শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যেন ভুলে না যাই

কুমার প্রীতীশ বল | বুধবার , ২৯ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার তেত্রিশতম বার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ‘বিশ্বের ইতিহাসে যে সব গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যায়।’ এ কারণেই আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে অসংখ্য বুদ্ধিজীবী হত্যার পর ডিসেম্বর মাসেই আত্মসমর্পণের দুই দিন আগে হানাদার ও তাদের কোলাবরেটরদের এই সম্মিলিত বর্বরতা। তাদের উদ্দেশ্য একটাইপরাজয়ের আগে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যেন এই বুদ্ধিজীবীদের অভাবে একটি অসামপ্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে না পারে। বিষাদের অশ্রু দ্বারা তাই ওরা বাংলাদেশের বিজয়ের আনন্দকে ম্লান করে দিতে চেয়েছে।’ বলতে পারি, অনেকটুকুই ম্লান করে দিয়েছে। আবার মলিন আনন্দ ক্ষোভে পরিণত হয়, যখন কারো কারো মুখে শুনি ‘আর নয় অতীত মুখিনতা।’ কথাটা যতই ছোট হোক ভয় পাওয়ার মতোই। কারণ কী করে ভুলব সে সব আলোকিত পিতৃপুরুষকে? কী করে বুঝাবো তাদের ভুলতে পারি না ৭১ এর শহীদদের, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। ভুলতে পারি না আমাদের আলোকিত পিতৃপুরুষ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে। তাঁদের ভুলে থাকা, নিকৃষ্টতম অন্যায় কাজ, ভয়াবহ পাপ। কারণবাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশের স্বপ্ন নিয়ে তিনি জীবন দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে তিনি শহীদ হন। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে এই উক্তি করেছে আট বছরের শিশু এষা অরোরা। তার এ মন্তব্য আমাকে শুধু নয়, বোধ করি এ জনপদের প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালিকে এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আর তাই আমরা ভুলতে পারি না শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে। আরও অনেকের মতো তিনিও পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের কোলাবরেটরদের পোড়ামাটি নীতির শিকার।

আমাদের স্মরণ হবে, আমাদেরই শৈশবকৈশোরের কথা। স্কুলের ছাত্র থাকাকালে ‘একুশে ফ্রেবুয়ারি’ রচনা পড়তে গিয়ে জেনেছি, পাকিস্তান গণপরিষদে সেই ৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন কুমিল্লার গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সেই পথ পেরিয়ে আসে ৫২ এর ২১ ফেবু্রয়ারি। তারপর আরও রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। আজ একুশে ফ্রেবুয়ারি শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে উদযাপিত হচ্ছে। ‘স্‌্েরাতকে যেমন আলাদা করা যায় না নদী থেকে, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের (১৮৮৬১৯৭১) নামও পৃথক করা যায় না বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে। সে ইতিহাসের আগের যে ইতিহাস, সেই পর্বের এক শক্তিমান চরিত্র তিনি।’ (সম্পাদকের নিবেদন, আনিসুজ্জামান, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারক গ্রন্থ)

আমাদের আরও স্মরণ হবে যে, শওকত ওসমানের ভূমিকাসহ আমাদের আলোকিত পিতৃপুরুষ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা প্রথম পড়ি দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায়। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর, সেই ব্রিটিশ যুগে কুমিল্লার রামরাইলে এক দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারে। আশৈশব গ্রামীণ জনপদে বেড়ে ওঠা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পরিণত বয়সে বাঙালি জাতির প্রতিনিধিরূপে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা হয়ে উঠেছিলেন।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন সুরেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিষ্য, গান্ধীজীর অনুসারী এবং সুভাষ বসুর সহকর্মী । এখানেই স্পষ্ট হয় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি আর অকুতোভয় জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের সূত্র।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দেশভাগের পর ভারতে না গিয়ে পাকিস্তানেই থেকে যান এ জনপদের মানুষের সেবা করার অভিপ্রায়ে। জন্মভূমির বন্ধন ছিন্ন করতে না পারায়, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে বন্ধিত্ব আর নির্যাতনকেই মেনে নিতে হয়েছে বার বার। শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুপর্বটি ছিল মর্মন্তুদ। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ তারিখে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কনিষ্ঠ পুত্র দিলীপ দত্তসহ পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের কোলাবরেটরা ধরে নিয়ে যায় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। ওখানে তাঁর উপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। তারপর তাঁদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমন কি লাশ পর্যন্ত না। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২১ জানুযারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশবাসী প্রথম শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারে। ক্ষৌরকার রমণীমোহন শীল ছিলেন এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের একজন দুর্লভ প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি সে সময়ে ময়নামতি ক্যান্টমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার সেই প্রতিবেদনে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কনিষ্ঠ পুত্র দিলীপ দত্তসহ হত্যাকাণ্ডের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। বড় মর্মস্পর্শী সে বিবরণ।’ ( জীবনী গ্রন্থমালা : মিনার মনসুর)। শওকত ওসমান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পশ্চিম বঙ্গে চলে গেলে তিনি হতেন মুখ্যমন্ত্রী। আর এখানে থেকে পুত্রসহ শহীদ হলেন।’

