিন ক্যাবলের সংযোগ না নেওয়ার ইতিহাস যারা জানেন তারা বলতে পারবেন সরকার প্রধানের নির্লিপ্ততা কি রকম ক্ষতিকারক হতে পারে? পার্লামেন্টারি সিস্টেমের সরকার এবং প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমের সরকারের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারে মন্ত্রীদের ভূমিকা গৌণ থাকে। কিন্তু পার্লামেন্টারি সিস্টেমে মন্ত্রণালয়ের মূল দায়িত্ব থাকে মন্ত্রীর কাঁধে। তা সত্ত্বেও সরকারের সাফল্যের পেছনে প্রধানমন্ত্রীকে নিরলস চিন্তা ভাবনা করতে হয়। প্রধানমন্ত্রীকে নিরলসভাবে কাজ করতে হয়। এই কাজটি যখন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী করে থাকেন, তখন উনার সমালোচনা করার আমি কোন কারণ দেখি না।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্ল্যাক ফাঙ্গাস
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় আগুনে পুড়ল ৫ বসতঘর