তামারা

মহি মুহাম্মদ | শুক্রবার , ৯ জুলাই, ২০২১ at ৭:৪২ পূর্বাহ্ণ

রাত।
রাজধানী থেকে সজল ফোন করেছিল। ও এখনও অফিসে। লোকজনের কোলাহল শুনতে পাচ্ছে তারা। জানালায় চোখ রাখতেই তার ইচ্ছে হলো দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়ে। হারুকি মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ শেষ করেছে মাত্র। ওয়াতানাবের কথা মনে পড়ছে। আচ্ছা ওকি মিদোরিকে বিয়ে করবে? ওয়াতানাবে শেষে কোন জগতে হারিয়ে গেল? মনে হচ্ছে ওর মতো একটা বন্ধু জুটিয়ে নিতে পারতো তাহলে ভালো হতো। সে কি ফুরিয়ে গেছে?
সজল অন্য মেয়ের সাথে বিছানায় যায়। যেদিন হাতে নাতে ধরে ফেলল সেদিন বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। আত্মহত্যা করতে নদীতে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সন্তানদের মুখ তাকে কাজটি করতে দেয়নি। সজলের তো কোনো ক্ষতি হবে না। এক নারী চলে গেলে ও আরো নারীর সঙ্গ পাবে। কিন্তু তার সন্তানেরা মা পাবে কোথায়? বনফুলের ‘নিমগাছ’ গল্পটির কথা মনে পড়েছিল। রূপ বর্ণনাকারী কবির সঙ্গে গাছটির চলে যেতে ইচ্ছে করেছিল কিন্তু গাছটির শিকড় অনেক দূর চলে গেছে বলে সে যেতে পারল না। একই অবস্থা হয়েছিল নিমগাছের পেছনে যে বাড়িটি ছিল সেই গৃহকত্রীর। সেও সন্তানদের কথা ভেবে যেতে পারল না কোথাও।
আচ্ছা, এমন হতে পারে না! সজলের মতো সেওতো একটা সম্পর্কে জড়াতে পারে। ধুত, কি সব ভাবছে! মাথাটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তামারার। করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে কিছুই লাগত না। সারাদিন চাকরিতেই কাটিয়ে দিত। ঘর-সংসার আর অফিস। আর এত ভাববার সময় কোথায়?
কিন্তু আসলেই কি তামারা ভাববে না? যখন রাতে বিছানায় এপাশওপাশ করে তখন তো একটা কষ্ট ওকে জ্বালায়। আবার যখন বয়সের কথা চিন্তা করে তখনও তো মনে হয় সে ফুরিয়ে গেছে। আর কি চিন্তা! পুরুষ তো ফুরায় না। ওদের সাথে তো আর পাল্লা দেওয়া যায় না। আয়নায় নিজেকে দেখে তামারা। চোখের নিচে কালি জমেছে। ভ্রূটা আছে কি নেই জানে না। টিপটা ম্লান। নাকের বাঁশিটা চ্যাপটা ধরনের। অনেকটা জাপানি মেয়েদের মতো। ইশ ওয়াতানাবে যদি ওর বন্ধু হতো। ওয়াতানাবের সাথে দিনমান ঘুরে বেড়াত। চিরুনিটা চুলে চালিয়ে একটা পাগলামি করে বসল তামারা। গা থেকে কাপড়টা ফেলে দিল মেঝেতে। পরনের সেলোয়ারটাও ফেলে দিল। লাইট আগেই বন্ধ করেছিল। কাচের ভিতর দিয়ে এখন দূরের শহর দেখা যাচ্ছে। আর রাতের আকাশ যেন খুব কাছে চলে এসেছে। এমন সময় জানালার কাচ গলে যেন ওয়াতানাবে চলে এল। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে ওয়াতানাবে। মাথাটা ঝাঁকি দিতেই কল্পনার চরিত্র উধাও হয়ে গেল।

তার শরীর দিন দিন বুড়িয়ে যাচ্ছে। সে এই শরীরের কোনো যত্নই নেয় না। আসলেই তো এক মেয়ে মানুষ নিয়ে পুরুষের আর কয়দিন? আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই আঁতকে উঠল তামারা। দুটো সন্তানের জননী হয়ে সে নিজেই ফুরিয়ে গেছে। তাহলে আর সজলের দোষ দিয়ে লাভ কি! তার ভেতরে এমন কি আছে, যা দেখে সজল আকুল হবে?
বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ল সে। কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর দৌড়ে উঠে আলমারি খুলল। গতবার সজল আসার সময় একটা অদ্ভুত বোতল এনেছিল। তামারা খুব রাগ করেছিল। কয়েকদিন কথাও বলেনি। সেই বোতলটাই তামারা খুঁজতে থাকল। যদি পায় তো নিজেই খেয়ে দেখবে কেমন! কিন্তু না বোতলটি তামারা কোথাও খুঁজে পেল না। তারপর নিরাশ হয়ে এসে বিছনায় শুয়ে পড়ল। হাতে মোবাইলটি পড়াতে ডাটা অন করল। আর এই সময় বেশ কিছু নোটিফিকেশন আওয়াজ তুলল। তার ‘বিষণ্ন সন্ধ্যা’ অনেকের নজর কেড়েছে। সে সবার মন্তব্যগুলো পড়তে লাগল। মন্তব্য পড়া শেষ এবার সে ইনবক্সে একটা বার্তা দেখল। ওয়াতানাবে নামের একজন লিখেছে।
‘কেন এত বিষণ্নতা, ইচ্ছে করলেই বিষণ্নতা দূর করতে পার।’
তামারাও রিপ্লাই দিল, ‘কিভাবে?’
অপরপ্রান্ত থেকে হাসির ইমোজি দিল। তারপর বলল, ‘আমার সাথে কথা বলে।’
তামারা ওয়াতানাবের প্রোফাইল চেক করল। লোকটাকে তার চেনা চেনা মনে হচ্ছে। মনে হয় এই শহরে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওয়াতানাবে হারুকি মুরাকামির চরিত্র। সে তার সঙ্গে কথা বলছে? তামারা অবাক হল।
রাত দুটো। ওয়াতানাবের সঙ্গে কথা চলতে থাকল। তামারার বিষণ্ন ভাবটা কেটে যাচ্ছে। ওয়াতানাবে বলল, একদিন তোমার শহরে চলে আসব।
তামারা খুশি হলো। ওয়াতানাবে এলে একটা বইয়ের দোকানে তারা বসবে। ওরা একসঙ্গে কফি খাবে। কতো কথা হবে। হিসেব করলে ওয়াতানাবে তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটই হবে। দুপুরে ওরা একসঙ্গে লাঞ্চ করবে।
তামারার হাতটা ওয়াতানাবের হাতে থাকবে। কিভাবে হাতটা দখল হয়ে যাবে বুঝতেও পারবে না তামারা। ওয়াতানাবের কুতকুতে ধারাল চোখ দুটো তামারাকে এলোমেলো করে দেবে। ওর দিকে তামারা তাকিয়ে থাকবে। ইশ! সজল তাকে কতদিন ছুঁয়ে দেখে না। বুকের ভেতর একটা কষ্ট বলের মতো উথলে উঠল।

