‘লেট হার লার্ন’ ও আফগান মেয়েদের নীরব কান্না

অনুপ দাশগুপ্ত | রবিবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

কাবুল শহরের বড় রাস্তার মোড়ের দেওয়ালে মোটা কালো হরফে লিখে গেলো মেয়েটি। ‘লেট হার লার্ন’ওকে পড়তে দাও। মেয়েটির চোখের পানি, শক্ত চোয়ালে ঘুরে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার। সম্প্রতি আফগান মেয়েদের উচ্চশিক্ষার অধিকার কেড়ে নিয়েছে শাসক তালেবান। স্রেফ একটি ফরমান জারি করে। পুরুষ সহপাঠীদের সঙ্গে পড়লে, আসল কথা তাদের সমগোত্রীয় হয়ে উঠলে বড় অসুবিধে। তাছাড়া মেয়েরা নাকি এমন সাজগোজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, মনে হয় যেন বিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন! তাই ধর্মের দোহায় দিয়েছেন তালেবান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নিদা মহম্মদ নাদিম। আগেই নিষিদ্ধ হয়েছে মেয়েদের চাকরি, কর্মসংস্থানের অধিকার। রাস্তায় জমায়েত, মিছিল ওসব তো ওরা আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। গুটি কয়েক মেয়ে সাহস করে রাস্তায় বেরিয়ে ন্যায্য অধিকারের দাবি করলে, শূন্যে গুলি ছুঁড়ে ভয় দেখিয়েছে শাসকরা। কাবুল শহরের দেওয়ালে নিজের অধিকার চেয়ে নেওয়া মেয়েটির ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। অবরুদ্ধ কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ক্রন্দনরত, একে অপরকে সান্ত্বনা দেওয়া মেয়েদের ছবিও প্রকাশ্যে এসেছে। দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে সেই ছবি। তবে ওই অবধিই। তাবৎ রাষ্ট্রনেতাদের কেউ কেউ ছি ছি করেছেন। কেউ আপসোস করেছেন। কেউ নির্লিপ্ত থেকেছেন। নিন্দা করে দায় সেরেছেন আমাদের জাতিসংঘও।

আফগানিস্তানের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আর বিশ্বের ভারধারণবহন করা স্বঘোষিত অভিভাবক দেশ, গত দু’দশক ধরে আফগানিস্তানের সেনা মোতায়ন রাখা আমোরিকা একটি ছোট্ট বিবৃতি দিয়ে দায় সেরেছে। শুধু আমেরিকা কেন, সারা পশ্চিমা দুনিয়া এখন ইউক্রেনের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে বড্ড বেশি ব্যস্ত। আফগানকে দেখার কেউ নেই।

২০২১এর আগস্টে তালেবানের পুনরুত্থানের পর কোণঠাসা আফগানিস্তানকে সবাই পর্যায়ক্রমে ছেঁটে ফেলেছে। ক্রমে ধ্বস্ত হয়েছে কাবুলিওয়ালাদের দেশ। অর্থনীতি এখন তলানিতে। খাদ্য, স্বাস্থ্যের, চিকিৎসার মতো ন্যূনতম সেবা নেই। তবে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় পড়েছেন সে দেশের মেয়েরা। তালেবরাই এখন তাদের ভাগ্য বিধাতা। এ সরকারের তৈরি পুণ্য ও পাপ প্রতিরোধ মন্ত্রণালয় তো মূলত মেয়েদের দমিয়ে দিতে তৈরি হয়েছে।

দু’দশক আগে প্রথম পর্যায়ে তালেবানের বিদায়ের পর যারা একটু একটু মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিলেন, আফগান সমাজে সমাদর আদায় করে নিচ্ছিলেন, স্বনির্ভর হচ্ছিলেন, সাংবাদিকতা, খেলাধুলা, সংস্কৃতির মঞ্চে অল্প বিস্তর নাম করছিলেন, তাঁদের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, মুখের ওপর একের পর এক দরজা বন্ধ করা হয়েছে। খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়া থেকেও বঞ্চিত তারা। একা রাস্তায় বেরোনো যাবে না। নতুন করে নিদান দিয়েছে জঙ্গি তালেবান। আফগান মেয়েরা আবারও চার দেয়ালে বন্দি। যেমন দু’দশক আগেও ছিলেন।

