লেখার আগে-পরে একাধিকবার রচনাটি নিয়ে চিন্তা করতে হবে

পাঠ্যবইয়ে ভুল :

| সোমবার , ৪ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’-এ ভুল তথ্য থাকার বিষয়ে তোলপাড় চলছে। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানকে তলব করেছে হাইকোর্ট। আগামী ১০ নভেম্বর তাকে সশরীরে হাজির হতে বলা হয়েছে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
শুনানিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার সময় পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ভুল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন হাইকোর্ট। এ সময় আদালত বলেছেন, ‘পাঠ্যবইয়ে এত ভুল থাকা দুর্ভাগ্যজনক।’ রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মো. আলমগীর আলমের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত রুলসহ এ আদেশ দিয়েছেন। রুলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইতে থাকা ভুল সংশোধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। চার সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা সচিব, এনসিটিবির চেয়ারম্যান, সদস্য (কারিকুলাম), সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
বলা জরুরি যে, শিক্ষার অপরিহার্য উপকরণ হলো বই। সরকার স্কুল পর্যায়ে বিনামূল্যে বই দিচ্ছে। যথাসময়ে বই দেওয়ার ক্ষেত্রে এই সরকার সফল। তবে যখন সেই বইয়ে ভুল ধরা পড়ে, তখন সরকারের সকল কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ভুলে ভরা এই বই নিয়ে কী করবে শিক্ষার্থীরা। বই নিয়ে অভিযোগ এই প্রথম নয়। অভিযোগ আছে, যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা বই রচনায় সম্পৃক্ত নন। বইয়ের রচনা, সম্পাদনা ও অনুমোদনে আশ্রয় নেওয়া হয় দুর্নীতির।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্ব পাঠশালার উপকরণ থেকেই তো মানুষ ভাল শিখবে। কেবল প্রতি বছর শত কোটি টাকা বইয়ের পিছনে খরচ না করে শিক্ষকদের মান উন্নয়নে ব্যয় করা দরকার। যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। তাঁরা বলেন, শিক্ষকদের সম্মানী বাড়ান- বই ছাড়াই অনেক বেশি শেখা যাবে। বইয়ের ভারে শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত। ছোট ক্লাসে বইয়ের বদলে শিক্ষার একটি নির্দেশিকা দেওয়া যেতে পারে যার উপর ভিত্তি করে শিক্ষকরা পড়াবেন। আমরা তো বই পড়ে সার্টিফিকেট পাই- আর জীবন আচরণের সব শিক্ষা তো পরিবার ও সমাজ থেকে। অতএব ভুলে ভরা বইয়ের বদলে বই না দেওয়াই ভাল।
পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়, আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আলী মুস্তফা খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার। রিট আবেদনে বলা হয়, সপ্তম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইয়ে ১০ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়। এই নির্বাচন ছিল শুধু পূর্ব পাকিস্তানের। প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তানের সব প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়েছিল। ষষ্ঠ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইয়ে ৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এক সাহসী, ত্যাগী ও দূরদর্শী নেতার ‘আবির্ভাব’ হয়। অথচ প্রকৃত সত্য এই যে, বঙ্গবন্ধু হঠাৎ কোনো ‘আবির্ভূত’ নেতা নন। তিনি তিলে তিলে বাঙালি জাতির নেতা হয়ে উঠেছেন। অষ্টম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ে ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘মাইল’ এর স্থলে ‘কিলোমিটার’ হবে। নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের ২ থেকে ৯ নম্বর পৃষ্ঠার বিভিন্ন জায়গায় ‘শেখ মুজিব’ লেখা হয়েছে। অথচ বর্তমানে সব ক্ষেত্রে ‘বঙ্গবন্ধু’ লিখতে হবে। ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি’ এর স্থলে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি’ হবে। ২৯ নং পৃষ্ঠায় ‘প্রেসিডেন্ট ভবন’ এর স্থলে ‘বঙ্গভবন’ হবে।
হাইকোর্টের তলবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান হাজির হবেন, দুঃখ প্রকাশ করবেন। কিন্তু তাতে কি সমাধান হয়ে যাবে? বছর বছর এভাবে ভুল হবে? শিক্ষাবিদরা বলেন, ‘একটা দুর্ঘটনা যেমন সারা জীবনের কান্না, তেমনি পাঠ্যপুস্তকের একটি ভুলও একজন শিক্ষার্থী, একটি প্রজন্মের জন্য বড় আকারের ক্ষতি। এই বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।’ তাঁরা বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকে যেন ভুল ম্যাসেজ না যায়, সেটি দেখার জন্য অবশ্যই একটি শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার। যেন একই ভুল দ্বিতীয়বার না হয়। যেকোনো ভুলের বিষয়েও সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা যায়।’ তাই যে কোনো বই লেখার আগে-পরে একাধিকবার লেখাটি বা সংযোজন নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এরপর সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে ভুল থেকে নতুন প্রজন্ম ভুল শিখবে। যেটা সবার জন্যই ক্ষতিকর হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বপশু সরক্ষণ দিবস