গল্পে যেন পাঠক তার নিজেকে খুঁজে পায়–দুর্মর এ আকাঙ্ক্ষা থেকেই তাঁর গল্পগুলো গড়ে ওঠে, প্রাণ পায়, তাই এলিস মুনরো–র গল্প সম্পর্কে ক্রিটিকরা বলেন–জীবনের রেখাগুলোকে তিনি এমনভাবে এঁকেছেন যেখানে সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে কেবল মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কথা। তাঁর রচিত সাহিত্য পুঙ্খানুপুঙ্খ এক একটি প্রতিকৃতি যেখানে আছে সূক্ষ্ম সব অনুভব এবং গভীর দৃষ্টিকোণ। ছোটোগল্পের দক্ষ স্রষ্টা এলিস মুনরো নারী ও পুরুষের বহুমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন, লিখেছেন শহুরে মানুষের জীবনযাত্রা, প্রজন্মগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব আর আবেগের টানাপোড়েনের কথা। সারা জীবনের সাহিত্যকর্মের জন্য ‘ম্যান বুকার ইনটারন্যাশনাল পুরস্কার’ পেয়েছেন তিনি, ২০০৯–এ। ২০১৩ সালে সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান ‘নোবেল’ পুরস্কার পেয়েছেন, ৮২ বছর বয়সে।
‘ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক সার্কেল অ্যাওয়ার্ড’–প্রাপ্ত ছোটোগল্পের পাণ্ডুলিপি ‘দ্য লাভ অব এ গুড উইম্যান’ বই হয়ে বের হবার পর, ভিন্টেজ এন্ড এংকর বুকস্ রিডিং সেন্টার–এর সদস্যরা এলিস মুনরো’র এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করে, সাক্ষাৎকারটি রিডিং সেন্টারের সাইটে প্রকাশিত হয় ২০১০–এর আগস্টে।
ভিন্টেজ এন্ড এংকর: উপন্যাসের বিরোধিতা করেই কি আপনি গল্পগুলো লিখেছেন? আপনি কি ভেবে নিয়েছেন যে ছোটো–ফর্মের লেখায় এমন কিছু করতে পারছেন, উপন্যাসের পক্ষে যা সম্ভব নয়?
এলিস মুনরো: গল্পগুলোকে আমি এমনভাবে ঘুরিয়ে দিতে পছন্দ করি যা আসলে ছোটো গল্পের ফর্মের শৃঙ্খলাকে ভেঙে দেয়। উপন্যাসের গতির নিয়মকেও আমি অগ্রাহ্য করি। নির্দিষ্ট কোনো ফর্ম সম্পর্কেও চিন্তা করি না। আমি চিন্তা করি ফিকশন নিয়ে, ফিকশনকে ভাঙতে চাই, ফিকশনের বিভিন্ন অংশ নিয়ে চিন্তা করি। আসলে, কী করতে চাই আমি? একটি গল্পই তো বলতে চাই, গল্প বলার পুরোনো নিয়মে ‘কী ঘটবে’ দিয়েই গল্পটি সমাপ্ত হত, কিন্তু আমি চাই ‘কী ঘটবে’র সঙ্গে বেশ কিছু বিপত্তি, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত মোড়, ধারণাবহির্ভূত অভিজ্ঞতাও এসে যুক্ত হোক। পাঠকের কাছে আমি চাই সে এমন কিছু অনুভব করুক যা বিস্ময়কর, শুধু ‘কী ঘটবে’ নয়। সবকিছুই ঘটবে গল্পের চিরাচরিত নিয়মে, পুরোনোর ভেতর থেকে অপ্রত্যাশিত আনন্দের জন্ম হবে এভাবে। দীর্ঘ ছোটো গল্পগুলো যে আখ্যানরীতি তৈরি করে সেটা আমার কাছে শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়।
ভিন্টেজ এন্ড এংকর: গল্প এবং চরিত্রের ধারণা কোথায় পান?
মুনরো: কখনও বিশেষ কোনো স্মৃতি থেকে আবার কখনও বাস্তব ব্যক্তি বা ঘটনা ইত্যাদি থেকেও গল্পের বীজটি পাই। কিন্তু এক সময় স্মৃতিসহ সব কিছু হারিয়ে যায়, তখন গল্পটিও একটা কাঠামো পেয়ে যায়। চূড়ান্ত পাঠে দেখি গল্পের বহু কিছুই আমার চেনা নয়। এমন কিছু লিখি, যাকে অচেনাও লাগে!
ভিন্টেজ এন্ড এংকর: প্রতিদিনের লেখালেখি, পড়াশোনা ইত্যাদি সম্পর্কে বলুন। লেখার কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করেন? প্রতিদিনই কি লেখেন? লিখতে বসেন কখন? একটি গল্প শেষ করতে কতদিন লাগে?