২০০১ সালে মার্কিন সেনার কাছে প্রতিহত, অতঃপর তালেবানের বিদায়ের পর আফগান মেয়েদের উচ্চশিক্ষার হার উল্লেখ্যযোগ্যভাবে বেড়েছিল। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে ৫ হাজার ছাত্রী স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে পডাশোনা জারি রেখেছিল, ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ৯০ হাজার। যদিও এই হার শহুরে এলাকাগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ একশ বছর আগেও কিন্তু এমন ছিল না আফগানিস্তান। সেদেশে পা পড়েছিল রাণী সোরাইয়া তারজির। রাজা আমানুল্লা খানের স্ত্রী সোরাইয়া ছিলেন প্রকৃত অর্থে ব্যতিক্রমী। আফগানিস্তানের মেয়েদের জন্য অজস্র স্কুল, হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন। আফগান মেয়েদের সার্বিক উন্নয়নে তাঁর যথার্থ সঙ্গী ছিলেন রাজা আমানুল্লা। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আমানুল্লা আফগান মেয়েদের পর্দাপ্রথা থেকে বের করে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ, সমাজ গড়ার কাজে দেখতে চেয়েছিলেন।

আফগানিস্তানে পা রেখে এক তোলপাড় ফেলা ঘটনা ঘটিয়েছিলেন সাংবাদিক ও কূটনৈতিক মেহমুদ বেগ তারজির মেয়ে সোরাইয়া। ১৯২৮ সালের আগস্ট তখন। লোয়া জিরগা বা মোড়লদের সভায় মুখবরণ টেনে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন তিনি। তার আগে সভায় রাজা আমানুল্লা বলেছিলেন, মহিলাদের অবগুণ্ঠন থাকতেই হবে, ইসলাম তা বলে না। প্রায় একশো বছর পরের আফগানিস্তানে এসব গল্পকথা মনে হয়। ১৯২৮ সালেই মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ এবং ছেলেদের ২১ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমানুল্লা। লোয়া জিরগার ভয়ঙ্কর প্রতিরোধের মুখে পড়ে তার থেকে পিছিয়ে আসেন রাজা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রাজারানীকে ১০ বছরের জন্য নির্বাসনে যেতে হয়েছিল।

আমানুল্লার পূর্বসূরিকে তো মেয়েদের অবস্থার উন্নতি করতে চাওয়ায় খুন হতে হয়েছিল। আফগান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা আবদুর রহমানের বড় ছেলে হাবিবুল্লা কাবুলে মেয়েদের কলেজ এমনকি ইংরেজী মাধ্যমের একটি স্কুলও তৈরি করেছিলেন। এত আধুনিকীকরণের খেসারত দিতে হয় প্রাণ দিয়ে। ১৯১৯ সালে তাঁকে হত্যা করেছিলেন আঞ্চলিক নেতারা। মেয়েরা পুরুষের সমকক্ষ নন। তাঁদের পুরুষের কাছে অবনত থাকতেই হবে। যদিও এ তত্ত্বের সোচ্চার সমর্থক ছিলেন হাবিবুল্লা এবং আমানুল্লার বাবা আবদুর রহমান, তবে মেয়েদের বিয়ের বয়স তিনি বাড়িয়েছিলেন তাতে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দিয়েছিলেন। আমানউল্লাহ নির্বাসনের পর আফগান মেয়েদের ক্ষমতায়নের জন্য বিস্তর কাজ করেছেন রাজা জহির শাহ।

১৯৩৩১৯৭৩এ তাঁর দীর্ঘমেয়াদি শাসনকালে প্রচুর মহিলা চিকিৎসক, নার্স, শিক্ষক তৈরি হয়েছিল আফগানিস্তানে। রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র, বিজ্ঞান এবং কলা বিভাগে ছাত্রীদের জন্য পৃথক শাখা খোলা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন জহির শাহের তুতোভাই দাউদ খান। তাঁর আমলের একদলের সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয় আফগানিস্তান। তবে মেয়েদের শিক্ষায় বাধা দেননি দাউদ খান। বরং মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা আরও বাড়িয়েছেন। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণে ধাপে ধাপে আফগান মেয়েদের স্বাধীনতা হরণ হয়েছে। মেয়েদের জন্য সে বছর কিছু কঠোর নিয়ম বলবৎ করে মৌলবাদীরা। নিয়মাবলীর মধ্যে যা যা ছিল, তার কয়েকটি এরকম: ‘মাঝ রাস্তায় হাঁটা যাবে না’, ‘কোমর দুলিয়ে হাঁটা যাবে না’, ‘অপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না’ ইত্যাদি। একবছর মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপায় মৌলবাদীরা। প্রতিবাদ করেছিলেন নারীবাদী নেত্রী মিনা কেশোয়ার কামাল। তাঁকে হত্যা করে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী তালেবান।

