শম্ভু রক্ষিত অবিস্মরণীয় এক কবি

তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী | শুক্রবার , ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৭:০৮ পূর্বাহ্ণ

কবি শম্ভু রক্ষিত ওপার বাংলার পূর্ব মেদিনীপুরের সুতাহাটা থানার বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামের মানুষ। জন্ম ওপার বাংলায় হলেও তাঁর কবিতা আমাকে নিবিড় নৈকট্যে নিয়ে আসে। ২০২০ সালের ২৯ মে ৭২ বছর বয়সে অনন্তলোকে পাড়ি জমানো একবির সাথে জীবৎকালে আমার কলকাতায় দেখা ও কথা হয়। তাঁর সম্পাদিত ‘মহাপৃথিবী’র ‘বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১, শ্রাবণ ১৪২৫’এ আমার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর নাম মনে এলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সাদামাটা গড়নের এক অনুজ্জ্বল ভানহীন সরল এক ছোটোখাটো মানুষের চেহারাযার বেশবাস অগোছালো, গালে না কামানো কয়েক দিনের দাড়ি, ফেট্টি বাঁধা মাথার পিছন দিকে ঝুলানো জীর্ণ মলিন ব্যাগ। বাইরের এচেহারার বিপরীতে ভেতরের শম্ভু রক্ষিত কিন্তু ভিন্নধর্মী, আপোষহীন, গোঁয়ার। শম্ভু রক্ষিত আসলে এক আশ্চর্য ব্যক্তিসত্তা, যিনি বেঁচে থাকার সাধারণ নিয়মে অভিযোগহীন, নিস্পৃহ, সরল, সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। অথচ সাধারণ্যের বোধগম্যতার বাইরে তার অবস্থান। তিনি সহজলভ্য অথচ তাঁর কবিতার হিরন্ময় শরীরের ভেতর তিনি অধরা, রহস্যময়যার নাগাল হয়তো আমরা ঠিকমতো পাইনি ।

শম্ভু রক্ষিত তাঁর সচেতন নির্মাণক্ষম প্রজ্ঞায় অলৌকিক মেধা ও চিন্তনে এমন সব কবিতা লিখেছেন, যা পড়ে মনে হয়, তিনি দূরাগত কোনো আগন্তুক, ভিনগ্রহী। কবি নিজেও আমাদেরকে সতর্ক করেছেন, আমরা যেন কবিকে কোনোভাবেই তাঁর জীবনানুষঙ্গে দেখার চেষ্টা না করি। তাঁর কবিতা:

আমি গত ১০ বছর ধরে পৃথিবী বর্হিভূত এক সভ্যতার / প্রতিনিধিদের সঙ্গে আছি / আমার স্বপ্ন হলো সমুদ্রের পাখিদের পুরিষ, যা এখানে এসে পড়ে ”

(স্বাধীনতা ৫০, আমি কেরর না অসুর)

অথবা

পৃথিবী যখন আশি কিলোমিটার বা তার চেয়েও পুরু আর্দিত সারথিভূমি/ তখন পনের টন ওজনের সব পাথর, খনি থেকে যে বের করছিল, সে আমিই”

(সোসানীয়, আমি কেরর না অসুর)

অথবা

আমার অস্তিত্বের কোনো একটা অজ্ঞাত উদ্দেশ্য আছেআমি দাবি করি/ আমার তুষারশুভ্র হাত আমাকে এগিয়ে দিয়ে / নিজেকে ফুটকি রঙের সাহায্যে প্রকাশ করে / আমি থাকি তার যন্ত্রপাতির ও তার রত্নভরা শরীরের টুকরা টাকরার মাঝে।” ( সাক্ষ্য)। কবির এই অস্তিত্বকে বুঝতে হলে তাঁর কবিতাকে বুঝতে হবে।

