শামসুজ্জামান খান: এক ত্রিকালদর্শী অগ্রগণ্য মানুষ

আহমাদ মাযহার | শুক্রবার , ৯ জুলাই, ২০২১ at ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ

প্রাথমিক পর্যায়ে কোভিড ঊনিশ জনিত বিশ্বব্যাপী অতিমারির প্রাণসংহার আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে কম হলেও সমাজের শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গনের কয়েকজন বর্ষীয়ান উজ্জ্বল ও অগ্রগণ্য মানুষ এর আওতায় পড়ে গেছেন; শামসুজ্জামান খান তাঁদের অন্যতম। নিজে কোভিড আক্রান্ত হবার অল্প আগ পর্যন্ত বিশিষ্ট মানুষদের হারানোর বেদনা যেন আর্তনাদ হয়ে তাঁর ফেসবুক-স্ট্যাটাসে ভাষা পেত। তাঁর বিয়োগসংবাদ এখন আমাদের অন্তরে ব্যথা হয়ে বিঁধে আছে! এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল অতিমারি বুঝি বাংলাদেশ থেকে তার করাল গ্রাস গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু না, একটু যেন অপেক্ষা করে তার দ্বিতীয় তরঙ্গের থাবা বাড়িয়ে কেড়ে নিয়েছে শামসুজ্জামান খানের মতো ত্রিকালদর্শী মানুুষকেও, আমাদের সমাজকে যাঁর আরো অনেক কিছু দেয়ার ছিল!
শামসুজ্জামান খান ভাষা-আন্দোলন উজ্জীবিত কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বিদ্যায়তনিক পড়াশোনার সীমানা পার করেছেন। পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষকতা দিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর কালে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির স্বপ্নবিস্তারের অংশী হতে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল বাংলা একাডেমিতে। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের আগে সেখানে তিনি পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর রচনা ও বক্তৃতার পটভূমিতে প্রায় সবসময়ই ক্রিয়াশীল ছিল বাংলাদেশের জাতীয় সাংস্কৃতিকতার বোধ!
বাংলা একাডেমির কর্মকালে নানা দায়িত্বের সঙ্গে তিনি ফোকলোর সংক্রান্ত কাজে মযহারুল ইসলামের উত্তরসূরী হিসেবেও নিজেকে বিকশিত করেছেন। এই সূত্রেই তাঁর সার্বিক বৌদ্ধিকতায় ফোকলোর থেকে পাওয়া জ্ঞানের প্রভাব লক্ষ্যণীয়! বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিকতার ব্যাখ্যায় আধুনিক ফোকলোরবিদ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলেন বলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই হয়ে উঠেছিল প্রান্তিক মানস-অন্তর্ভুক্তিমূলক!
বাংলা একাডেমি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি যথাক্রমে শিল্পকলা একাডেমি ও জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শিল্পকলা একাডেমিতে বা জাতীয় জাদুঘরের শীর্ষ পদে তাঁর কর্মকাল দীর্ঘ ছিল না। স্বল্পকাল কর্মরত থাকলেও জাতীয় জাদুঘরের কর্মকাল তাঁর চৈতন্যে জ্ঞানগত প্রভাব রেখেছিল। পরবর্তী পর্যায়ে বাংলা একাডেমির নানা সংগ্রহশালার উন্নয়নে তাঁর এই জ্ঞানের ভূমিকার প্রভাব দেখা গেছে। মহাপরিচালক হিসেবে
তাঁর দীর্ঘ দায়িত্ব পালনকালে প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ও কর্ম প্রসারে বাংলা একাডেমি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিকতার অবস্তুগত ইতিহাস-উপকরণ সংগ্রহে তাঁর বিশেষ দৃষ্টির প্রভাবও পড়েছিল প্রতিষ্ঠানটিতে!
সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি ছিলেন উদার ও মুক্ত মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ! ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ততা থাকলেও তাঁকে কখনোই সরাসরি রাজনীতিকের ভূমিকায় দেখা যায়নি। তবে তাঁর চৈতন্য ছিল সবসময়ই রাজনীতিলগ্ন! ফলে দেশের রাজনৈতিকতার নানা গ্রোততরঙ্গেও ভেসে না গিয়ে নিজের নিশানা ঠিক রাখতে পেরেছিলেন তিনি। অন্যদিকে উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ভিন্ন রাজনীতির মানুষের কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতেও অসুবিধা হয়নি তাঁর!