মুনরো: বছরখানেক হবে লেখার কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করছি, আসলে প্রযুক্তির এইসব সুবিধার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়েছি বেশ দেরিতে, আমি এখনও একটি মাইক্রোওয়েভ ওভেনের মালিকও হতে পারিনি। হ্যাঁ, কম্পিউটারে লিখি তো বটেই, কিন্তু কি–বোর্ডে যাওয়ার আগে গল্পটিকে কয়েকবার হাতে লিখেই খসড়া করে ফেলি। এভাবে কাজ করতেই আমি অভ্যস্ত। একটি গল্প লিখতে দু–মাস লাগতে পারে; গল্প ভাবনা শুরু, তারপর লিখতে থাকা। কিন্তু একটি গল্পের জন্য মাত্র দু–মাস বিরল ঘটনা, খুব সম্ভবত ছয় থেকে আট মাস লেগে যায় একটি গল্পের চূড়ান্তে পৌঁছাতে; অনেক পরিবর্তন, কাটাকাটি, ভুল পথে চলে যাওয়া তারপর গল্পের গতিপথ বদলে দেওয়া; ভাবনার কিছু হয়তো এসেছে কিছু আর খুঁজেই পাওয়া যায় না, কিছু তো চিরতরে হারিয়েই যায়, এভাবে… লেখাটি আমার জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত টানা লিখতে থাকি, সকালে ঘুম ভাঙলেই লেখার কাছে ফিরে যাই, এক মগ কফিও বানিয়ে ফেলি, তারপর জীবনের নানামুখী ব্যস্ততা এসে ঝাপটে ধরার আগে পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা লিখে যেতে মরিয়া হয়ে উঠি।
ভিন্টেজ এন্ড এংকর: তরুণ লেখকদেরকে কোন পরামর্শটি দেবেন?
মুনরো: তরুণ লেখককে পরামর্শ দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয় কারণ তরুণ লেখক একেবারেই ভিন্ন, অন্যরকম। তাদেরকে শুধু বলতে পারেন ‘পড়ো’, কিন্তু একজন লেখককে তো পড়ার কথা না বললেও সে অনেক পড়াশোনা করবে, পড়তে পড়তে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে; এমনও হতে পারে, সে হয়তো কিছুই পড়বে না, কিছু ভাববেও না, শুধু লিখবে; এবং এর ফলাফল হবে একটি পর্বতপ্রমাণ ননসেন্স। আপনি যদি লেখক হতে শুরু করেন তাহলে লেখায় আপনাকে বেশ কিছু ভুল করতে হবে, তারপর একদিন যখন লেখাটি শেষ করতে চলেছেন, তখন লেখা নিজ থেকেই ভালো হতে শুরু করবে, কারণ আপনি নিজেই চাইছেন লেখাটি ভালো হোক; এমনকি, আপনি যখন বৃদ্ধ হবেন আর ভাববেন এখনও এমন কিছু বাকি রয়ে গেছে লোকে যা হতে চায়, আপনি সেই হতে চাওয়াকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
ভিন্টেজ এন্ড এংকর : আপনার ওপর কোন্ লেখকদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি? কার লেখা বেশি পড়েন?
মুনরো: ইউডোরা ওয়েলটি, কারসন ম্যাককালার্স, ক্যাথারিন এন পোটার, ফ্ল্যানারি ও’কনর, জেমস এগার বহু আগে থেকেই প্রিয়, যখন ছোটো ছিলাম সেই তখন থেকে। তারপর বয়স বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও এসে জুটেছেন–জন আপডাইক, জন চিভার, জয়েস ক্যারল ওটস, পিটার টেলর এবং আমার ভেতরে একটি বিশাল জায়গা জুড়ে, চিরদিনের জন্য যিনি বসে আছেন তিনি হলেন উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েল। আরও আছেন–উইলিয়াম ট্রেভর, এডনা ও’ব্রায়ান, রিচার্ড ফোর্ড। প্রভাবের প্রশ্নে আমি তাঁদের নামই নেব। এ ছাড়া আরও কয়েক ডজন লেখক আছেন যাঁদের আমি পড়তে পছন্দ করি। আমার সর্বশেষ আবিষ্কার ডাচ লেখক– সেস নুটবুম। লেখকদের নিয়ে এরকম তালিকা করাকে আমি অপছন্দ করি। যদি দেখেন নিজেই নিজের মাথাটি ফাটিয়ে ফেলেছি যখন বুঝব যে বিস্ময়কর অনুভূতি দেওয়া বহু লেখকের কথা বলতে ভুলে গেছি। এ কারণে আমি কেবল তাঁদের কথা বলি যাঁরা আমাকে প্রভাবিত করেছেন, যাঁরা আনন্দিত করেছেন তাঁদের সবার কথা বলি না!
ভিন্টেজ এন্ড এংকর: সিনথিয়া ওজিখ আপনাকে ‘আমাদের চেখভ’ বলে ডাকেন। এই তুলনাকে কীভাবে দেখেন?