তুমি কিন্তু খুব দুষ্টু।
তুমি বারণ করলে দুষ্টুমি করবো না।
তুমি কি রাগ করলে?’
সে তো এক আধটু করতেই পারি, তাই না?
তামারা কি বলবে ভেবে পেল না। সে হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করল। বলল, আমি কিন্তু ভিলেন হতে পারবো না।
কিসের ভিলেন?
তোমার স্ত্রীর কাছে।
কে তোমাকে ভিলেন করছে?
কেন তোমার স্ত্রী যদি কোনো ভাবে জেনে যায়!
কে মিদোরা? মিদোরাকে আমি এখনও বিয়ে করিনি। যখন জানবে, তখন দেখব।
কিভাবে কি! সামলাতে পারবে তো?
সে দেখা যাবে।
তামারার মুখে গান। সে গুনগুন করে। বই এখন আগের চাইতে বেশি পড়ে। ওয়াতানাবে তার সঙ্গে অনেক ভালো ভালো বই নিয়ে কথা বলে। ওদের দেখা হলে আরো দুচারটা বইয়ের খোঁজখবর দেবে। তামারাও অনেক বই কিনে। ওয়াতানাবেকে বেশ কয়েকটি বই উপহার দেবে সে। নিজের হাতের বানানো আচার দেবে। ওয়াতানাবে নিশ্চয়ই আত্মহারা হবে।

অনেক দিন পর।
সজল এসেছে। তামারাকে হাসিখুশি দেখে একটু অবাকই হল সে। তবে খুশি হলো। এবারও ঘরে রাগারাগি হবে ভেবেছিল সজল কিন্তু এবার কি কারণে তামারা কোনো রাগই করল না। বেশ খুশি মনে সে সজলের সঙ্গে একটা পার্টিতে যোগ দিল।
বাসায় ফিরে স্বাভাবিক ভাবে গল্প করল। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করল সজল তামারার মোবাইল আসক্তিটা একটু বেড়েছে। তা বাড়ুক। অসুবিধে নেই সজলের। তাকে তো অনেক বাইরে বাইরে থাকতে হয়। যদি তামারার দুচারজন বন্ধু-বান্ধব হয় তাহলে ওর সময় ভালো কাটবে। এতে তারই উল্টো লাভ। সে রাতে কড়িডোরে জোছনায় তামারা আর সজল ছিল। তামারা ভেবেছিল সজল চলে গেলে ওয়াতানাবেকে নিজের মতো করে সময় দেবে। তাই সে রাতে তামারা ওয়াতানাবের সঙ্গে যোগাযোগ করল না। এক ফাঁকে মোবাইল হাতে নিয়েছিল কিন্তু সম্ভব হয়নি সজলের পাগলামির জন্য। রাতে যখন সজল ঘুমিয়ে গেল তখন অনেক চেষ্টা করেছে ওয়াতানাবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু তামারা কিছুতেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।
সকাল। তামারা কোথাও তার মোবাইলটা খুঁজে পেল না। ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত ঠেকল তামারার কাছে। সব শুনে সজল নতুন মোবাইল এনে দিল। তামারা তার ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ডটা কিছুতেই মনে করতে পারল না। তথ্য দিতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলল। বাধ্য হয়ে নতুন একটা আইডি খুলল। ওয়াতানাবেকে আর খুঁজে পেল না। দুদিন পর নিজেকে পাগলের মতো মনে হলো তামারার। ওয়াতানাবের কোনো খবর নেই। সজল অফিস করতে চলে গেল রাজধানীতে। তামারা আবার একা হয়ে গেল। উদ্ভট সব ভাবনা আসতে লাগল মাথায়।
তামারা মনে করতেই পারল না, ওয়াতানাবে হারুকি মুরাকামির চরিত্র ছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধশামসুজ্জামান খান: এক ত্রিকালদর্শী অগ্রগণ্য মানুষ