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উনিশশো একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নীতিকল্পিত প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রা নির্ভর করছে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবিশেষের যোগ্যতা ও সামর্থ্যের ওপর। শামসুজ্জামান খান ছিলেন আমাদের মধ্যবিত্তীয় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ধারণের সামর্থ্য সম্পন্ন একজন যোগ্য মানুষ। ইতিহাস, সাহিত্য ও রাষ্ট্রসংস্কৃতির বোধ এবং ব্যক্তির মানসবৈশিষ্ট্য অনুধাবন সামর্থ্য ছিল তাঁর এই যোগ্যতার উৎস! ফলে তাঁর ব্যক্তিত্ব অনেক ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিকতাকে অতিক্রম করে প্রতিষ্ঠানের নীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।
মননশীল প্রবন্ধ রচনা, সাংস্কৃতিক নানা বিষয়ের নির্ভরযোগ্য সংকলন সম্পাদনা তাঁর লেখকসত্তার প্রকাশ মাধ্যম; সাহিত্যিক সত্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গবেষকের গভীর অনুসন্ধিৎসা। হয়তো এই অনুসন্ধিৎসু প্রবণতাই বাংলা সন নিয়ে গবেষণায় তাঁকে সবসময় সক্রিয় রেখেছে। বাংলা সনের সঙ্গে জাতীয় সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে প্রায়শই তিনি লিখেছেন ও বক্তব্য রেখেছেন। প্রথাগত বিদ্যায়তনিক গবেষণা সন্দর্ভের চেয়ে এ বিষয়ে নিজের জন্য সরল লোকায়তিক মাধ্যমকেই মনে করেছিলেন গ্রহণীয়।
কর্মসক্রিয়তা তাঁর ব্যক্তিত্বে বেশি দৃশ্যমান থাকলেও তিনি ছিলেন পাণ্ডিত্যপ্রবণও। তবে পাণ্ডিত্য তাঁর ব্যক্তিত্বে অপ্রবেশ্য বর্ম তৈরি করে রাখেনি। ফলে তরুণতমরাও তাঁর বন্ধুত্ব থেকে বঞ্চিত হয়নি!
ফোকলোরবিদ্যায় তাঁর আগ্রহের গভীরতাসূত্রে সমাজ তাঁর কাছ থেকে এ বিষয়ে একটা সামগ্র্যধর্মী গ্রন্থের প্রত্যাশা জাগিয়েছিল। ফোকলোর বিষয়ে তাঁর রচিত প্রবন্ধ-সংকলন পর্যালোচনা প্রসঙ্গে সে-কথা লিখে জানিয়েছিলামও!
সমগ্র বিশ শতক জুড়ে আমাদের সমাজের ব্যক্তির সাংস্কৃতিক কৃতি ছিল শামসুজ্জামান খানের স্মৃতিসীমায়। একই সঙ্গে ইতিহাস সচেতনতা, বর্তমান বাস্তবতার পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যতের অভিলক্ষ্য সমাহৃত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের সামগ্র্যে। বহু ব্যক্তি ও ঘটনা সম্পর্কে জানবার প্রাথমিক সূত্র ছিলেন তিনি। এই রচনার শুরুতে তাঁকে একজন ত্রিকালদর্শী মানুষ হিসাবে উল্লেখ করছি। তাঁর প্রয়াণে আমাদের সঙ্গে ইতিহাসের অনেক সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল!
বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের কর্মশীলতা তাঁর শিশুসাহিত্যের প্রতি প্রীতিকে থামাতে পারেনি। বহু বিচিত্র ক্ষেত্রে ব্যাপৃতির সামগ্র্য সত্ত্বেও তাঁর শিশুসাহিত্যিক সত্তাও ছিল সদা ক্রিয়াশীল। ছোটদের জন্য আরো অনেক কিছু লেখার ইচ্ছেও প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সময়! সময়াভাবে যে পেরে উঠছেন না সে খেদও ছিল তাঁর মনে।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর রচনাবলি সম্পাদনায় তাঁর সম্পৃক্তি তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা! বঙ্গবন্ধুর রচনাবলির যথার্থ প্রকাশে তাঁর ত্রিকালদর্শী অবহিতির ভূমিকা ছিল গভীর! তাঁর সে অবদানের কথা বঙ্গবন্ধু কন্যার লেখায়ও স্বীকৃত হয়েছে।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজে তাঁর সাহচর্য পেয়ে উপকৃত হয়েছি। বাংলা একাডেমির নানা কাজে তাঁর আহ্বানে অংশ নিয়েছি। দু-একবার দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র বিরোধও ঘটেছে। কিন্তু কখনোই সম্পর্কচ্ছেদের কারণ ঘটেনি তাঁর উদার ব্যক্তিত্বের কারণে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিকতার অতি রাজনীতিক পক্ষপাতীকরণের কারণে এ ধরনের উদারতা ক্রমশ অপসৃয়মাণ! তাঁর বিয়োগে এই অপসৃতি আমাদের জীবনে আরো বড় হয়ে দেখা দেবে বলে আশঙ্কা আমার!

পূর্ববর্তী নিবন্ধতামারা
পরবর্তী নিবন্ধক্যাবল পরিবহনের আড়ালে ট্রাকে গাঁজা পাচার