মুনরো: সমপ্রতি চেখভ–এর বেশ কিছু লেখা পড়লাম, পুনর্পাঠে। কী বলব! এ–এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। চেখভ যে শুধু আমাকেই প্রভাবিত করেছেন তেমন দাবি করব না, তিনি আমাদের সবাইকে প্রভাবিত করেছেন, শেকস্পিয়রের মতো তাঁর লেখা দীপ্তি ছড়িয়েছে।
ভিন্টেজ এন্ড এংকর: বহু সমালোচক প্রশংসা করেছেন এই বলে যে আপনি এক পৃষ্ঠায় পুরো জীবনটাকে এঁকে ফেলতে সক্ষম এক লেখক। কীভাবে এই ক্ষমতা অর্জন করতে পারলেন?
মুনরো: আমি আমার চরিত্রগুলোকে বহু আগে থেকে জানতাম, তারা আমার অচেনা কেউ নয়; তারা যে পোশাক বেছে নিত, স্কুলে কী কী করতে পছন্দ করত, এইসব… এবং আমি যেন এটাও জানতাম তাদের জীবনে কী কী ঘটবে। কিন্তু লেখার মুহূর্তে আমি যেন কিছুই দেখতে পাই না। তারা সবাই কেমন অচেনা মানুষ হয়ে থাকে। দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ি… গল্প তখন এগিয়ে চলেছে। চরিত্রগুলোকে আমি ঠিক ততটুকুই দিতে পারব যতটুকু দেওয়ার সামর্থ্য আমার আছে।
ভিন্টেজ এন্ড এংকর : আপনার গল্পের বেশিরভাগ চরিত্রই আশপাশের লোকজন, সবাই আপনার সেই অন্টারিওর; কী এই মাটিকে এত উর্বরাশক্তি দিয়েছে যে এত আশ্চর্য সব গল্প এখানকার অন্টারিওর পটভূমিতে লিখতে পারলেন?
মুনরো: নিজেকে আমি কোনোভাবেই অন্টারিওর ইন্টারপ্রেটার বলে মনে করি না, এখানে আমি নিজেই বসতি গেড়েছি। এখানে থাকার সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হল বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ সম্পর্কে জানতে পারা, যারা এই অন্টারিওতে বড়ো একটি কমিউনিটি তৈরি করেছে। ভাষাবন্ধন, আয়–উপার্জন, শারীরিক গঠন সব মিলিয়েই তাদের আপনি বুঝতে পারবেন। আমি এ অঞ্চলের ল্যান্ডস্কেপ ভালোবাসি, সে ভালোবাসা শুধু দৃশ্যের জন্য নয়, প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠার জন্য, আরও গভীর বন্ধনে জড়াবার জন্য; এখানকার আবহাওয়া, গ্রাম, মফস্বল শহরগুলো, তাদের পরপর সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য নয়। পৃথিবীর বুকের ভেতরের রস টেনে টেনে বৃক্ষদের মতো যেভাবে গড়ে উঠেছে তারা, সে জন্য। মানুষের সম্মিলিত জীবনাভিজ্ঞতা থেকে তো নিজেকে আলাদা ভাবতে পারি না, ফলে মানুষের প্রথা, অভ্যাস আর পারিপার্শ্বিকতাও আমার যাপনের অংশ হয়ে ওঠে। রূপকথার জগতের কথা অবশ্য আলাদা।
ভিন্টেজ এন্ড এংকর : স্মৃতি আপনার গল্পে প্রধান ভূমিকা পালন করে। স্মৃতির কী এমন শক্তি, কীভাবে আমাদের জীবনকে এত প্রভাবিত করে যে কারণে আপনিও এত কৌতূহলী?
মুনরো: স্মৃতি হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে আমরা আমাদের গল্পগুলো নিজেদেরকে শোনাই, গল্পগুলোকে নানা ভঙ্গিতে, নানা সংস্করণে অন্যদেরও বলি। এভাবে আমরা আখ্যান বর্ণনার শক্তিটিকে চলমান রেখে জীবনকে অবিরাম চালিয়ে নিয়ে যাই। বলতে বলতে মুখে মুখে বদলে যাওয়া, প্রেরণাদানকারী কিংবা শুধুমাত্র বিনোদনমূলক এই গল্পগুলোর গভীরে, আনাচেকানাচে আমরা সন্ধান পাই এমন এক বিস্ময়ের, এমন এক বিশেষ সত্তার, যাকে বলা হয় ‘সত্য’।
ভিন্টেজ এন্ড এংকর: নিজের লেখা এমন কিছু গল্পের কথা বলুন যে গল্পগুলোর কথা বারবার মনে পড়ে।
মুনরো: আমি সবসময় সেই গল্পটিকেই সেরা মনে করি যে গল্পটি এই মুহূর্তে লিখছি, তারপর দ্বিতীয় সেরা মনে করি যে গল্পটি এইমাত্র প্রকাশিত হল! সর্বশেষ প্রকাশিত বইয়ের ‘সেইভ দ্য রিপার’ এবং ‘মাই মাদারস ড্রিম’ গল্প দুটি আমার অত্যন্ত প্রিয়; আবার পুরোনো গল্পের মধ্যে ‘প্রগ্রেস অব লাভ’, ‘লেবার ডে ডিনার’, আর ‘ক্যারিড অ্যাওয়ে’ অত্যন্ত প্রিয়, এবং এরকম আরও বহু গল্প আছে…