প্রশাসক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দৃঢ়তা সম্পর্কে জানা যায় তাঁর বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ থেকে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং একজন বাঙালি সার্জনকে অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে কঠিন বাধা তিনি অপসারণ করেন। একই দৃঢ়তায় তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মেডিকেল, পাবলিক হেলথ ও স্যোসাল ওয়েলফেয়ার মন্ত্রী থাকাকালে এব কাজ করেন। তাঁর অনেক কিছুই আজ অজানা থেকে গেছে ইতিহাসের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। তিনি মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করিলাম। বস্তুত কোনো দেশের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা, বিশেষ করিয়া অনুন্নত দেশের মন্ত্রিত্ব সন্ন্যাসব্রত ছাড়া অন্য কিছু নহে। ফলের আকাঙ্ক্ষা না করিয়া কর্তব্য করিয়া যাইতে হইবেএই সঙ্কল্প করিলাম।’ চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের হাসপাতাল জাতীয়করণ করেছিলেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি নিজেই এর উদ্বোধন করেন। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নের আরও অনেক কাজ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের খুবই সুসম্পর্ক ছিল।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ব্যাপক পঠনপাঠনের অভ্যাস ছিল। কোরান, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক থেকে শুরু করে শরৎ, বঙ্কিম, শহীদুল্লাহ কায়সার কোনো কিছুই তাঁর পাঠ্য তালিকা থেকে বাদ যেত না। সব বিষয়ে তাঁর প্রখর অভিজ্ঞানের প্রকাশ ঘটে। তাঁর সারা জীবনের কর্মযজ্ঞে ‘যে পরিবেশে ধীরেন্দ্রনাথ হিন্দু সমাজের প্রচলিত সামাজিক ভেদ ও সংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রভেদ জ্ঞানশূন্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সেই পরিবেশ এবং তার ভূমিকা আমাদের সামাজিক ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ উপকরণ বলে গৃহীত হবে।

নারীদের ব্যাপারেও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ছিল ভিন্ন ভাবনা। বেগম সুফিয়া কামালকে তিনি বলেছিলেন, ‘যখন মেয়েরা জাগে তখন কিন্তু একটা দেশকে জাগতেই হবে।’ আমাদের দেশে, এই পোড়া দেশের নারীসমাজ আজ নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখছে। বুক বেঁধে ওরা সামনে চলছে। তাই আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়, দেশ একদিন জাগবেই।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের কাছে ঋভু সম্মানে পূজিত হবেন। কারণ যারা সুখি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশী, যারা বস্তুবাদী রাজনৈতিক দর্শন আর গণতান্ত্রিক সুশাসনের সাহায্যে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপটিতে শোষণমুক্ত, সাম্য সমাজের স্বপ্ন দেখেন, তাদের জন্য শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অতি অবশ্যই প্রেরণা। আর তাই বিজয়ের মাসে স্মরণে আনতে চাই শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, ‘প্রেম ভালোবাসা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত শান্তি জগতে প্রতিষ্ঠিত হউক, আমি আমার এই কারাবাসে বসিয়া ইহাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করিতেছি। (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, পৃ্‌্‌ষ্ঠা : ১৫৯)। এমন একজন মানুষকে আজ আমাদের প্রজন্ম জানে না। জানানোর চেষ্টা করি না। তাই স্বাধীনতা দিবসের উৎসবমুখর পরিবেশে উদাত্ত কণ্ঠে বলতে চাই, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যেন আমরা ভুলে না যাই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধসিশেলসের কাছেও হারলো বাংলাদেশ