নারী সাহসিকা

রিতু পারভী | শনিবার , ১২ মার্চ, ২০২২ at ১০:২১ পূর্বাহ্ণ

মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত একমাত্র বাসযোগ্য স্থান এই নীল গ্রহ, পৃথিবী। প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এই গ্রহের পরিবেশ কোটি-কোটি প্রাণকে আবাস দিয়েছে, প্রকৃতিকে করেছে প্রাচুর্যে ভরপুর। মানুষ এই গ্রহের একমাত্র প্রাণী যারা ক্রমশ-ই এই গ্রহকে বাসের অযোগ্য করে তুলছে। নিজের সাথে অন্যান্য প্রাণীর জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমাগত বাড়ছে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা। সবকিছু জেনেও বন্ধ হচ্ছে না ওজন গ্যাস নির্গমনের পথ, উজাড় হচ্ছে প্রাকৃতিক বন, কাটা হচ্ছে পাহাড়, নষ্ট করা হচ্ছে ভারসাম্য। এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কিছু কিছু মানুষ অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও আশার পথ দেখায়, নিজ নিজ ক্ষমতার মধ্যে যতটুকু লড়াই করা যায় তার সর্বতো চেষ্টাটুকু করে যায়। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তেমনই একজন মানুষ।
বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম মুখ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ রক্ষায় নানান প্রতিকূলতার মাঝে লড়াই করে চলেছেন ক্লান্তিবিহীন। বিগত বিশ বছর ধরে আপোষহীনভাবে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন তিনি। একের পর এক আইনি লড়াই লড়েছেন। কোথাও কোথাও সাফল্য না এলেও বেশিরভাগ লড়াইয়ে ভালা সিদ্ধান্ত এসেছে কিন্তু কখনোই থেমে যাননি। বিরুদ্ধপথে যাত্রার ফলে ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনেও প্রতিকূলতা এসেছে কিন্তু সৈয়দা রিজওয়ানা থেমে যাননি, পরিবেশ, প্রতিবেশ রক্ষায় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার লড়াইটা চালিয়ে গেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে দেশগুলো সবচেয়ে ক্ষতির মুখোমুখি বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থানের ফলে এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বৈচিত্র্যময়। অবিবেচনা, সিদ্ধান্তহীনতা, অনৈতিক মানসিকতায় খুব দ্রুতই ধ্বংস হয়েছে পাহাড়, নদী, সমুদ্র আর অরণ্যঘেরা এদেশের পরিবেশ। দারিদ্রপিড়ীত এদেশের মানুষের কাছে পরিবেশ প্রতিবেশের চেয়ে অন্য অনুষঙ্গ মুখ্য তাই দ্রুততম সময়ে ধ্বংস হয়েছে বন, নদী, পাহাড়। প্রতিবাদের মানুষের সংখ্যা সে-তুলনায় নগণ্য। সাথে আছে হয়রানির সংস্কৃতি তাই সহজে কেউ এ পথ মাড়ায় না। এমন একটা পরিস্থিতে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে এসেছেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। নদীরক্ষা, বন উজাড়, দূষণ, অনিয়ন্ত্রিত জাহাজ ভাঙ্গা, ভূমি দখলের বিরুদ্ধে আইনি মামলা করে যাচ্ছেন এবং ইতোমধ্যে অনেক মামলায় বিজয় অর্জন করেছেন।
পরিবেশগত অবক্ষয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের স্থানীয় প্রভাবগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন সৈয়দা রিজওয়ানা এবং এর স্বীকৃতিস্বরূপ দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন সম্মাননায় সম্মানিত করা হয়েছে তাঁকে। পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির কারণে ২০০৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ‘পরিবেশ পুরষ্কার,’ পান তিনি। ২০০৯ সালে পান গোল্ডম্যান এনভাইরনম্যান্টাল প্রাইজ যা পরিবেশের নোবেল নামে খ্যাত। ২০০৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন পরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন ৪০ জন হিরোর সাথে সৈয়দা রিজওয়ানাকেও স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এছাড়াও ২০১২ সালে তাঁকে জার্মানের ম্যাগসেসে ফিলিপাইন পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
পরিবেশ বন্ধু সৈয়দা রিজওয়ানাকে ৮ মার্চ ২০২২ বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ (আইডব্লিউওসি) ‘নারী সাহসিকা’ পুরস্কার প্রদান করেন। নানা বিষয় নিয়ে কাজ করায় বিভিন্ন দেশের সাহসী নারীদের মধ্যে ২০০৭ সাল থেকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে আসছে। শান্তি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, লৈঙ্গিক সমতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে ঝুঁকি নিয়ে ও ত্যাগ স্বীকার করে সারাবিশ্বে বিভিন্ন দেশে ব্যতিক্রমী ও সাহসী ভূমিকা পালন করে তাঁদের এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও আরো এগার দেশের এগারজন সাহসী নারীকে এই পুরষ্কার প্রদান করা হয়। ব্রাজিলের সিমোন সিবিলিও দো নাসিমেনতো, মিয়ানমারের এই থিনজার মং, কলম্বিয়ার হোসেফিনা ক্লিনজার জুনিগা, ইরাকের তাইফ সামি মোহাম্মদ, লাইবেরিয়ার ফাসিয়া বোয়েনোহ হারিস, লিবিয়ার নাজলা মানগোউস, মলডোভার ডোইনা ঘেরমান, নেপালের ভূমিকা শ্রেষ্ঠা, রোমানিয়ার কারমেন ঘেওরঘে, দক্ষিণ আফ্রিকার রোয়েগসান্ডা পাসকো এবং ভিয়েতনামের ফম দোয়ান ত্রাং কে এবছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য আইডব্লিউওসি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
১৫ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে ঢাকার ধানমন্ডিতে জন্মগ্রহণকারী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পিতা মহিবুল হাসান এবং মাতা সুরাইয়া হাসানের একমাত্র কন্যা। মেধাবী সৈয়দা রিজওয়ানা ভিখারুন্নিসা স্কুল এবং হলিক্রস কলেজ থেকে পড়ালেখার পাঠ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরবর্তীতে দেশের বাইরে থেকে ফেলোশিপ অর্জন করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি’র সাথে যুক্ত এবং ১৯৯৭ সাল থেকে এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে কমর্রত আছেন।
যেকোন পুরস্কাার কাজের গতি বাড়িয়ে দেয়, উৎসাহিত করে কাজের পরিধি বিস্তৃত করার। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার প্রাপ্তি সৈয়দা রিজওয়ানার জন্য নতুন কিছু নয় তবুও সমপ্রতি প্রাপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর কর্তৃক ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ (আইডব্লিউওসি)‘ নারী সাহসিকা’ পুরস্কার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং বেগবান করবে বলে বিজ্ঞজন মনে করেন।

এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কিছু কিছু মানুষ অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও আশার পথ দেখায়, নিজ নিজ ক্ষমতার মধ্যে যতটুকু লড়াই করা যায় তার সর্বতো চেষ্টাটুকু করে যায়। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তেমনই একজন মানুষ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলাল টিপ
পরবর্তী নিবন্ধঘুমধুমে ইউপি সদস্যের বসতঘর পুড়ে ছাই