লোকসংস্কৃতির বটবৃক্ষ

ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী | শুক্রবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২১ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

কী বিষাদময় অদ্ভুত মিল। বাংলা একামেডির সভাপতি পদে সমাসীন থেকে বাংলাদেশ আকাশের দুই নক্ষত্রের তিরোধান ঘটলো। কিংবদন্তি বাঙালি আনিসুজ্জামান স্যারের করোনা সংক্রমণজনিত বিদায় ছিল করোনার প্রথম ঢেউ ধরে। জাতি তাঁকে হারানোর পর এই শ্রেষ্টপদে যৌক্তিকভাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন সময়ের আর এক বাঙালি মনীষী শামসুজ্জামান স্যারকে। সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধু কন্যা এই মহান দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছেন।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে তিনিও ভেসে গেলেন। অত্যন্ত বেদনাবহ চিত্তে করোনা দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে লোকসাহিত্য-বিজ্ঞানী বটবৃক্ষ শামসুজ্জামান স্যারের প্রয়াণে এই লেখাটা লিখতে হচ্ছে। যেদিন স্যার নতুন পদে যোগদান করতে যাচ্ছেন, করোনা স্বাস্থ্যবিধি তাঁর জানা থাকা সত্ত্বেও, তাঁকে ফোনে কিছু টিপস্‌ ফোনে ও মুঠোফেনে মেসেজ রুপে পাঠিয়ে দিই। পরিচিত হবার পর থেকে তাঁর চিকিৎসা নিয়ে মাঝে মাঝে তিনি এরুপ কিছু পরামর্শ জেনে নিতেন। আমিও স্যারের শারীরিক কুশলতা সর্ম্পকে কখনো কখনো খোঁজ নিতাম, সাথে পত্রিকায় তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশিত লেখা ও জাতির বাতিঘর এর মতো বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর জোরালো অবস্থান সম্বন্ধে কিছু আলাপচারিতা হতো। বিশেষ করে দেশে লেখালেখির সৃজনশীল কর্মে যাঁরা নিবিষ্ট, কিন্তু স্রোতের উচ্ছ্বাসে তেমন জায়গা করে নিতে অনীহা যাঁদের , তাঁদের কে পাদপ্রদীপের আলোয় আনতে নির্ভীক ও উচ্চকন্ঠ ছিলেন তিনি।
লোক-সংস্কৃতি গবেষণা কর্মে তিনি তৈরি করে নিয়েছেন প্রদীপ্ত আসন, পেয়েছেন ভুবনজোড়া খ্যাতি। তাঁর এইসব সৃজনশীল অধ্যায় হতে অন্য অনেকের মতো আমারও কিছু পঠন-পাঠ ছিল। তখনও তেমন করে তাঁর কাছে যাওয়া হয়নি। প্রথমবার তাঁকে সানাসামনি দেখি, তাঁর গভীর জ্ঞানগর্ভ ভাষণ শুনি বোয়ালখালিতে ‘কবিয়াল রমেশ শীল’ স্মরণানুষ্ঠানে। আমার বাবা স্বর্গত সন্তোষ কুমার চৌধুরী এই আয়োজক কমিটির সদস্য ছিলেন। কাকতালীয়ভাবে বাবা ও কমিটির পরামর্শক্রমে সেই সভাতে তাঁর উপস্থিতিতে কিছু কথা বলা সম্ভব হয়েছিল আমারও। কিন্তু তাঁর অপূর্ব বক্তৃতা শ্রবেণোন্দ্রিয়ে রেখাপাত করেছিলো ভীষণভাবে।
মাঝখানে তেমন সংযোগ ঘটেনি। অনেক পরে অনেকটা দুঃসাহস-ভরে ঢাকাতে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের কক্ষে ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গীকৃত ‘ শিশুর জীবন’ এবং বঙ্গমাতা ও শেখ রালেকে উৎসর্গীকৃত ‘শিশু-নিরাময়’ বইদুটি সহ আরও কয়েকখানা বই তাঁর হাতে তুলে দিই। তিনি জানতে চান এখানে একাডেমিক ধারার বই আছে কিনা। আমি তাঁকে ‘আপনার শিশু’ ‘শিশুস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা’ প্রভৃতি গ্রন্থের উল্লেখপূর্বক দ’ুদশক ধরে শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখালেখির বিষয় সবিনয়ে উপস্থাপন করি। তার কিছুদিন পর চট্টগ্রাম থেকে ফোনে স্যারের সাথে কথা বলা হলে তিনি জানান-‘আপনার এই গ্রন্থগুলো আমি একাডেমি লাইব্রেরিতে রাখার জন্য বলে দিয়েছি’। তবে যোগাযোগের এই ধারাবাহিতায় আবার ছেদ পড়ে। কিন্তু বাঙলা একাডেমি ঘিরে, বঙ্গবন্ধুর চিরন্তনী লেখাসমূহ জাতির কাছে প্রকাশের আলোয় ফোটানোর যে বৃহৎ কর্মষজ্ঞ তিনি সাধন করে চলেছেন-তা নিয়ে ওয়াহিবহাল ছিলাম সশ্রদ্ধতায়।