সঙ্গহীন যাত্রা’য় তিনি বলেছেন, “আমি আমার খামখেয়াল অনুযায়ী ছায়াহীন একটি পথ তৈরি করেছি / আমি যা দেখেছি জর্জ এলারী হেলেন দূরবীন তা দেখতে পায়।” কবি শঙ্খ ঘোষও হয়তো তা দেখতে পেয়েছেন; তিনি বলেন, “…কবির কবিতা তার সমকালের পাঠকেরা সেভাবে অনুধাবন করতে না পারলেও আগামী দিনের পাঠকরা তার সঠিক মূল্যায়ন হয়তো করতে পারবে। কারণ শম্ভু বর্তমান সময়ের এক শক্তিশালী কবি।”

তিনি আরও বলেন, “প্রতিমাকল্প আর ভাবনা বা দৃষ্টির জটিল বুননে নতুন একটা আকর্ষণ তৈরি করেছিল শম্ভু রক্ষিতের কবিতা। আমি সব সময়ে তার কবিতা পড়ে গেছি।” গৌতম বসুর মতে, “শম্ভু রক্ষিত বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পেয়েছেন। সেই দেখতে পাওয়ার কিছু কিছু তার কবিতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। আমাদের অনেকের কাছে তাঁর কবিতা সম্পদ, কারণ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমাদের দৃষ্টিকল্পনাশক্তি ততোদূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে নি।” শক্তি চট্টোপাধ্যায় অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন, “সত্তরের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিবান ও সম্ভাবনাময় কবি ছিলেন শম্ভু রক্ষিত।”

শম্ভু রক্ষিতের কাব্যভাষা, বাক্য সাজানোর কৌশল বেশ জটিল ও ঘোরলাগা। তাঁর নিজস্ব ঘরানার এ কাব্যভাষায় শব্দেরা অনবরত রূপ বদলায় । আত্নভেদী শব্দকোষ, ভাবনার উল্লম্ফন, রূপকের অভিনবত্ব, ভঙ্গুর ডিকশনের মাধ্যমে বহুরৈখিক রহস্যঘেরা পথে তিনি কবিতার শরীর নির্মাণ করেন, যা বাস্তবপরাবাস্তবের মিশেলে গড়া। তাঁর অনেক কবিতায় দেখা যায়, তিনি অপ্রচলিত শব্দের গোলকধাঁধায় পাঠককে অপ্রস্তুত রেখে কখনো নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেন, আবার কখনো হ্রস্বীকৃত লাইন থেকে দীর্ঘপথ হাঁটতে থাকেন, দীর্ঘ কবিতা লিখেন। যতিচিহ্ন না থাকায় কবিতাটা কোথায় শেষ হবে, পাঠক বুঝে উঠার আগেই হয়তো দেখা গেল তিনি হঠাৎই থেমে গেলেন। কবিতায় নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে তাঁর অনেক সমালোচনা, তাঁর কবিতা বুঝতে না পারার অপবাদ সত্ত্বেও তিনি আমৃত্যু এলিখন শৈলীতে অবিচল ছিলেন। এটা তাঁর নিছক খেয়াল বা পাগলামো নয়। ‘চিন্তন’ কবিতায় তিনি সুস্পষ্ট জানিয়েই দিলেন:

আমি আজ নিরস্ত্র, অযুগ্ম, ত্বরমাণ / আমি আমাকে আত্নসাৎ ও আক্রমণ করি, / দ্বিধাহীনভাবে সমস্ত কিছু প্রকাশ করে দেখাই / আমি আমাকে থামিয়ে রাখি, অপরিবর্তিত আকার তৈরি করি।” (চিন্তন, শ্রেষ্ঠ কবিতা) । তাঁর এলিখনশৈলীর কারণে তাঁর কবিতা কখনো স্পষ্ট, আবার কখনো অপ্রচলিত শব্দ ও অনুষঙ্গের ব্যবহারে জটিল। পড়লে অনেক সময় তালগোল পাকিয়ে যায় । একটু লক্ষ করুন নীচের কবিতা:

আমার শবদেহ সিংফোভাষী, নাজকা রেখায় জানাচ্ছে– / সবকিছু সরলরেখা জাল ; পশ্চিম কোন দিকে আছে ? / একটি পূর্ণ সূর্য উত্তর দিক থেকে পশ্চিমে যাত্রা করছে/ দীর্ঘকেশী বর্গভীমা ডট বার ড্যাশ থেকে গোলমাল শূন্য থেকে/ জনসংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি করছে ”

( আমার শবদেহ)

তাঁর ভাবনার অবাধ অসীমত্ব আমাদের ভাষাজ্ঞানের অল্প পরিসরের সীমায় আটকে যায়। তিনি ভাবনাকে ভাষায় পরিশীলিত না করে এক অন্যধরণের ভাষা নির্মাণ করেন, যা আমাদের পরিচিত ভাষাগণ্ডির বাইরে। তিনি কবিতায় এমন শব্দ, বাক্য ব্যবহার করেন, যা পড়ে মনে হয়, এ পৃথিবীর নয়। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তা অবলীলায় তাঁর কবিতার চিত্রকল্পের মেজাজের সাথে একেবারে এঁটে একাকার হয়ে যায়। তাঁর কবিতা আসলে অনেক উঁচু মার্গের নির্মাণ শৈলীতে পুষ্ট।

শম্ভু রক্ষিতের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ” ১৯৭১ সালে প্রকাশিত এগ্রন্থের শুরুর কবিতায় তিনি জানিয়ে দেন, “আমার মুখ ও চিবুকের মধ্যে অধ্যাত্নজগৎ যেন কথাবার্তা বলছে / এবং স্থানকাল যেন চিন্তায় খণ্ড খণ্ড, /যেন ভেঙেচুরে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে।”

প্রথম বইটি প্রকাশের দু’বছরের মধ্যেই ১৯৭৩ সালে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ “প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না”। এই একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে শিরোনামহীন ১০৬টি সর্গে রচিত তাঁর বইটি বাংলা কবিতার জগতে এক ব্যতিক্রমী সংযোজন। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে ধ্বনিময় উচ্চারণে তিনি মহাপৃথিবীর এক ছায়াপথ থেকে অন্য ছায়াপথে নক্ষত্রের বলয় ধরে ধরে হেঁটে চলেন । এ পথ বড় দুস্তর ! এ আলোছায়ার কুহক মায়ায় গড়া কবির ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ এতই ব্যাঞ্জনাময় ও দিগন্ত প্রসারী যে, তা উদ্ধারে আপাতত আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থরাজনীতি (১৯৭৬), পাঠক,অক্ষরগুলো (১৯৮২), সঙ্গহীন যাত্রা (১৯৯১), আমার বংশধররা (১৯৯৭), আমি কেরর না অসুর (২০০৪), ঝাড় বেলুনের জোট (২০১৩), শম্ভু রক্ষিতের শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০৫ ও ২০১৫), গল্পগ্রন্থশুকনো রোদ কিংবা তপ্তদিন অথবা নীরস আকাশ প্রভৃতি (১৯৭৪), উপন্যাসঅস্ত্র নিরস্ত্র (১৯৮০), সম্পাদিত কবিতার বইবিদ্রোহ জন্ম নেয় (১৯৭৮)। এছাড়া অন্যদের সাথে যৌথকাব্যসামপ্রতিক তিনজন (১৯৭৩), উত্তর দক্ষিণ(১৯৭৪), শীর্ষ কাব্যগ্রন্থ (১৯৭৫), সমসূত্র(১৯৭৯), স্বরাহত নিষাদ (১৯৯০)। ১৯৬১ সাল থেকে কবিতা কেন্দ্রিক হাংরি জেনারেশন আন্দোলন শুরু হলে শম্ভু রক্ষিত আন্দোলনের স্বপক্ষে “ব্লুজ ( ইষঁবং)” নামে একটা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সরকারের রোষানলে পড়ে মামলা জালে আন্দোলন ১৯৬৫ সালে স্তিমিত হয়ে পড়লে “ব্লুজ” প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৭০ সালে নিজ গ্রাম থেকে শম্ভু রক্ষিত নিজ সম্পাদনায় “মহাপৃথিবী” লিটল ম্যাগাজিন বের করেন, তাঁর মৃত্যু অবধি সম্পাদনা ও প্রকাশ করে যান।