দ্বিতীয়বার অভ্যুত্থানের পর নরমপন্থী হওযার দাবি করেছিলেন তালেবান। তবে তা কথার কথা থেকে গেছে। পরপর কোপ পড়েছে মেয়েদের শিক্ষায়, চাকরিতে। এ সরকারের সব তালেব নেতাই যে মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন তা নয়। ভিন্নমত ছিল। উপবিদেশ মন্ত্রী শের মহম্মদ স্তানিকজাই; স্বাস্থ্যমন্ত্রী কালান্দর অবাদ এবং সরকারের মুখপাত্র সুহেল সারিন ইসলামের কর্তব্য হিসেবে তাঁদের মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছিলেন। তবে তাঁরা হাতেগোনা ওই ক’জনই ছিলেন। সরকারের শরিক হাক্কানিরা ঘোষণা করেন ধর্মাচরণ এবং ধর্মীয় শিক্ষাই শেষ কথা। অন্য শিক্ষা মূল্যহীন। তাই বিধান হল আফগানিস্তানে। প্রতিবাদে এক টিভি চ্যানেলে ডিগ্রি ছিঁড়েছেন, কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। আফগানিস্তানের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগ করেছেন কম করে ৬০ জন অধ্যাপক, গবেষক (ডেইলি টেলিগ্রাফ’১৫ জানুয়ারি’২৩)। ছাত্রীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে পরীক্ষা বয়কট করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।

আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন চাইছেন আফগানিস্তানের নাগরিক সমাজ। পাশে কেউ নেই। সত্যিই কেউ নেই। সব সুকৌশলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আফগানিস্তানকে আরও একবার তুলে ধরার দায় বোধহয় শুধু আফগানদেরই। বা সে দেশের যুবক সম্প্রদায়ের। দ্বিতীয়বার অভ্যুত্থানের পর উঠে এসেছিল বেশ কিছু মুখ। দাপুটে কিছু আফগান তরুণীর মুখ। যেমন ক্রিস্টাল বায়াত, রাবিয়া সাদাত, বেহেশতা আরগন্দ অথবা শামসিয়া হাসানি (দৈনিক দিন দর্পণ’২২ জানুয়ারি’২৩)। কেউ অবরুদ্ধ কাবুলে তালেব নিশানা ফেলে জাতীয় পতাকা তুলেছেন, কেউ তালেবানি শাসনের বিরোধিতায় রাস্তায় মার খেয়েছেন। কেউবা ইস্তাম্বুল, কায়রো, মস্কো, প্যারিসের দেওয়ালে দেওয়ালে এঁকেছেন আফগান মেয়েদের দুর্দশার কথা। আবারও কি পথে নামবেন ওঁরা? নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই লড়বেন আরও একবার? কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আফগান মেয়েদের ওপর যেসব বিধিনিষেধ চাপানো হয়েছে সেসব প্রত্যাহার করার ব্যাপারে আদৌ ভাবিত নয় তালেবান কর্তারা। নারীর অধিকার তাদের কাছে অগ্রাধিকারের বিষয়ও নয়। গত ২০ জানুয়ারি ’২৩ তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছেন, ইসলাম আইন অনুযায়ীই সমস্ত বিষয় বিচারবিবেচনা করা হবে। নারীর অধিকারে বিধিনিষেধের বিষয়টাও সরকার একই নিয়মনীতি অনুযায়ী বিচার বিবেচনা করবে(দ্য টাইস অব ইন্ডিয়া’২২ জানুয়ারী’২৩)। এনিয়ে সম্প্রতি আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে মহিলারা প্রতিবাদ শুরু করেছেন। তালেবান সরকারের এ পদক্ষেপের নিন্দা করেছে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ। সবকিছু শুধু ওই নিন্দা পর্যন্তই। কার্যত আফগান মেয়েদের নীরব কান্না ও দুর্বহ বেদনার অবসান কবে হবে, তার কোনো নিশ্চিত জবাব কারো কাছেই নেই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয়ী স্মৃতি ‘কাহিনি যুদ্ধের নয় জীবনের’
পরবর্তী নিবন্ধইসলামিক ফ্রন্টের নব নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির অভিষেক