বাংলা একাডেমিকে ও একুশে গ্রন্থমেলাকে বর্তমানের উচ্চতায় স্থাপন করার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। বইমেলায় প্রকাশিত বই নিয়ে তাঁর একটা মন্থব্য আমার নজর কেড়েছিলো, যা আমাকেও মান সম্পন্ন গ্রন্থ রচনায় মনোযোগী হতে উদ্বদ্ধু করে তোলে- যেখানে তিনি বলেছিলেন-প্রতি বছর এই গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে যদি পাঁচ-ছয়টা ভালো বই-ও পাওয়া যায়, তবে তাও হবে অনেক বড়ো অর্জন। এতে করে লেখালেখির মান নিয়ে তাঁর দৃঢ় মনোভাব টের পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম একাডেমি প্রদত্ত সম্মাননায় শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক আমার লেখালেখি নিয়ে তিনি যে মূল্যায়ন করেছিলেন, তা যেন আমার অতি ক্ষুদ্র -তুচ্ছ জীবনে এক স্বপ্নীল প্রাপ্তির মতো। আমার এই লেখালেখি নিয়ে আগে তাঁকে কখনো জানানো হয়েছিলো কিনা- তা তিনি মূলত এই আয়োজনের যিনি রুপকার, আমার পরম শ্রদ্ধেয় রাশেদ রউফের কাছে জানতে চান এবং এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখতে রাজী হন। সন্মানন্না গ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর উক্তি- ‘ প্রফেসের ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী’র চার খন্ডের ‘ছোটদের চিকিৎসা সমগ্র’ ম্যাগনাম-ওপুসপ্রতিম রচনা বাংলায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অনন্য সংযোজন’। তাঁর এরুপ আর্শীবাদ-ধন্য বিশ্লেষণ ছিল, তিন দশক ধরে শিশুস্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ে আমার লেখালেখির জন্য পাওয়া সেরা পুরস্কার। অবশ্য পরে আমার ‘ছোটদের চিকিৎসা সমগ্র’-৬ষ্ঠ খন্ড তাঁকে উৎসর্গ করতে পেরে ধন্য হয়েছি। খ্যাতনামা বাচিক শিল্পী আয়েশা হক শিমুর সঞ্চালনায় এই অনুষ্ঠানে তিনি বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও চট্টগামের অবদান বিষয়ে যে পান্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে উপস্থিত আমার অনেক মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রী ও চিকিৎসক সহকর্মী বিমুগ্ধ চিত্তে জানিয়েছেন, এরুপ অনন্য ভাষণ তাঁরা ইতোপূর্বে খুব কম শুনেছেন। পরে ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত আর এক অনুষ্ঠানেও প্রধান অতিথি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের উপস্থিতিতে সভাপতির ভাষণে তিনি আমার এই লেখালেখি ও বাংলা ভাষায় মেডিক্যাল রচনার ইতিহাস সর্ম্পকিত অপূর্ব বক্তৃতা প্রদান করেন।
স্যার পরবর্তীতে আমার প্রতি এতো স্নেহার্দ্য ছিলেন যে, বলতেন-ঢাকায় গেলে যেন তাঁর নতুন অফিসে যাই। আমার শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক বই প্রকাশের জন্য এক নামী প্রকাশককে বলে দিয়েছিলেন। ঢাকায় এফসিপিএস পরীক্ষা নিতে গেলে তাঁর সাথে দেখা করে আমার মন-ভাবনায় জ্বলতে থাকা দুটো বিষয় ‘ উপাসনলয়ের সামাজিক দায়িত্ব’ ও ‘কৌলিন্য পদবির অত্যাচার’- শীর্ষক দুটো লেখার বিষয়ে তাঁর সাথে আলাপ করি। এই লেখা হয়তো কোনদিন লেখা হবে বা হবে না , তবে স্যারকে তা আর জানানো যাবে না -এই হলো চরম সত্য।
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর ছিল অশেষ শ্রদ্ধা-অনুরাগ। আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ‘ আমার চেখে দেখা নয়াচীন’ বইয়ের নামকরণে বঙ্গবন্ধু কন্যা তাঁর অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেণ। এরকম তাঁর অনেক কথার সোনালি ছটা মনের কোণে ভেসে ভেসে ওঠছে বিপুল তরংগের মতো। তাঁর উত্তরে এই কিংবদন্তী বাঙালির জন্য আমার আমাদের সকলের অপর্ণ -চিরশ্রদ্ধাপুষ্প।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজোর
পরবর্তী নিবন্ধশামসুজ্জামান খান : বিনম্র প্রয়াণলেখ