লাল টিপ

অনুপমা অপরাজিতা | শনিবার , ১২ মার্চ, ২০২২ at ১০:২১ পূর্বাহ্ণ

আজ সকালবেলা একটা তাজা স্বপ্ন দেখে নীতার ঘুম ভাঙল। পূর্বস্মৃতি ঠিক যেন ঘিরে ছিল ভোর হবার পরও। স্মৃতি মনে হলো না, যেন সত্যি হয়ে ফিরে এসেছিল নির্বাণ। সকালবেলা ফুরফুরে মন নিয়ে নিতা তার কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতেই সহকর্মী সায়মা বলে উঠলো ‘কী ব্যাপার ম্যাডাম নতুন খবরটা জানালেনও না যে। ক’দিন ধরে দেখছি কালারফুল সাজে থাকছেন ! নীতা ঠিক বুঝতে পারল না প্রথমে একটু থতমত খেয়ে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লেগে গেল নিতার। জানবেন নিশ্চয়ই ম্লান হেসে নিতা জানালো সায়মাকে। তাঁতের শাড়ি আর লাল টিপ পরিহিতা নিতাকে বেশ ঝলমলে লাগছিল আজ। আর তার এ-সৌন্দর্যই সহকর্মীর চোখে বাধ সাধল। এগারমাস হতে চললো নিতার বর নির্বাণ না ফেরার দেশে। এরপর থেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত নিতার জীবন-যাপন ক্যামন ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে। সবকিছুই বিবর্ণ যেন। এ-কোন প্রথা মানা নয়। সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গ্যাছে নীতার জীবনে শূন্যতার কারণে। হবেই না কেনো ! নির্বাণ তো শুধু দাম্পত্যের অংশীদার ছিল না। ছিল পিতা-মাতার আদলে অনন্য একজন মানুষ, বন্ধু পরম নির্ভরতা। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় নিতার বিয়ে হয়। তার বর তাকে স্নাতকোত্তর কমপ্লিট করিয়েছে। স্বনির্ভর আর স্বাধীনতা যাকে বলে তার সবটুকুই বন্দোবস্তর পেছনে বর বন্ধুটির ছিল অগাধ প্রেরণা। বই পড়া নাটক দেখা গানশোনা থেকে শুরু করে সাহিত্যের সব শাখায় ছিল ওদের তুমুল আড্ডা। নিতা আর নির্বাণ দম্পতি তাদের এলাকায় বেশ পরিচিত। কারও কাছে প্রগতিশীল হিসেবে কারও কাছে সমালোচনার পাত্র হিসেবে। দুজনে অন্যদের চেয়ে আলাদা। আসলে আলাদা করেছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী। কুসংস্কার, মানুষের তৈরি প্রচলিত ধ্যান-ধারণার তারা কখনোই আমল দেয়নি। সহকর্মী সায়মার এমনতর অনধিকার চর্চায় নিতার মেজাজ খারাপ হয়নি কিছুটা বিরক্ত হয়েছে মনে মনে। বরং তাদের জন্য আমাদের সমাজের বঞ্চিত মেয়েমানুষগুলোর জন্য করুণা হয়েছে। শুধু দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য একটামাত্র জীবন এরা যাপন না করে টেনে নিয়ে যায় মানুষেরই চাপানো প্রথার ভেতর। ভারবাহী গাধা হয়ে কাটিয়ে দেয় পুরো জীবন।
বিধবা নারী লালটিপ কেন দেবে! কেন পরবে ঝলমলে শাড়ি! আর এজন্যই তার সমবয়সী সহকর্মী বিভ্রান্ত করে বসলো! তারদিকে চোখ পড়বে কেন অন্য চোখের! বিধবা মানে স্বামীটির মৃত্যুর সাথে সাথে তার স্ত্রী-ও জীবন্মৃত জীবনযাপন করবে। এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই মৌনশাসন শাসিয়ে গেল তার সহকর্মীটি ।
নিতার অফিস ছুটির পর আজ বাসায় না গিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নেভাল বিচে চলে এল। ভেবেছিল বন্ধুদের ডেকে নিয়ে একটা জম্পেস আড্ডা দেবে। পরক্ষণে এই চিন্তা বাদ দিল।। কিছু বাতিক আছে নিতার। হুট করে একা রেস্টুরেন্টে খেতে চলে যাওয়া একা রিক্সায় ঘুরে বেড়ানো ছাদে উঠে একলা আকাশ দেখা একার মাঝে অনেক কিছুকে ঘিরে থাকা। আবার অনেকের মাঝে বসে থেকেও একবারে একলা হয়ে যাওয়া !
কী সুন্দর আকাশ! তুলোর মত শাদা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ‘আশ্চর্য মেঘদল’। সুন্দর কিছু দেখলে নিতার চোখে ভালো লাগায় জল চলে আসে। সেটা প্রিয় কোন গান হতে পারে প্রিয় কোন কবিতা এমনকী বাঙলাছবির আবেগপ্রবণ কোন সংলাপও হতে পারে। হতে পারে কারো সুবচন ভালোবাসার প্রকাশ! নেভাল বীচটা অনেক পছন্দের নীতার। সমুদ্র আর নদীর মোহনার পাশেই বীচ। এখানটায় আসলেই নিতার মন ভালো হয়ে যায় ….আজ নিতার মন ভালো নেই …মানুষের সীমাবদ্ধতায় মানুষ নিজেই নিচে নামে আবার অপরকেও কতটা অসহযোগিতামূলক আচরণ করে। কতটা এলোমেলো করে দেয় চলার পথ। ভাবতে-ভাবতে চোখ ঝপসা হয়ে আসে নিতার …

বিধবা নারী লালটিপ কেন দেবে! কেন পরবে ঝলমলে শাড়ি! আর এজন্যই তার সমবয়সী সহকর্মী বিভ্রান্ত করে বসলো! তারদিকে চোখ পড়বে কেন অন্য চোখের! বিধবা মানে স্বামীটির মৃত্যুর সাথে সাথে তার স্ত্রী-ও জীবন্মৃত জীবনযাপন করবে। এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই মৌনশাসন শাসিয়ে গেল তার সহকর্মীটি ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী শিক্ষার গোড়ার কথা
পরবর্তী নিবন্ধনারী সাহসিকা