কথাবার্তা, চলাফেরা, জীবনবোধে একেবারে স্বতন্ত্র এ কবি। ব্যক্তি শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে কবি শম্ভু রক্ষিতের কোনো পার্থক্য নেই। দুটো জীবনই বেপরোয়া, খেয়ালী, একরোখা। তিনি খ্যাতির জন্য কারো পিছনে ঘুরঘুর করতেন না। সম্পাদক কিংবা পাঠকের মুখাপেক্ষী হয়ে গতানুগতিকতার পিছনে ছোটেননি। তিনি লিটলম্যাগে লিখতে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। পত্রিকায় সুযোগ থাকলেও লিখতে চাইতেন না। কেন চাইতেন না তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। পত্রিকা থেকে তাঁর লেখা চাওয়া হলেও একরোখা শম্ভু মুখের উপর ‘না’ বলতে পারতেন। ১৯৮৫ সালের কথা। কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের স্মরণসভা হচ্ছিল কলকাতা রবীন্দ্র সদনে। মঞ্চে খ্যাতনামা সব কবি। আমন্ত্রিত কবি শম্ভু রক্ষিত কবিতা পাঠ করলেন। তাঁর কবিতা শুনে পাশে বসা দেশ পত্রিকার জয় গোস্বামী কবিতাগুলো চাইলেন ‘দেশ’ এ প্রকাশের জন্য। শম্ভু জয় গোস্বামীর মুখের উপর বললেন, ‘দেশ এ প্রকাশ করতে হবে না। এগুলো দেব না’। অগত্যা জয় তা এক প্রকার জোর করে নিয়েই দেশ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। আর্থিক সঙ্গতিহীন এ মানুষটি সংবাদপত্রে চাকুরির অফার পেয়েও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে আমৃত্যু পেশাহীন বাউণ্ডুলে জীবন যাপন করেন শুধু কবিতা নিয়ে। ১৯৭৫ সালে ভারতে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করলে তিনি একের পর এক লিখে চলেন নিষিদ্ধ প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ও কবিতা। “বুড়ি হুম” কবিতা লিখে তিনি সরকারের রোষানলে পড়েন। ফলতঃ টানা একবছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৭৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ধরা পড়ে জেলে যান। জেলে রিমান্ডে নিয়ে টানা ২১ দিন অনেক নির্যাতন করেও দৃঢ়চিত্ত ও নির্ভয় শম্ভু রক্ষিতের কাছ থেকে জেল কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য বের করতে পারেন নি। জেলে তাকে প্রথম শ্রেণির কয়েদীর মর্যাদায় রাখা হয়। ব্যক্তিগত জীবনে যিনি জেল, জুলুম, অস্বচ্ছলতা, প্রলোভন কোনো কিছুকেই পরোয়া না করে নিজের পথে অটল থাকতে পারেন ; বিশুদ্ধ কবিতা বির্নিমাণে তিনি কবিতায় অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র, জনপ্রিয়তার বিপরীত স্রোতেও অবস্থান নিতে পারেনতা স্পষ্ট।

শম্ভু রক্ষিতের একটি বাক্য দিয়ে শেষ করছি “আমরা সকলেই পরীক্ষা দিতে বসেছি, খাতা জমা রেখে যেতে হবে, মহাকাল কাকে কত নম্বর দেবে তার ওপরেই নির্ভর করছে কবি ও কবিতার ভবিষ্যৎ।” শুধু বুদ্ধি দিয়ে শম্ভু রক্ষিতের কবিতা ছোঁয়া যায় না, ধ্যানে অনুভব করতে হয় এর মায়াবী সম্মোহন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাঠক এমন কিছু অনুভব করুক যা বিস্ময়কর
পরবর্তী নিবন্ধবান্দরবানে সেনাবাহিনীর শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